১৫ মার্চ ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। আজকের এই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিটি অন্যান্য দিনের চেয়ে আরও বেশি জোরালো হয়ে ওঠে। এমন পরিবেশ পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকারীদের বহুগুণ উৎসাহিত করে তোলে। পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী গ্রাম ও মহল্লায় শুরু হয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন।
এদিকে দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা সংশ্লিষ্ট দফতরের নির্দেশ উপেক্ষা করে কর্মবিরতি পালন করেন। অফিস-আদালতেও চলে পূর্ণ কর্মবিরতি। এমন এক উত্তাল দিনের বিকেল বেলায় পাকিস্তান বাহিনীর প্রায় সকল জেনারেলকে নিয়ে কঠোর সামরিক প্রহরায় ঢাকায় আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। যখন ইয়াহিয়া ঢাকার মাটিতে পা রাখেন, তখন সামরিক বাহিনীর নয়া বিধি জারির প্রতিবাদে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সমাবেশের ডাক দেয়। বায়তুল মোকাররমের পাশে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ। জনসমাবেশ থেকে আহ্বান জানানো হয় সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার। ওই সমাবেশে বক্তারা সমস্বরে ঘোষণা দেন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাঙালীর ওপর সামরিক বিধি জারি করার ক্ষমতা কারও নেই। দেশের জনগণ তাদের মুক্তির আন্দোলনের নেতা, পরম বন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবের নির্দেশই মেনে চলবে। পৃথিবীর কোন শক্তিই বাঙালীর স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে পারবে না উল্লেখ করে বলেন, গত ২৩ বছর যারা সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছে, তাদের সঙ্গে আর কোন আপোস করা হবে না।
ইয়াহিয়া ঢাকায় আসার পর কোন সাংবাদিক কিংবা বাঙালীকে এ সময় বিমানবন্দরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিমানবন্দর থেকে ইয়াহিয়া আশ্রয় নেন প্রেসিডেন্ট হাউসে। তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিলেন ১৮ পাঞ্জাব ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়ন। আন্দোলনকারীদের উৎসাহ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে এইদিন নগরীর মোড়ে মোড়ে উদীচী ভ্রাম্যমাণ ট্রাকযোগে গণসঙ্গীত ও পথনাটক পরিবেশন করে। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীরা পরিবেশন করেন দেশাত্মবোধক গান। এ সময় বসে ছিলেন না নারী নেতৃবৃন্দ। কবি সুফিয়া কামাল ডাক দেন নারী সমাবেশের। তোপখানা রোডে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সুফিয়া কামাল নিজেই। মিছিল শোভাযাত্রা বের করে বেসামরিক কর্মচারী ও চিকিৎসকরা। অন্যদিকে খুলনার শহীদ হাদিস পার্কের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং জাতীয় সরকার গঠন করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে আতাউর রহমান খান বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ বঙ্গবন্ধুর পেছনে একই সঙ্গে রেডিও, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী, সেক্রেটারিয়েট প্রভৃতি আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবাহী।
এদিকে ১৫ মার্চ করাচীতে সংবাদ সম্মেলন করেন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি বলেন, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলের নেতার ভূমিকা পালন করতে চাই না। কেননা এতে দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তান সব সময়ই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙালীদের দ্বারা শাসিত হতে থাকবে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রযোজ্য হতে পারে না। কেন্দ্রে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে অবশ্যই তা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে করতে হবে। তার মতে দেশ শাসনের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ইচ্ছার মূল্য দিতে হবে। এদিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ওয়ালী খান সাংবাদিকদের বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের আর কোন অস্তিত্ব নেই। ১ জুলাই থেকে এখানে চারটা পৃথক প্রদেশ হয়েছে। ভুট্টোর দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে পেশোয়ার আইনজীবী সমিতির সভায় আসগর খান বলেন, বর্তমান মুহূর্তে শেখ মুজিব দেশের দুই অংশকে একত্রে ধরে রেখেছেন। সংখ্যাগুরু দলের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রসম্মত। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনে দেয়া ভুট্টোর বক্তব্যের পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে পৃথক বিবৃতি দেন পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটির রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
লেখাটি দৈনিক জনকণ্ঠের এই লিংক থেকে নেয়া 

১৬ মার্চ ১৯৭১
একাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইন প্রত্যাহার, বাঙালীদের ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকা- বন্ধসহ বিভিন্ন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এর জোরাল প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবি করেন। লাখো বাঙালী হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে বঙ্গবন্ধু অংশ নেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে। সকাল থেকেই উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠকের ফলাফল কি হয় তা জানতে। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া বৈঠকটি শেষ হয় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক চলছে, অন্যদিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্দোলন-সংগ্রামে পুরো পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পহেলা মার্চ থেকেই পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ হারায় বাংলাদেশের। সামরিক জান্তাদের কোন আদেশ-নির্দেশই মানছে না বীর বাঙালীরা। একমাত্র সেনাছাউনি ছাড়া পাকিস্তানের অস্তিত্বই ছিল না কোন জায়গায়। বরং পুরো বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, শহর-বন্দরে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা।
পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আলোচনার জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করলেও ভেতরে ভেতরে সামরিক জান্তারা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। কেননা সামরিক জান্তা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোস করবেন না। তাই আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ভেতরে ভেতরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গোপনে সারাদেশেই অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
রক্তাঝরা একাত্তরের এদিন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনার পাশাপাশি সারাদেশে আন্দোলন বাঁধভাঙ্গা রূপ নিয়েছে। রাজপথ মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত করে সাধারণ মানুষজনও দেশের উদ্ভ’ত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্তব্যের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এরই মধ্যে ৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা নিয়ে তোলপাড়।
সারাদেশের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ। সব সরকারী ভবন, হাটবাজারী এমনকি পাড়া-মহল্লায়ও উড়ছে প্রতিবাদের কালো পতাকা। কোথাও কোথাও বাংলাদেশের নতুন পতাকাও উড়তে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। সব বয়স সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠে-ময়দানে তখন গণসঙ্গীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন। হাইকোর্টের আইনজীবী, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতে থাকেন।
সুত্র ঃ দৈনিক জনকণ্ঠ 

১৭ মার্চ ১৯৭১
‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম/ চলবেই দিনরাত অবিরাম’- এ রকম অনেক উদ্দীপনামূলক গান টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে। সে ছিল আশ্চর্য এক জাগরণের কাল। সকল বাঙালীর চেতনা স্থির ছিল একটি মাত্র লক্ষ্যবিন্দুতে- যার নাম স্বাধীনতা।
একাত্তরের উত্তাল এই দিনে পাকিস্তানের উর্ধতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। খোদ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করে নিশ্চিত হন এ অংশে কার্যত পাকিস্তানের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনেই চলছে সবকিছু। স্বাধীনতার প্রশ্নে বীর বাঙালীর অকুতোভয় সংগ্রাম আর রণপ্রস্তুতিতে পাক প্রেসিডেন্টের বুঝতে বাকি থাকে না পাকিস্তানের অখ-তা আর রক্ষা করা সম্ভব নয়।
তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের পথ নেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। প্রতিটি বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন। ফলে পাকি সামরিক জান্তা ভেতরে ভেতরে বাঙালী নিধনযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামকে ভন্ডুল করার জঘণ্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করা হয় বাংলাদেশে।
একাত্তরের উত্তাল মার্চের এদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন মুক্তিপাগল হাজারো বাঙালী। সেদিন দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে শুভেচ্ছা জানাতে আসা স্বাধীনতাকামী বাঙালীর উদ্দেশে জন্মদিনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কামনা জনগণের সার্বিক মুক্তি।” ঠিকই বঙ্গবন্ধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতার লালসূর্য। হন বাঙালীর মুকুটমণি, জাতির পিতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
সুত্র : দৈনিক জনকন্ঠ

মার্চ ১৯৭১ – আগুন ঝরা সেই দিনগুলো-৭


0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ