যখন ফুটল বিয়ের ফুল!

নিতাই বাবু ২৫ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ০২:২৬:২৩পূর্বাহ্ন বিবিধ ১৫ মন্তব্য

 

ফুল বা পুষ্প হল উদ্ভিদের বিশেষ একটি মৌসুমী অঙ্গ । যা উদ্ভিদের প্রজননে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । ফুল থেকে উদ্ভিদের ফল হয় । সপুষ্পক উদ্ভিদের যে রুপান্তরিত অংশ ফল ও বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বংশবিস্তারে সাহায্য করে তাকে ফুল বলে । পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে সর্বমোট কত প্রকার ফুল আছে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন । এরমধ্যে ফুলের জগতে ১০০ থেকে ১৫০ প্রাজাতির গোলাপ ফুল রয়েছে । এই সমস্ত প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন উপ-প্রজাতি । সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫০টি আলাদা আলাদা গোলাপের অস্তিত্ব রয়েছে । তাহলে এত ফুল আমরা চোখে দেখলেও একটি ফুলের নাম শুনি, কিন্তু চোখে দেখি না । সেই ফুলের নামটা কী? নাম: বিয়ে ফুল ।

মানুষের প্রথম বিয়ের ফুল যে কখন ফুটে, তা বলা মুশকিল । মেয়েদের বেলায় কারোর ১২/১৩ বছরের মধ্যেই বিয়ের ফুল ফুটে যায় । আবার কারোর কুড়ি পেরিয়ে ৩০/৩৫ বছরেও ফুটে । পুরুষের বেলাও একই নিয়মেই ফুটে বিয়ের ফুল, কারও তাড়াতাড়ি, কারও দেরিতে । আবার কোনও কোনও মেয়ের বিয়ের ফুল ফুটেই না । সে থেকে যায় চির কুমারী হয়ে । বিদাতার বন্ধন কার জন্য কোথায় যে বেঁধে রেখেছে, তা কে জানে! কারোর বিয়ে হয় বাড়ির পাশে, কারোর আবার যেতে হয় শহর ছেড়ে গ্রামে । কেউ আসে গ্রাম থেকে শহরে, কেউ আবার থেকে যায় নিজের আত্মীয়স্বজনদের সংসারে ।

নারায়ণগঞ্জের একটা মহল্লায় বসবাসকারী পরিবারের এক মেয়ে, নাম ছিল তার স্বপ্না । সেই স্বপ্নারও স্মরণে ছিল না, একদিক তার বিয়ের ফুল ফুটবে । বিয়ে হবে, শহর ছেড়ে একদিক তাকে দূরের এক গ্রামে যেতে হবে । যেখানে থাকবে তার স্থানী ঠিকানা, যার জন্য হয়েছে তার জন্ম । এটাই আমাদের সামাজিক প্রথা ও দৈনন্দিন জীবনের নিয়ম । স্বপ্না এখন বড় হয়েছে, সবেমাত্র এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়েছে । পড়ার আরও ইচ্ছে ছিল স্বপ্নার, কিন্তু আর্থিক দুরাবস্থার জন্য আর পড়া হলো না । স্বপ্নার মা-বাবারও এখন চিন্তা শুধু স্বপ্নাকে নিয়ে । চিন্তাটা হল স্বপ্নাকে কীভাবে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবে । কিন্তু স্বপ্নার বিয়ের ফুল ফুটচ্ছে কী? না ফুটলেও হয়ত ফোটার সময় হয়েছে ।

একদিন স্বপ্নাকে এক পাড়াগেঁয়ের ছেলে দেখতে আসার কথা । যার মাধ্যমে দেখতে আসবে সেই মধ্যস্থতা ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের । বিয়ের ব্যাপারে মধ্যস্থতার জন্য যাকে খুবই প্রয়োজন, তাকেই বলে ঘটক । ঘটক যেই এলাকায় বসবাস করতেন, সেই এলাকায় একটা গার্মেন্টস ছিল । ওই গার্মেন্টস'ই ছেলেটি কাজ করতো । সেই থেকেই ছেলেটির সাথে ঘটকের পরিচয় । ঘটক ছিল মুসলমান, আর ছেলেটি হিন্দু । একসাথে চলাফেরার মাঝেই উঠে আসে বিয়ের কথা । একদিন ঘটককে ছেলেটি বলল, "আপনার পরিচিত কোনও হিন্দু মেয়ে থাকলে বলুন, আমি বিয়ে করবো ।"

ছেলেটির কথা শুনে ঘটক খুশি হয়ে বললেন, "থাকবে না কেন? আছে । আমার এক হিন্দু ভাইয়ের একটা মেয়ে আছে, খুব সুন্দর! তুমি যদি বলো তো তোমাকে দেখাতে পারি ।"
ঘটকের সাথে স্বপ্নার বাবার বহুদিন ধরে সুসম্পর্ক । যার কারণেই ঘটক ছেলেটির কাছে ভাই পরিচয় দিয়ে বলেছে ভাইয়ের মেয়ে । ঘটকের কথা শুনে ছেলেটি বলল, "ঠিক আছে, তা হলে কবে দেখাবেন বলুন?"
ঘটক বললেন, "আগামী শুক্রবার ।"
ছেলে_"ঠিক আছে, আমি শুক্রবারের অপেক্ষায় রইলাম ।"
এই ফাঁকে ঘটক স্বপ্নার মায়ের কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বললেন । ঘটকের কথা শুনে স্বপ্নার মা বললেন, "আচ্ছা ঠিক আছে, আমি স্বপ্নার বাবার সাথে আলাপ করে আপনাকে জানাচ্ছি ।"

স্বপ্নার বাবা তখন চাকরি করে নারায়ণগঞ্জের বাইরে, কোনও এক জেলাশহরে । পরদিন স্বপ্নার মা একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকানে যায় । সেখান থেকে ফোন করে স্বপ্নার বাবার কাছে । ফোন নম্বরটা ছিল স্বপ্নার বাবা যার কাজ করে, তার । তখনকার সময় এত হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না । সময়টা ২০০৬ সালের শেষের দিকের কথা । তখন এক মিনিট কথা বলতে খরচ হত ৮ টাকা ।

ফোন কল পেয়ে স্বপ্নার বাবার কাছে মোবাইলটা এনে দেয় । স্বপ্নার বাবা তখন মোবাইল ফোন কীভাবে ধরে কথা বলে, তাও জানত না । মোবাইল ফোন উল্টো করে ধরেই হ্যালো হ্যালো করে চিল্লাচ্ছে ।
তা দেখে সাথে থাকা মালিক হেসে বলছে, "তুমি মোবাইল উল্টো ধরেছ কেন?" এই বলে মালিক মোবাইল ফোনটা ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, "এখন কথা বল তোমার পরিবারের সাথে ।"
স্বপ্নার বাবার কানে মোবাইল, অপরপ্রান্ত থেকে বলছে, "শুনছো! আমি স্বপ্নার মা বলছি ।"
_"শুনছি বল কী হয়েছে?"
_ "স্বপ্নার সমন্ধ আসেছে, সামনের শুক্রবার স্বপ্নাকে দেখতে আসবে । আজ রবিবার, বৃহস্পতিবারের মধ্যে তুমি কী আসতে পারবে?"
_"দেখি যদি ছুটি পাই তো আসবো, না হয় তুমি যেভাবে পার ম্যানেজ করে নিয়ো ।"

এই বলেই স্বপ্নার বাবা ফোন দিয়ে দিলেন মালিকের কাছে । মালিক জিজ্ঞেস করলেন, "বাবু কী খবর এলো বাড়ি থেকে?"
স্বপ্নার বাবা বললেন, "মেয়ের বিয়ের জন্য সমন্ধ এসেছে সাহেব ।"
_"বেশ তো হয়েছে! এ তো খুশির সংবাদ । তোমার পরিবারকে বলে দিয়েছ নাকি যে, আমি আসতে পারবো না । বুঝতেই পারছো সামনে ঈদ, আমার ব্যবসার সিজন । লাগে টাকা নিয়ো, ছুটি পাবে না কিন্তু!"

মালিকের কথা শুনে স্বপ্নার বাবার দু'ছোখে চোখের জল টলমল করছে । হাউ মাউ করে কাঁদতে পারল না, লোকলজ্জার ভয়ে । কিন্তু বুক চাপা দিয়ে ভেতরেই কাঁদছে, কেউ যেন না বুঝে । গরিব মানুষের কোনও খুশির সংবাদেও দুঃখ নিয়ে কাঁদতে হয় । যেমনটা কাঁদলেন স্বপ্নার বাবা । কাঁদতে হত না, যদি তার মালিকের মতো অজস্র টাকা থাকত । মেয়ে বড় হয়ে উঠবার পর, এটাই হল বিয়ের প্রথম প্রস্তাব । আর এই দেখাদেখির অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকাটা বড়ই বেদনার । তবু কিছুই করার থাকল না, স্বপ্নার বাবার । শুধু একা একা নীরবে কাঁদতে হল মনে দুখে নিয়ে ।

এদিকে স্বপ্নার মা ঘটককে কথা দিয়েছেন, শুক্রবার ছেলেকে নিয়ে আসতে । আর আসতে হবে সন্ধ্যার পর, যাতে পাড়ার সব মানুষ থাকতে পারে । ঘটক আশ্বাস দিয়েছেন, "তাই হবে ।"

ছেলে ব্যাচেলর থাকে, তার কোনও আত্মীয়স্বজন এখানে নেই । মেয়ে দেখতে শুধু ঘটক আর ছেলের একাই আসার কথা । ঘটক ছেলেকে আগেই বলে দিয়েছে যে, আমার ভাই খুবই গরিব মানুষ । বেশি খরচ করার মত তার পক্ষে সম্ভব নয় । মেয়ে দেখতে যাতে সাথে কোনও বন্ধুবান্ধব নেওয়া যাবে না । ছেলের সম্মতি পেয়ে ঘটক স্বপ্নার মাকে জানিয়ে দিলেন, ক'জন আসবে ।

মেয়ের সমন্ধের ব্যাপার, গরিব হলেও কিছু না কিছু খরচ তো হবেই । তাই স্বপ্নার মা চার পাঁচজনের খাবারের আয়োজন করে ফেলেছে । সাথে দধি, মিষ্টি সহ দুইএক পদের ফলফলারি । করেছে একটিমাত্র মেয়ে, এই প্রথম মেয়েকে দেখতে আসছে তাই । গরিবের গরিবানা না দেখালে কেউ দেখবে না, কিন্তু এটা সবাই দেখবে । ছেলে ও পাড়াপড়শি কেউ যেন নাক না উল্টায়, সবাই যেন প্রশংসা করে । স্বপ্নার মায়ের উদ্দেশ্য হলো, সবাই যেন বলে ভালো খরচ করেছে ।

শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ টায় ঘটক ছেলেকে সাথে নিয়ে স্বপ্নাদের বাসায় হাজির । ঘটক আর ছেলে বাসায় গেলেন, তাদের সাথে আর কেহ নাই । বাসায় গিয়ে বসার সাথে সাথে তাদের মিষ্টি খেতে দিলেন । কিন্তু দধি দিলেন না, কারণ; দধি যদি চুকা হয়? তাহলে তো বিয়ের পর ইষ্টির মাঝে মিষ্টি থাকবে না । এই ভেবে স্বপ্নার মা ছেলেকে দধি দেয়নি ।

মিষ্টিমুখ করানোর পর স্বপ্নাকে সাজিয়ে ছেলের সামনে হাজির করা হলো । স্বপ্নাকে বসানো হলো ছেলের সামনাসামনি, একটা চেয়ারে । যেই বাসায় স্বপ্নারা ভাড়া থাকত, বাসাটা একটু ছোট । এই ছোট বাসাটা কানায় কানায় ভরে গেল পাড়ার লোকে । ঘর ভরা মনুষের মধ্য থেকে ক'জন মহিলা স্বপ্নাকে দেখাতে লাগলেন । ছেলে বোবার মত হয়ে স্বপ্নাকে দেখছে, যেন এই প্রথম কোনও মেয়েমানুষ দেখা ।

স্বপ্নার স্কুলের বান্ধবীরা স্বপ্নাকে এদিক সেদিক করে দেখাচ্ছে । আরও দশজন মেয়েকে যেভাবে দেখানো হয়, সেভাবেই স্বপ্নাকে দেখাচ্ছে । দেখা শেষে ছেলে স্বপ্নার হাতে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে বলল, "দেবার দরকার ছিল আংটি, সেটা আমি দিতে পারলাম না । তবে কিছুদিনের মধ্যেই আংটি নিয়ে আমার বাবা আসছে । আমি এখানে নতুন চাকরি নিয়েছি, হাত খালি । না হয় আমিই আংটি নিয়ে এখানে আসতাম । এর পর খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে ছেলেকে ঘটক বিদায় নিল । তখন রাত দশটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি ।

ঘটক ছেলেকে ওর ব্যাচেলার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন । সেখান থেকে ঘটক আবার চলে এলেন স্বপ্নাদের বাসায় । স্বপ্নার মা তখন ঘটককে জিজ্ঞেস করলেন, "দাদা, আয়োজনটা আমি কি ঠিকমত করতে পেরেছি?"
ঘটক বললেন, "হ্যাঁ, যা করেছেন তা ছিল একেবারে জবাব ছাড়া ।"
_"ছেলেটা খুশি হয়েছে তো?"
_"হবে না মানে! এমন সমাদর আজকালকার দিনে কেউ করবে নাকি শুনি?"
_"না_বলছিলাম, আমি গরিব মানুষ তো দাদা, যদি ছেলেটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়?"
_"না না, তা হবে কেন? সমাদর কম হয়নি, বেশ হয়েছে ।"
_"এখন বলুন, ছেলের সিদ্ধান্তের কথা । আমার অভাগী মেয়েটাকে ছেলের পছন্দ হয়েছে কিনা?"
_"তার জন্যই তো আমার আবার আসা । ছেলেটাও জানতে চেয়েছে আপনাদের পছন্দ হয়েছে কিনা?"
_"আমাদের শতভাগ পছন্দ, এখন যদি ছেলের পক্ষ থেকে মত দেয় ।"
_"ছেলেরও পছন্দ হয়েছে, বাকি রইল সৃষ্টিকর্তার কৃপা ।"
_"ছেলের মা-বার যদি পছন্দ না হয়?"
_"তা আমি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছি! ছেলে বলেছে, তার মা-বাবারও পছন্দ হবে । আর একটা কথা, ছেলে এখানকার চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যাবে । কারণ; ওদের বিশাল সম্পত্তি, চাকরির দরকার হয় না । ছেলেটা বাড়ি থেকে রাগ করে এখানে আসেছে, তাই চাকরি করা ।"
_"চাকরি না করলে আমার মেয়ের সমস্যা হবে না-তো?"
_"আরে না না, তা হবে না । আশা করি আপনার মেয়ে সুখে শান্তিতেই থাকবে । কারণটা হলো, ছেলে তো আর অকর্মা না, কাজ জানে! ফার্নিচারের কাজ, মটর মেকানিকাল সহ আরও অনেক কাজ ।"
_"তো ছেলের দাবিদাওয়া কী? আমরা কোনও দাবিদাওয়া দিতে পারবো না, তা আগেই বলে দিচ্ছি ।"
_"ছেলে তো বলেছে, তার এবং তার পরবারের পক্ষ থেকেও দাবিদাওয়া থাকবে না । আপনারা প্রস্তুতি নিন, এই বিয়ে হবেই । দাদাকে বলেন, তাড়াতাড়ি নারায়ণগঞ্জ চলে আসতে ।"

এই কথা বলে ঘটক স্বপনাদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় । দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় স্বপনার মা । সারারাত আর ঘুম হয়নি, শুধুই অপেক্ষা ভোরের আশায় । ভোর হতেই, প্রস্তুতি নিচ্ছিল ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে যাবে । ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে গিয়ে স্বপ্নার বাবার কাছে ফোন করবে । কিন্তু এতো সকালে তো ফোন-ফ্যাক্সের দোকান খুলে না । সবেমাত্র সকাল ৭ টা বাজে । আবার নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে নিল, যাবে ১০ টায় । ১০ টা বাজতে-না-বাজতেই স্বপ্নার মা ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে হাজির ।

ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে গিয়ে স্বপ্নার বাবার মালিকের নম্বরে ফোন করে । মালিক ফোনটা এনে স্বপ্নার বাবার কাছে দিয়ে বলে, "বাবু তোমার ফোন, কথা বলো ।"
ফোনটা কানের কাছে নিতেই, স্বপ্নার মায়ের কথা স্বপ্নার বাবা শুনছিলেন । স্বপ্নার মা বলছেন, "হ্যাল্লো হ্যাল্লো, কথা বলে না ক্যান?"
_"হ্যাঁ, হ্যালো বলো আমি শুনছি, কী হয়েছে?"
_"গেল শুক্রবার স্বপ্নাকে ছেলে দেখে গিয়েছে, তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আস ।"
_"ছেলের পছন্দ হয়েছে?"
_"হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে, তুমি কবে আসবে?"
_"এসে কী করবো? হাতে টাকাপয়সা নেই ।"
_"টাকাপয়সা তো নাই বুঝি, তবু আসতে তো হবেই । না আসলে তো-আর হবে না ।"
_"আচ্ছা সম্বন্ধটা আনেছে কে শুনি? আর ছেলের দাবিদাওয়া কী?"
_"দাবিদাওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনও কথাবার্তা হয়নি । আর ঘটক হলেন, তোমার পরিচিত বন্ধু রহিমউদ্দিন ।"
_"ওহ! আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে আর কোনও অসুবিধা হবে না ।"
_"সুবিধা অসুবিধা পরে দেখা যাবে, আগে তুমি বাসায় আস । তুমি আদলে ছেলেদের বাড়ি যাতে হবে, তাদের অবস্থাও দেখতে হবে । একটামাত্র মেয়ে, দেখে শুনে দিতে হবে ।"
_"সামনে ঈদ, ছুটি চাওয়াটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে । মনে হয় ছুটি পাওয়া যাবে না, চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে । এ ছাড়া আর উপায় নাই, তারপরও দেখি কী করা যায় ।"
_"ছুটি না পেলে প্রয়োজনে চাকরিই ছেড়ে দিয়ে চলে আস । তোমার চাকরি অনেক জায়গায় হবে, করতেও পারবে । কিন্তু মেয়ের জন্য ভাল ঘর পাওয়া অনেক কঠিন হবে ।"
_"ঠিক আছে, তুমি এখন রাখ, আমি মালিকের সাথে আলাপ করে কাল জানাচ্ছি । হয়ত ছুটি, নাহয় চাকরি ইস্তফা ।"

ভাবছে স্বপ্নার বাবা, কী করা যায়? সামনে ঈদ, ছুটি চাইতেও ভয় করে । তবুও যে চাইতে হয়, যেহেতু মেয়ের বিয়ের ব্যাপার । স্বপ্নার বাবাকে যিনি চাকরি নিয়ে দিয়েছে তার সাথে আলাপ করল ।
তিনি বলল, "চাকরির দরকার হলে পরেও নিতে পারবেন, মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব বারবার আসবে না । আগামীকাল আমি মালিকের সাথে আলাপ করে আপনাকে যানাচ্ছি । টেনশন করবেন না, এখন মিলে চলে যান । একটা ব্যবস্থা তো করতে হবেই, হয়ত ছুটি, নাহয় চাকরি...।"
স্বপ্নার বাবার সেদিন রাতে আর ঘুম আসেনি, শুধুই চিন্তা আর চিন্তা । চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাসায় গেলে আর কী হবে? টাকা পাবো কোথায়? কে দিবে মেয়ের বিয়ের টাকা? এমন হাজার প্রশ্ন স্বপ্নার বাবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পরেছে স্বপ্নার বাবা । পরদিন সকালে স্বপ্নার বাবার চাকরি দাতা মিলে এসে মালিককে সব বুঝিয়ে বলে । মালিকের এক কথা, "বাবু যদি যায়, তাহলে তার পরিবর্তে আরেকটা লোক দিতে হবে ।"
চাকরি দাতা মালিকের কথায় সম্মতি দিলেন, স্বপ্নার বাবা ছুটি পেলেন ।

স্বপ্নার বাবা বাসায় আসলেন, স্বপ্নার মায়ের কাছে বিস্তারিত শুনলেন । স্বপ্নার মা বললেন, "তুমি এক্ষুনি গিয়ে রহিম দাদার সাথে দেখা করো ।"
স্বপ্নার মায়ের কথামত রহিমউদ্দিনের সাথে দেখা করে বিস্তারিত শুনলেন । ছেলের কথা জিজ্ঞেস করলেন স্বপ্নার বাবা, "ছেলেটা এখন কোথায়?"
প্রত্যুত্তরে ঘটক রহিমউদ্দিন বললেন, "দাদা, ও-তো আরও দুইদিন আগেই বাড়ি চলে গেছে ।"
স্বপ্নার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, "তার কারণ?"
ঘটক বললেন, "কারণ বলতে এতটুকুই জানি, ছেলেটা এখানে এসাছে ওর বাবার সাথে রাগ করে । আর এখানে যেই চাকরিটা পেয়েছে, তা দিয়ে ওর চলবে না । আবার আপনার মেয়েকে ওর পছন্দ হয়েছে, এখন বাড়ি সবাইকে ম্যানেজ করতে হবে । তাই চাকরি ছেরে চলে গিয়েছে ওর বাবা-মাক ম্যানেজ করতে । আমাকে ওর ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছে যোগাযোগের জন্য । প্রয়োজন হলে ছেলের ফোন নম্বর নিয়ে কথা বলতে পারেন ।"

ঘটকের কথা শুনে স্বপ্নার বাবা বললেন, "ফোন নম্ব্রের দরকার কী? যা বলার তুমিই বলবে । আমার মেয়ে আর তোমার মেয়ে তফাত কিসের? তোমার মেয়ে মনে করে তুমিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে । তবে হ্যাঁ, তুমি তো আমার আর্থিক অবস্থা পুরোটাই জান! সেভাবেই ছেলে পক্ষকে ম্যানেজ করলেই হবে ।"

স্বপ্নার বাবার কথামত ঘটক রহিমউদ্দিন ছেলে পক্ষকে ম্যানেজ করে ফেলেছে । তাদের দাবিদাওয়া বলতে কিছুই নাই, শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার কাজটা শেষ করে দিতে হবে । একদিন ছেলের বাবা আর ছেলের ভগ্নিপতি আসলেন । স্বপ্নাকে দেখে সোনার আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেলেন । স্বপ্নার বাবাকে তাদের বাড়ি যেতে বললেন । দিনতারিখ এখনো ঠিকঠাক না হলেও হবে ছেলেদের বাড়ি দেখার পর । ছেলেদের বাড়ি যাওয়ার দিনতারিখ ঠিকঠাক করে ফেললেন ঘটক রহিমউদ্দিন ।

স্বপ্নাদের বাড়ি থেকে ঘটক সহ যাবে তিনজন, স্বপ্নার বাবা, মামা । ছেলেদের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলা সদরের একটা গ্রামে । গ্রামের নাম কড়পাড়া, তা নারায়ণগঞ্জ থেকে ১৩৩ কিলোমিটার দূরে । ঘটক সহ স্বপ্নার বাবা, মামা যখন ছেলেদের গ্রামে যায়, তখন গ্রামের সবাই তাদের স্বাগত জানায় । তাদের সফরটা ছিল একদিনের মাত্র । বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করে পরদিন আবার তারা ফিরবে নারায়ণগঞ্জ । যেদিন ঘটক সহ স্বপ্নার বাবা কড়পাড়া গ্রামে গেল, সেদিনই একটু সময় করে পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখলেন । তাদের কাছে গ্রামটির দৈর্ঘ্যপ্রস্থের হিসাব জানা নাই । কিন্তু দেখে অনুমান করা যায়, গ্রামটি বিশাল আয়তকার ।

এই বিশাল গ্রামটিতে বসবাসকারী বাসিন্দা সবই হিন্দু ধর্মাবলম্বী । দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একটি পরিবারও এই গ্রামটিতে নেই । যা আছে সবই সংখ্যালঘু হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর পরিবারবর্গ । গ্রামটি ঘুরে দেখার উদ্দেশ্য হলো, ছেলের এবং ছেলেদের পারিবারিক সম্বন্ধে জানা । সবদিক দিয়েই ভালো গ্রামের মাস্টার পরিবারের ছেলে । খোঁজখবর নিয়ে স্বপ্নার বাবা সহ মামা এবং ঘটক রহিমউদ্দিনেরও পছন্দ হয়েছে ।

সেদিন রাতেই বসলো ছেলেদের বাড়িতে বিয়ে নিয়ে দেনদরবার । কোনো দাবিদাওয়া ছাড়াই পাকাপাকি হয়ে গেল, স্বপ্নার বিয়ের দিনতারিখ । বিয়ে হবে নারায়ণগঞ্জ, বরযাত্রী যাবে ৩০ জন । এই বুঝি স্বপ্নার বিয়ের ফুল ফুটেছে, এবার স্বপ্না হবে কড়পাড়া গ্রামের বধূ । মেয়েদের জন্মই পরের জন্য, নিয়মটা বেঁধে দিয়েছেন স্রষ্টা । মেয়েদের পরের ঘরে যাওয়ার একটা সময়ও আছে । সময়টা হয় তখন, যখন ফুটে বিয়ের ফুল ।

 

পূষ্প তথ্য উইকিপিডিয়া

ছবি সংগ্রহ গুগল

 

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ