স্মৃতিতে আব্বু

তৌহিদুল ইসলাম ১৬ জুন ২০১৯, রবিবার, ০৪:৫৭:৩৫পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৯ মন্তব্য

আজ বাবা দিবস। আসলে বাবা মা’দের স্মরণ করার জন্য আলাদা কোন দিবসের প্রয়োজন নেই। তাদের উদর থেকে নিঃসৃত এক ফোঁটা পানির ঋনই যে কোনওদিন শোধ করতে পারবোনা। এই সুন্দর পৃথিবীর আকাশ বাতাস সবাই স্বাক্ষী, তারা আমার জন্য যা করেছেন তার বিনিময়ে আমি কিছুই করতে পারিনি তাদের জন্য। আমি ছোটবেলা থেকেই সবসময় বাবাকে আব্বু বলেই ডেকেছি। আজ আব্বুকে নিয়ে কিছু লিখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।

আব্বু ছোটবেলা থেকেই পরম উপকারী মানুষ ছিলেন। একবার নিজের পরনের একটাই শার্টটি তিনি তার স্কুলের প্রিয় বন্ধুকে উপহার দিয়েছিলেন। কারন তার বন্ধুটি স্যান্ডোগেঞ্জি পরে স্কুলে আসতো সবসময়। এটা তার মোটেই ভালো লাগতো না। আমার মামনি বলে, আমিও অনেকটা সেরকমই হয়েছি। বাবা তুমি কি দেখতে পাও আমাকে ওপার থেকে?

আব্বু বারবার যে গল্পটি আমাকে শোনাতেন তা হলো- যেদিন এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল হাতে পেয়েছিলেন সেটা তার বাবা মাকে জানানোর জন্য তিনি প্রায় সাত মাইল রাস্তা দৌঁড়ে বাড়িতে এসেছিলেন।

রেজাল্ট শোনার পর দাদা বাবাকে বলেছিলেন- কামাল আর কত পড়বি? ভাই বোনের হাল ধর এবার। বাবার আদেশ শিরোধার্য, তাই তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে দায়ীত্ব পালন করেছেন। কষ্ট পেয়েছেন তবু দমে যাননি।

আব্বু ছোটবেলা থেকে তুখোড় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের কোন ক্লাসে তিনি কখনওই সেকেন্ড হননি। অদ্ভুত তো! আব্বু, তুমি শিক্ষকদের কি ঘুষ দিতে?

আমার এ কথা শুনে আব্বু প্রচুর হেসেছিলেন সেদিন। তোমার সে হাসির শব্দ আমি আজও ভুলিনি।

আব্বুর হাতের লেখা একদম আয়নার মত ঝকঝকে ছিলো। ছোটবেলায় আমি আব্বুর হাতের লেখার উপর নিজে নিজে লিখার প্রাকটিস করতাম। কিন্তু হায়! আমি কোনোদিনও পারিনি তোমার মতন করে সুন্দরভাবে লেখা লিখতে। আব্বু তুমি এত সুন্দর ভাবে কি করে লিখতে?

ক্লাসে সবসময় প্রথম হতে তুমি, তাই তোমার প্রিয় বন্ধুর খুব মন খারাপ থাকতো পরীক্ষার সময়। কলেজের সমাপনী পরীক্ষার নিজের খাতায় নিজে নিজেই কম লিখে সেকেন্ড হয়ে তুমি তোমার বন্ধুকে প্রথম করে দিয়েছিলে। কি উদার মন ছিলো তোমার আব্বু!

মুক্তিযুদ্ধে দেশের হয়ে লড়বে বলে ডাক্তারি পড়াশুনার মাঝখানে ভারত চলে গেলে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। তোমার আর ডাক্তারি পড়া হয়নি। অথচ ক্লাসে তোমার প্রথম হতে সাহায্য করা সেই বন্ধুটি ডাক্তার হয়ে দেশের সবচেয়ে বড় একটি মেডিকেল কলেজের মহাপরিচালক হয়েছিলেন। তিনি এখনো তোমার কথা মনে করেন আর অশ্রু ঝরান। তাকে দেখে আমার মন যে তখন ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে তা কি অনুভব করো আব্বু?

এরশাদ সরকারের আমলে তোমাকে যখন ব্যাংক থেকে অন্যায়ভাবে চাকুরীচ্যুত করা হয়, তুমি প্রতিবাদ করোনি। কারন তুমি প্রতিবাদ করলে রাস্তায় নামতো আরও হাজারজন ব্যাংক কর্মচারী। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তুমি আর কোন অরাজকতার সৃষ্টি হতে দিতে চাওনি। শুধু এ কারনেই পরবর্তীতে তোমার প্রতি সম্মান জানিয়ে ব্যাংকে চাকুরী না করেও তোমাকে বাংলাদেশ সিবিএ এসোসিয়েশনের সভাপতির পদ দেয়া হয়। এটা তোমার প্রাপ্য ছিলো। দীর্ঘদিন আর সে চেয়ারটিতে কেউ বসেনা আব্বু। নতুন সভাপতি নতুন চেয়ারে বসেন। তোমার সে চেয়ারটি আজও ফাঁকাই পড়ে আছে সযতনে।

এখনো দেশের যে প্রান্তেই যাই, সে সমসাময়িক সবাই তোমাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধার সাথে। একজন সন্তান হিসেবে আমার কাছে এটা অনেক বড় সম্মান।

সততার সাথে রাজনীতি করেছো বলে দীর্ঘ ২১ বছর একটানা চেয়ারম্যান ছিলে তুমি। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানদের তালিকায় এখনো তোমার নাম নামফলকে জ্বলজ্বল করছে।

তোমাকে সম্মানিত করে সরকার প্রধানদের দেয়া সেই সোনার মেডেলগুলি আমি, আম্মা আমরা সবাই প্রতিদিন একবার করে হলেও হাত বুলাই। সে আদর কি তুমি অনুভব করো আব্বু?

সততার মুল্যায়ন সবসময়ই হয়। একটু আগে কিংবা পরে। তবে তোমার মুল্যায়ন গাঁথা লিখে শেষ করতে পারবোনা আব্বু।

আমি স্কুল পালিয়েছিলাম বলে একদিন লাঠি দিয়ে কি ভীষণ মেরেছিলে আমায়। অথচ রাত্রিতে চুপি চুপি আমার ঘরে এসে পুরো শরীরে মলম লাগিয়ে দিয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলে সেদিন।

তুমি কি ভেবেছিলে আমি ঘুমিয়েছিলাম? না আব্বু, আমিতো জেগেই ছিলাম। পাছে তুমি লজ্জা পেয়ে চলে যাবে এই ভেবে আমি কিন্তু চোখ খুলিনি সেদিন। তা যদি তুমি জানতে আব্বু?

কৈশরে লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার মাঝ দিয়ে সীথি করে চুল আঁচড়াতাম। তাই দেখে তুমি একদিন বলেছিলে- তোকে দেখতে গুণ্ডা গুন্ডা লাগে।

আমি উত্তরে বলেছিলাম- তাহলে তো রবীন্দ্র-নজরুল সবাই গুণ্ডা ছিলেন। এর বিনিময়ে বেশ কয়েকটা আলতো চড়ের আঘাত সেদিন পড়েছিল আমার কাঁধে আর গালে। সেটা প্রথম কৈশোরের সূচনা লগ্নে।

পুরুষ ক্রন্দনজয়ী, এই কথা মনে করে তোমার মারকে সেদিন হিমালয়ের মত সয়ে গেছি। অথচ এখন আর লুকিয়ে নয়, সবার সামনে দুনিয়ার বাহারি ডিজাইন মাথায় তুলে আনলেও তুমি কিছু বলোনা। কারণ আদরের বকাটুকু দেয়ার জন্য তুমি আর এ পৃথিবীতে নেই আব্বু।

নিজে এক্সিডেন্ট করেছিলে দু’জন ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে। তারাতো বেঁচে ভালোই আছে আব্বু। আল্লাহ্‌ আমাদের এতিম করে তোমাকে নিয়ে চলে গেলেন!

তুমি কি জানো- সেদিন যে গাছটির সাথে তোমার ধাক্কা লেগেছিলো, তোমার শোক সইতে না পেরে সে গাছটিও মরে গিয়েছে? অথচ বিশ হাজার গাছ নিজ হাতে রোপণ করেছিলে রাস্তার দু’পাশে শুধু মানুষের উপকার হবে ভেবে। এত উপকারী আর ভালো মানুষেরা বোধহয় বেশিদিন বাঁচে না, তাইনা আব্বু?

তোমার নিজ হাতে গড়া স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, খেলার মাঠ, নদীর বাঁধ এসবই এখনো তোমার অনুপস্থিতিকে মেনে নিতে পারেনি বোধহয়। তাইতো সেখানকার মানুষজন এখনো আমাদের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে।

যেদিন প্রথম প্লেনে উঠেছিলাম সেই ছোট্টবেলায়, ভয়ে তোমার হাত জড়িয়ে ধরে ছিলাম। তোমার হাত ধরে গাড়িতে ওঠা, চালানো শেখা, স্কুলে যাওয়া আর শেষবারের তোমার মৃত্যুশয্যায় তোমার হাত জড়িয়ে ধরা। সে স্পর্শগুলি কি করে ভুলি বলোতো আব্বু?

তিনশত কিলোমিটার পথ একা তুমি আর আমি এক এম্বুলেন্সে করে এসেছি। তোমার মাথাটাকে আমি জীবনে সেইবারই প্রথম এবং শেষবারের মতন কোলে নিয়েছিলাম। হায়! তুমি জীবিত থাকলে দেখতে কতগুলি নোনা অশ্রুর ফোঁটা পড়েছিলো তোমার কপালে সেদিন! আমি বারবার তোমার কপালে চুমু দিচ্ছিলাম, আর সে নোনা জল মুছে দিচ্ছিলাম।

শুনেছি মৃত মানুষের আত্মা সব দেখতে পায়। তুমি কি দেখতে পেয়েছিলে আব্বু সেসব কিছু?

কয়েক হাজার মানুষ যারা তোমার জানাজায় শরিক হয়েছিলেন সেদিন, সবার সেই আবেগ আর কান্নার রোল যেনো এখনও বাতাসে ভাসছে। যখনই সেখানে যাই, আমি শুনতে পাই তোমাকে ভালোবাসা মানুষের সেই গগন বিদারী আর্তচিৎকারগুলো। ঈদ গাঁ মাঠ, আর মাদ্রাসা ময়দানটি আজও আছে। শুধু তুমি নেই;আর সেই সবুজ প্রকৃতিও যেন ম্লান হয়ে গিয়েছে আব্বু।

তোমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার পরে যখন কবরে শুইয়ে দিলাম, আমার জন্য বিদেশ থেকে নিয়ে আসা তোমার উপহার দেয়া সেই মানিব্যাগটাও কবরে পড়ে গিয়েছিলো সেদিন। প্রথমে টের পাইনি। পরে মনে হতেই আমার মনে প্রথম যে প্রশ্ন আর ভাবনাটি এসেছিলো তা হলো- তুমি তোমার কবরে আমাকে দেয়া তোমার শেষ স্মৃতিচিহ্নটিও সাথে নিয়ে গেলে? কেন? সেটি আমার কাছে স্মৃতি হিসেবে থাকলে কি এমনটা হতো আব্বু?

এর উত্তর আমি প্রতিনিয়ত তোমার কবরের পাশে গিয়ে করি। কেন তুমি উত্তর দাওনা আব্বু? অথচ আমি জানি তুমি সব দেখছো, সব শুনছো। সেখানে তুমি ভালো আছতো আব্বু?

নিশ্চই ভালো আছো। তোমার কবরের সবুজ শ্যামল গাছগুলিই আমাকে ইশারায় বলে যায় সেসব। তাদের পাতার মর্মর ধ্বনি আমার কাছে তোমার আওয়াজ পৌঁছে দেয়। আমি ভালো নেই আব্বু। তোমাকে ছাড়া একদমই ভালো নেই।

আব্বু, তোমাকে নিয়ে লিখলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে তবু স্মৃতিগুলি লিখে শেষ করতে পারবোনা। যতদিন বেঁচে ছিলে মাথার উপর ছায়া হয়ে ছিলে সারাজীবন। আর এখন আমার সঙ্গী তোমার সেইসব স্মৃতিগুলি। তোমার আদর্শ আর চেতনার চিহ্নগুলি যেন আমার ভবিষ্যৎ প্রনন্মকে কিছুটা হলেও দিয়ে যেতে পারি সে চেষ্টাই করি প্রতিনিয়ত। বিধাতা যেনো আমাকে সেই শক্তি দেন।

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা। ওপারে ভালো থেকো আব্বু।

আসলে প্রিয়জনকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে লেখা যায়না, আমি পারিনা। ফিচার ছবিটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ