ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের বছরেই বহু দূরের এক দেশে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অর্জন করে এক বিরল সম্মান। প্রায় অচেনা-অজানা সেই দেশ। বাংলাদেশের অনেক মানুষই হয়তো জানে না সেই দেশটির নামও। কিন্তু সে দেশের নাগরিকরা ঠিকই জানে বাংলাদেশকে এবং বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে। প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সিয়েরা লিয়ন সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাকে। এ রকম বিরল স্বীকৃতি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কম গৌরবের নয়।
সিয়েরা লিয়ন সরকার ২০০২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে পশ্চিম আফ্রিকার এ দেশটিতে বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হয়। সেখানকার দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকার মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলছেন, ভাব বিনিময় করছেন। কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পড়ানো হচ্ছে বাংলা ভাষা। জানা যায়, ইংরেজি ছাড়াও সেখানে আরো প্রায় ২০টি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে বাংলাও একটি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার এ এক বিরল অর্জন। দেশটির সরকারি নাম সিয়েরা লিয়ন প্রজাতন্ত্র। ‘সিয়েরা লিয়ন’ নামটি এসেছে স্পেনীয় ভাষা থেকে। এ নামের অর্থ সিংহীর পর্বত। আয়তনে দেশটি বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকের সমান অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬৯৯ বর্গমাইল। আর জনসংখ্যা ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৬১ লাখ ৯০ হাজার ২৮০।
দূরের এ দেশটিতে বাংলা ভাষা প্রবেশের ইতিহাস অনেকটা রূপকথার মতো। গল্পের শুরু এক যুগ আগে। এ গল্পের নায়ক একজন নন, অনেকেই। তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিয়েরা লিয়নে ১৯৯৯ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয় জাতিসংঘ। তখন বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ সিয়েরা লিয়নে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগ দেয়। বাংলাদেশ থেকে ৭৭৫ জন সেনাসদস্যের দলটি সিয়েরা লিয়নের দক্ষিণাঞ্চলে দায়িত্ব নেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে আরো সেনাসদস্য সিয়েরা লিয়ন যান এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ জন সেনা একত্রে সিয়েরা লিয়নে কর্মরত ছিলেন। এরপর আরো সেনাসদস্য যান সেখানে। সর্বমোট প্রায় ১২ হাজার সেনাসদস্য সিয়েরা লিয়নে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের সেনাদল তাঁদের নিয়মিত সামরিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আরো অনেক উদ্যোগ নেয়। দেশটিতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য বিবদমান বিভিন্ন জাতির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। তাঁদের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ওই সময়েই ঘটতে থাকে ভাষার আদান-প্রদান। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সেনাসদস্যরা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকেন। বাংলা ভাষার প্রতি ধীরে ধীরে আগ্রহ প্রকাশ করেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা বাংলা ভাষা বোঝার চেষ্টা করেন। পরে অনেকেই ভালোবেসে ফেলেন বাংলা ভাষা।
ওই সময় বাংলাদেশি সেনারা বিভিন্ন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও মেরামতের কাজ করেন। বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয়দের বাংলা অক্ষরজ্ঞান দেন। সহজে রপ্তযোগ্য ভাষা হিসেবে, সেখানকার অনেক মানুষ বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। অনেকে তা আয়ত্ত করে অতি সহজে খুব স্বল্প সময়ে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকেন। স্থানীয়রা বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বাংলায় কথা বলতে শিখে যান। বিভিন্ন সভায় স্থানীয়রা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেন। তখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের বাঙালি নাচ ও গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সেনাদলের আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের ফলে সিয়েরা লিয়নে বাংলা ভাষা একপর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয়রা কাজ চালানোর মতো বাংলা ভাষা শিখে যান। এর ফলে সিয়েরা লিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে দেশটির অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে সিয়েরা লিয়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কাব্বা ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে সময় বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিয়নের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কথা হয়। এর পর প্রাথমিকভাবে দেশটির পুনর্গঠনে ও শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। আশা করা যায়, বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিয়নের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধ হলে দেশটিতে বাংলা ভাষা প্রাধান্য বিস্তার করবে।

লেখাটি দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকা থেকে কপি করা

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ