সার সংকটে কৃষক

রোকসানা খন্দকার রুকু ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, বৃহস্পতিবার, ০৮:৫২:৩২অপরাহ্ন সমসাময়িক ৭ মন্তব্য

-এই এক দেশ আমাদের, একেবারে সোনা, সোনা, সোনা।

-দুর মিয়া, থামেন তো কি হইছে; এতো সোনা, সোনা করছেন কেন? যে দেশে সরকারি লোকজন চোর হয় সে দেশ কখনো সোনার দেশ হয় না? ও হয় বাপ্পি লাহিড়ীর সোনার দেশ! শুধু নিজের গলায় ঝোলে। দেশে ওমিক্রণ বেড়ে গেলো। অমনি ট্রেনের টিকিট নেই। তিনদিন  আগে টিকেট নিতে গিয়েও নেই। অথচ অফিসারের কম্পিউটার টেবিলে লেজের মতো ঝুলছে টিকিট। তার কানে ফোন। তাতে তিনি বলছেন, আচ্ছা আসেন দেখা যাক! এবং যারা এসে তাকে ভাই, মামা, চাচা,দুলাভাই ডাকছে তাদের সুরসুর করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে টিকেট দিচ্ছে। দাম টিকিটের থেকে ১০০/২০০ বেশি। সরকারী চোর ব্যাটার আমি পরিচিত না, তাই আমাকে বলা হচ্ছে টিকিট নেই। তারা ভাবে আমরা জনগন ভোদাই,কিছু বুঝি না বুঝলেন? আসলে সবই বুঝি, কিন্তু করতে পারি না কিছুই! চোরের দেশ আর কবে সোনার দেশ হবে? বলেন তামার দেশ কারণ লোহারও অনেক দাম!

-আরে ভাই এতো ভাবাভাবির কি আছে? দেবের গান শোনেন নি - ‘এলোমেলো করে দে মা লুটে পুটে খাই’। সুযোগ যদি থাকে যার যেভাবে চলুন লুটে পুটে খাই।

-ভালোই বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের সাথে হাত মেলানোর মতো! নিজের দেশ, নিজের মাকে লুট করা।

সাতসকালে সার কিনতে গিয়ে দুই প্রবীণের এমন আলাপচারীতা কেমন যেন খোঁচা দেয়। কাদার ছিটা নিয়ে সারাদিন ঘুরতে হয়। মন বারবার বলে আমরা সবাই কি এমন? সবাই না হলেও নষ্টের জন্য অল্প ও ধারালোই যথেষ্ট। কুরবাণীর গরু জবাইতে ছুঁড়ি, চাকু অনেক থাকে। সব কাজে লাগে না, দুচারটে হলেই গরু খতম।

অনেক আগে সারের জন্য জনগনকে দীর্ঘ লাইনে সকাল- সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সকাল বেলায় এমন লাইন দেখে মনে হতো এ বোধহয় ভোটকেন্দ্রের ভোট দেবার দীর্ঘ অপেক্ষা। আসলে এ ভোটের লাইন নয়। এমন করে পাবলিককে ঘন্টার পর ঘন্টা সারের জন্য দাড়িয়ে থাকতে হতো। এতো অপেক্ষার পর কারও কপালে সার মিলতো, আর কোন কোনদিন কৃষককে খালি হাতে ফিরতে হতো। সে সময় নাকি অনেক মানুষও মারা গিয়েছিল। এখনও আমরা সেটিকে দুখ্খজনক একটা অধ্যায় হিসেবে দেখি।

তখনও বলা হয়েছিলো পর্যাপ্ত সার মজুদ আছে। এরপর অনেকদিন এসবঝামেলা ছিলো না। সারের দাম কম ছিল না কিন্তু সার পাওয়া যেত।

বাংলাদেশের যমুনা সার কারখানায় তৈরি যমুনা ইউরিয়া সার অতি উন্নত মানের। সুন্দর ঝরঝরে, দেখে খেতে ইচ্যছে করে। গতবছর পাওয়া গেলেও এ বছর তার আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তার বদলে বাজার সয়লাব নিম্ন মানের বল মার্কা ইউরিয়া সার। ‘দামে কম মানে ভালো কাকলীর ফার্নিচার’ এর মতো অবস্থা। অন্য কোন ইউরিয়া সারই বাজারে নেই। তাই বাধ্য হয়ে বল মার্কাই কৃষককে কিনতে হচ্ছে।

আমাদের বি এ ডিসি অফিসের এম ও পি (পটাশ) অতি উন্নত মানেরসার। কিন্তু এ বছর তা খুবই কম। আর দাম? ওরে বাবা- আপনি ছুঁতেই পারবেন না। ব্যবসায়ীরা তাদের মন মতো বেচছে। যার কাছে যেমন দাম পাচ্ছে।

আমার সার লাগবে। পরিচিত ছোট ভাই সারের ডিলার। অন্যবার তাকে ফোন দিয়ে রিক্সা বা ভ্যান পাঠালেই সে সার পাঠিয়ে দেয়। এবার সে জানালো সে অপারগ।

কেন সে অপারগ এ ঘটনা দেখতে গিয়েই আমার চক্ষু চরকগাছ। কৌতুহলী আমি তার কথা অবিশ্বাস করে একটা রিক্সা নিলাম। শহর ঘুরবো, দোকান ঘুরবো এবং দেখবো আসলেই কি সার নেই? এবং কেন এতো দাম?

দুঘন্টায় আটটা দোকান ঘুরে যা পেলাম তা দুখ্খজনক। সার আছে তবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম থাকায় দাম অনেক চড়া। কারন কি? তারা নাকি নিজেরাই পাচ্ছে না। যতো শহর থেকে বেডিয়ে গ্রামের দিকে এগুচ্ছি, দামও যেন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছে। অবশেষে আট দোকান দেখে আমাকে সেই চড়া দামে সার কিনে ফিরতে হলো। অযথা রিক্সা ভাড়া ৩০০ টাকাও গুনতে হলো।

 

“এদিকে আমাদের কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, টিএসপির ১ লাখ ১৪ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে মজুত রয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার টন। ডিএপি ও এমওপির চাহিদা যথাক্রমে ২ লাখ ৮৮ টন ও ১ লাখ ২৯ হাজার টন। আর মজুত যথাক্রমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার টন ও ৩ লাখ ১২ হাজার টন।

সরকারের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) ৫০ কেজি ১১০০ টাকা। ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ৫০ কেজি ৮০০ টাকা ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) ৫০ কেজি ওজনের বস্তার দাম ৭৫০ টাকা।

অথচ বাজারে টিএসপি ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, ডিএপি ৯৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০ টাকা এবং এমওপি ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যার নজরদারী নেই। আরও ভরা মৌসুম শুরু হলে তা অনেক বেডে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”

বিখ্যাত মসলিনের জন্য আজও আমাদের আফসোসের শেষ নেই। আহা! যদি থাকতো আমরা বিরাট কিছু করে ফেলতাম। আসলে কি তাই? আমাদের দেশে পাটকলগুলোর দুরঅবস্থা। অবশেষে অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেলো।এরপর সারের জন্য বিখ্যাত যমুনা সার কারখানা অথচ পাইকারী ডিলার বলছে সরকার অন্য কোম্পানীর কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে সার নিয়ে আসে। এবং এই বল মার্কা ইউরিয়া সার নাকি চায়না থেকে আনা। তাহলে কি আস্তে আস্তে আমরা সকল ঐতিহ্য হারিয়ে রেডিমেট খাওয়া শুরু করবো?

এবার শীত গেলো। ভরা শীতের কষ্ট ভোলা যায় সবজির হরেক রকম পদ খেয়ে। এবার তা আর হয়নি। লেপ কাঁথার ওমের মতো সবজীর দামও কমেনি। দাম কমে কিসের? আসলে সব তো শুধু বেশি হয়। আজ অবধি বাংলাদেশে কোন জিনিসের দাম কমেছে বলে মনে হয় না। প্রায় প্রতি মাসেই নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের দাম দারুন গতিতে বেড়েই চলছে।

জনগন নাভিস্বাস হয়ে বলছে- ওরে তুই থাম। আমাদের একটু জিরোতে দে!

কে শোনে কার কথা! শুধুই দেখছি দাম বাড়ার ‘সরি, উন্নয়নের জোয়ার আর জোয়ার। আর আমরা তাতে যা-ই ভেসে যা-ই যেদিকে মন চায়।

ছবি- নেটের

 

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ