প্রারম্ভিক কথা: আজকের লেখাটি অনেকের ইগো তে লাগতে পারে। তার জন্য আমি দু:খিত নই। বরং নিজেদের ভুল করে করা অনেক বড় পাপ যদি ধরতে পারেন, সেজন্য অন্ত:ত মনেমনে দু:খিত হতে পারেন।

.....

.....

যেই না মাগরিবের আজান, সাথে সাথে দৌড়ে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা। চা বিস্কুট বা অন্য কোন নাস্তা। রাত ৯টার মধ্যে খেয়ে টিভি দেখতে বসা। টেবিলের সামনের দেয়ালে বিশ্ব আর বাংলাদেশের মানচিত্র। আর ঘরে এলুমিনিয়ামের স্ট্যান্ড আর মুখ দিয়ে ফুলিয়ে ছিপি দেয়া মোটা পলিথিনের গ্লোব। এই ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জীবন।

বিকেলে ঠিক খেলতে যাবার সময় প্রাইভেট টিউটর। মনে হতো মেরে ফেলি! আরেকটু বড় হলে স্কুলে ২/১ বিষয়ে প্রাইভেট। শিক্ষার্থী খারাপ হলে স্যার গার্জিয়ান ডেকে বলতো ব্যাচে পাঠিয়ে দিতে। আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে বিনে পয়সাতেই পড়াতো স্যাররা। অন্যদিকে টাংকি মারতে অপরজন কোন স্যারের কাছে পড়ে তা জেনে পড়তে যাওয়া। চলে ক্লাস পালিয়ে সিনেমা দেখা।

মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েরা শলার ঝাড়ু মাস্তানী দেখাতো পরীক্ষার রেজাল্ট এবং পড়ার জন্য। সে সময়ের হয়ত একজনও মধ্যবিত্ত মা পাওয়া যাবে না, যে তার ছেলেকে রিক্সা চালিয়ে ভাত খেতে হবে আর মেয়েকে রিক্সাওলার বউ হতে হবে বলে ফাপড় দেয় নি। আবার পরীক্ষার সময় জানতে চাইতো কয়বার রিভিশন হয়েছে।

এলাকায় ফার্স্টকে মূল্য দিলেও লাস্টকে হয়ত মজার ছলে বলতো, এমন হইলে চলবো! এখন থেইক্যা ঠিকমতো পড়ালেখা করবা। বাপ-মায়ের ইজ্জত রাখতে হইব না! আর কোন শিক্ষিত মেহমান আসলেই মায়েরা বিচার দিতো, ঠিক মতো পড়ালেখা করে না! ফেল করবো। কিছু বলে দেন তো!

৯০ এর মাঝামাঝি কিন্ডারগার্টেন জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। আর ২০০০ পরবর্তীতে বাচ্চাদের বিশেষ যত্নের নামে বইয়ের বোঝা। তৎকালীন অভিভাবকদের এতটাই মগজ ধোলাই হয়ে যায় যে, বাচ্চাকে মেশিন বানানোর প্রতিযোগীতা শুরু করে। এক সময় মায়েরা (কোনভাবেই কর্মজীবি/চাকুরীজীবি মায়েদের বোঝানো নয়) স্কুলের মাঠে বসা শুরু করে। আলাপ ‘সাচ ভি কাভি বহু থি’ সিরিয়ালের থেকে শুরু করে অমুক ভাবি এত গাঢ় লিপস্টিক কেন পড়েছে এখানে গিয়ে শেষ হতে থাকলো। স্কুলগুলো প্রাইভেট নয়, স্পেশাল ক্লাসের নামে বাড়তি আয় শুরু করে। আর বাবা-মায়েরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকেন। বাচ্চাদের সঠিক শাসনে রেখে মানুষ করার চাইতে স্কুলের বইয়ের বোঝা আর প্রাইভেটে মধ্যবিত্ত অভিভাবকেরা বেশী আগ্রহী হয়ে উঠে। এ যেন জীবন মরণের প্রতিযোগীতা। সচেতন দু একজন অভিভাবক এক্সট্রা ক্লাস বা অতি প্রেশারের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও, সংখ্যালঘু হবার প্রেক্ষিতে এক সময় দল বদলে ফেলে। ১০০ তে কেন ৯৫ পেল তা নিয়ে হা হুতাশ বাড়তে থাকে। বাচ্চাদের বেসিক জ্ঞান কমতে থাকে। সাধারণ জ্ঞানও। তারপর হাই স্কুলে শুরু হয় সব বিষয়ের প্রাইভেট পড়ানো (শিক্ষকরা সবচেয়ে দায়ী, সে গল্প আরেকদিন)। জমজমাট হতে থাকে শিক্ষকদের প্রাইভেট ব্যবসা। অথচ অভিভাবকের এত টাকা কিভাবে আসছে তা থাকে প্রশ্নের বাইরে। মধ্যবিত্ত অভিভাবক কতবার রিভিশন হলো তা জানার চেয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কোথায় পাওয়া যাবে, তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের সাথে গল্প-ছড়া-খেলাধুলার নির্মল বিনোদনের চেয়ে গ্যাজেট দিয়ে অভিভাবকরা গর্বিত, আমার বাচ্চাটা তো মোবাইলের সব জানে! বাংলা ঠিক মতো বলতে-পড়তে না জানলেও চলবে। বাচ্চা সব জানে। শুধু জানে না দেশের কথা, জানে না তার শৈশব-কৈশোর চুরি করেছে বাবা-মা!

প্রতিযোগীতার এই ইঁদুর দৌড়ে সন্তান হারায় তার বাল্যকাল এবং শৈশবের আনন্দ। আমাদের বয়সে এসে তারা জীবনের গল্প বলতে গেলে কিছুই খুঁজে পাবে না, যা আনন্দের। হয়ত বাবা-মার চোখ এড়িয়ে ইয়াবা আর রুম ডেট এর গল্পটাই থাকবে।

৯০ এর মধ্যবিত্ত তরুণদের (আজকের অভিভাবক) হাত ধরে বৃদ্ধাশ্রমের যাত্রা শুরু। সম্পর্কের অধ:পতন, সামাজিক বিচ্ছেদ আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের দূরত্ব আজ বৃদ্ধাশ্রমকে করেছে জমজমাট। এই সবই সেই ইঁদুর দৌড়ের ফল। তাহলে আজকের বাচ্চারা যখন বড় হবে, তখন কেমন হবে বাংলাদেশ!

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ