মধ্যবিত্ত ।

বায়রনিক শুভ্র ৮ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ০১:৫৪:৩৭অপরাহ্ন গল্প ১০ মন্তব্য

কার সাথে কখন ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় তা আগে থেকে বলা যায় না । শত্রুতা হয়ত বলে কয়ে হয় । কিন্তু ভালো সম্পর্ক,মনের প্রতি মনের টান বর্ষাকালের বৃষ্টির মত,সিগন্যাল না দিয়েই ঝরঝর করে নামতে থাকে । হিল্লোল দার সাথেও আমার একইভাবে হুট করে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় । কিছু মানুষ থাকে যাদের দেখলেই আপন মনে হয়, হিল্লোল দাও সেরকম। ওনাকে দেখেই মনে হয়েছিল এনার সাথে আমার জমবে । তিনি আমার প্রতিবেশী বিভাগের বড় ভাই ছিলেন । প্রতিবেশী বিভাগ বলতে আমার ডিপার্টমেন্ট আর তার ডিপার্টমেন্ট পাশাপাশি ছিল । আমি যখন প্রথম বর্ষে তিনি তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ার । এরপরও দুজনে একটা বন্দুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিলাম । ঠিক বন্ধু না,এক অর্থে অভিভাবক,সেই সাথে বন্ধুও ।

একটা সময় কলেজে অনেক আড্ডা দিয়েছি ওনার সাথে । ওনার মেসে,হস্টেলে ওনার রুমে অনেক সময় কাটিয়েছি । এক সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া,রাত জেগে যাত্রা দেখা,বিয়ের দাওয়াতের নাম করে সারারাত আড্ডা দেওয়া সবই চালিয়েছি দুজনে মিলে । ওনার গাল ভরা হিল্লোল নামটাকে আমি ছোট করে হিলু দা বানিয়ে ফেলেছিলাম,এবং আমার দেখাদেখি ওনার কলেজের বন্ধুরাও ওনাকে হিলু নামে ডাকা শুরু করে দিয়েছিল । হিলু দা একদমই সাদামাটা ছিলেন । ওনার প্রতি আমার আগ্রহ পাকাপোক্ত হয়েছিল ওনার বইয়ের কালেকশন দেখে । দাদাটা অনেক গল্পের বই পড়ত এবং ভালো সম্পর্কের সুত্রে ওনার কাছ থেকে বই ধার এনে পড়তাম । তখন আমি হুমায়ূন প্রেমী, কিন্তু দাদার কাছে হুমায়ূন আহমেদ এর কোন বই ছিল না । উনি পড়তেন সুনীল,সমরেশ,শিরসেন্দু,হুমায়ূন আজাদের বই । মূলত হুমায়ূন জ্বর কাটানোর জন্য হিলু দার ভুমিকা অনেক । হুমায়ূন গন্ডির বাইরে এসে আমি খুজে পেয়েছিলাম এক বিরাট সাহিত্য সাগর,যাতে আমি এখনও হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছি ।

আর হিলু দার ছিল একটি চমৎকার একটা গার্লফ্রেন্ড;খুবই রূপবতী এবং মেধাবী । রুমকি দি । রুমকি দি আমাকে ভাই ডেকেছিল,আর এই সুত্রে হিলু দার বন্ধু মহলে আমার “শালা” হিসাবে বেশ নাম ডাক ছিল । একটা সময় হিলুদা এবং রুমকিদির সম্পর্কের প্রায় সব খুটিনাটি আমি জানতাম । হিলুদার ফোন বন্ধ থাকলে রুমকিদির জন্য দাদাকে খুজে বের করা আমার অন্যমত দায়িত্ব ছিল তখন , আবার হিলু দার অপরাধে রুমকি দি যখন রাগ করে গাল ফোলাত তখন রুমকি দির পা ধরে দাদার হয়ে মাফ চাওয়াটাও আমার দায়িত্ব ছিল । বর্ষার দিনে বা শীতের সকালে কলেজের কোন কোণায় বসে আমরা তিন জনে অনেক আড্ডা দিয়েছি । আমাকে দুজনে ছোট ভাইয়ের মতই দেখত । আমি উপস্থিত থাকা অবস্থায় এই দুজনের রোমান্টিকতায় কোন আড়ষ্টতা আসত না । ফলে ওনাদের মিট করার দিনে আমার উপস্থিতি অবসম্ভাবি ছিল । রুমকি দি খুলনা থেকে গোপালগঞ্জ আসলে আমার ডিউটি ছিল হিলু দা আর রুমকি দি কে নিয়ে গোপালগঞ্জের আনাছে কানাছে ঘুরে বেড়ানো । আরেকটা বিষয় ছিল,গোপালগঞ্জ প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয় । এখানে চিপায় বসে গাজা খাওয়া যায়,জনসম্মুখে একজনের মাথা ফাটিয়ে দেয়া যায়,ইভ টিজিং করা যায় কিন্তু প্রেমিকার সাথে পাশাপাশি হেটে গেলেও খুব বড় অপরাধ হয় । যেহেতু আমি স্থানীয় ছেলে তাই আমি থাকলে দুজনে নিরাপদ থাকত । এই কারণেও ওনারা সাধারনত আমাকে সাথে রাখতেন । এই দুজনের রসায়ন দেখে আমার মনেও স্বপ্ন দানা বেধে উঠেছিল , যা একসময় মহীরুহ ধারন করে । তবে সে গল্প আজ থাক ।

দাদা এম এ পরীক্ষা দিয়েই ঢাকা ছুটলেন আর আমার সাথেও ওনার যোগাযোগ কমতে থাকল । এবং এক সময়ে যোগাযোগ পুরাই বন্ধ হয়ে গেলো । মাঝে একবার চাকরী পাওয়ার খবর টা ফোন করে দিয়েছিলেন । তবে ফেসবুক সুত্রে ওনার খবরাখবর পাই,আমার পোস্টেও উনি নিয়মিত লাইক কমেন্ট করেন ।

আজ সকালে অনেক দিন পর হুট করে ওনার সাথে দেখা । আমি হেটে যাচ্ছিলাম হঠাৎ ফোন দিয়ে বললেন, “পিছনের দিকে তাকা” । অনেকদিন পর দেখা আমি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম । স্বাভাবিক ভাবেই কেমন আছেন?গোপালগঞ্জ কবে আসলেন?কতদিন থাকবেন?বাড়ির সবাই কেমন আছে?আপনার পোস্টিং এখন কোথায়? বৌদি কই?বিয়া করবেন কবে? ইত্যাদি সাওয়াল জবাব পর্ব চলল প্রথমে । কিন্তু শেষ প্রশ্ন দুইটির জবাব উনি দিলেন না ।

আমি ২য় বার জিজ্ঞাস করার পর বললেন,আয় চা খাই । খেতে খেতে কথা বলব । বসলাম লেকের পাশে এক চায়ের দোকানে । ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম উনি পুরা মাত্রায় অন্যমনস্ক । আগের তুলনায় হাজার গুণ স্মার্ট হলেও কোথাও একটা খটকা লাগছিল । এবার বেশ সিরিয়াস ভাবেই জিজ্ঞাস করলাম, “ঘটনা কি বলেন তো” । জবাবে কিছু সময় চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পরিবার,চাকরী,প্রেম নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি” । আমি বললাম,চাকরীতে ঝামেলা টুকটাক থাকে । কিন্তু পরিবারে কি সমস্যা ??? আপনারা মাত্র ৩ ভাই বোন,বড় ভাই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে । আপনার বাবা-মা দুজনেই সরকারী চাকরী করতেন । এখন আপনি নিজেও একটা ভালো চাকরী করেন । তাহলে সমস্যা কোথায় ?? আর বিয়ে করলেই তো প্রেমের ল্যাঠ্যা সব চুকে যায় ।

জবাবে উনি বললেন, “বিয়ে টা করতে পারছি কই?? আর মাত্র ৩ ভাই বোন এটাই এখন সমস্যা” । আমি বললাম, “আপনার কথা তো কিছুই বুঝলাম না” । উনি বলতে শুরু করলেন, “আমার বড় ভাই তার নিজের পছন্দে পরিবারের অমতে ১৬ বছর আগে বিয়ে করেছে । ছোটবোনের বিয়ের আগে বাড়ি থেকে সব মেনে নিয়ে একসাথে বসবাস করছি । বোনটা স্বামির সাথে বিদেশে থাকে । এদিকে বৌদির সাথে মা-বাবার ঝগড়া লেগেই থাকে । কোনভাবেই এরা মিলেমিশে থাকতে পারছে না । একসময় ভাবতাম বাবা-মায়ের দোষটাই হয়ত বেশি । কিন্তু নিজে ৩/৪ দিন বাড়িতে থেকে যা বুঝলাম বৌদির সব সময়েই চেষ্টা থাকে বাবা-মাকে অপমান করার । বৌদি আবার চাকরীজীবী,মানে সাংসারিক সব কাজ করতে হয় মাকে । এদিকে আমার দাদা যে কোন পক্ষে তা বোঝা মুশকিল । মানুষের সামনে বৌ কে শাসনের চেষ্টা করলেও ঘরে ঢুকে বৌয়ের পা ধরে । বৌদির আচরণে বাড়িতে কেউ টিকতে পারছে না । সব চেয়ে যন্ত্রণায় আছে বাবা-মা । ঘর সংসার সব কিছুই তাদের,অথচ শান্তি নেই কোথাও । তারা না পারছে সংসারে থাকতে না পারছে কোথাও চলে যেতে । বুড়া বয়সে সামান্য কোন সেবাও কারো কাছ থেকে ওনারা পাচ্ছে না । বাড়িতে আসার পর থেকে এসব নিয়ে খুব অশান্তি তে আছি । কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না” ।

সব শুনে আমি বললাম, “আপনি বিয়ে করে আলাদা বাসা নিন,তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যায়” । জবাবে দাদা বলল, “তাতে ঝামেলা আরও বাড়বে । তুই তো জানিস রুমকি তো বেকার থাকবে না । সেও পড়া শেষ হলেই চাকরী তে ঢুকবে । মায়ের যে কষ্ট তা তো থেকেই যাবে । এদিকে আগা গোঁড়া আমার পরিবার রুমকিদের পরিবারকে পছন্দ করে না । কেন করে না সেটাও জানিস । এখন যদি রুমকিকে বিয়ে করতে হয় তাহলে আমাকে বাবা-মাকে ছেড়ে রুমকি কে নিয়ে একা সংসার করতে হবে । কারণ আমার পরিবার ওকে কোনভাবেই মন থেকে গ্রহন করবে না । আমার তবু রুমকি আছে কিন্তু বাবা-মার আর কে আছে ?? তারা কোথায় যাবে বল” ??

আমি বললাম, “আপনি কাকা-কাকিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন,ওনারা শিক্ষিত মানুষ,বুঝালে কি বুঝবে না ??রুমকি দিদি তো কোন দিক দিয়েই খারাপ না। আর ওনার মত ভালো মেয়ে তো আপনি খুজেও পাবেন না আরেকটা।” জবাবে দাদা বললেন, “সবই আমি জানি আর বুঝিও । দ্যাখ আমার জন্ম গ্রামে । এদিকে রুমকিদের ছোট শহুরে পরিবার। ও হয়ত এডজাস্ট করার চেষ্টা করবে , কিন্তু সরাসরি এরকম একটা বড় পরিবারের ভার কি নিতে পারবে ?? পারবে না । অন্যদিকে রুমকিদের সাথে আমাদের পারিবারিক ঝামেলা । মা-বাবা কি আমাদের এই বিয়েতে শান্তি পাবে ?? তারা আমার কথা ভেবে হয়ত রুমকিকে মেনে নেবে কিন্তু মানসিক শান্তি পাবে না । বড় ভাই তাদের কষ্ট দিয়েছে,আমিও যদি তাদের কষ্ট দেই তাহলে এই বয়সে তাদের কি কোন দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে ?? তুই তো জানিস আমার আর রুমকির সম্পর্কটা কত গভীর । ওকে ছাড়া বাচতে হবে এটা কোনদিন ভাবি নি । কিন্তু এখন আমি কি বেছে নেবো ? মা-বাবা নাকি রুমকি ? তুই বলে দে” ।

সব শুনলাম । বুঝলামও । কিন্তু দাদাকে কি জবাব দেবো কিছুই বুঝতে পারলাম না । উঠে আসার সময় দাদা শুধু বলল “বুঝলি শুভ্র আমি হেরে গেলাম” । যে কোন একদিক আমাকে ছাড়তেই হবে । আবার যার কোনটাই ছাড়াই আমার চলবে না ।

 

(গল্প নিছক গল্পই)

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ