ভালবাসি অহর্নিশি

ঐন্দ্রিলা অণু ৪ ডিসেম্বর ২০১৩, বুধবার, ১১:৪৪:০৩অপরাহ্ন গল্প ১৭ মন্তব্য

:কি মামনি, আর কত পড়বে???।এবার একটু উঠো তো।চেহারার কি হাল করেছো? এসো চুল টা বেঁধে দিই....গভীর মমতা নিয়ে বললেন রাহেলা বেগম।
:আম্মু প্লিজ আমাকে এই চ্যাপ্টার টা শেষ করতে দাও।জানোই তো লাস্ট পেপার, পরীক্ষা টা ভাল হতেই হবে....আদুরে গলায় বলল অহনা।
:ঠিক আছে,একটু পর আবার আসব।তুমি ততক্ষনে চ্যাপ্টার টা শেষ করো।
:ওকে আম্মু।
রাহেলা বেগম চলে আসতে আসতে একবার ফিরে তাকালেন অহনার দিকে।মেয়েটা কি সুন্দর হয়েছে দেখতে! তার ঘরে যেন ডানাকাটা পরী নেমে এসেছে।কবে যে মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেলো ভেবেই পেলেন না রাহেলা।ভাবতেই হঠাৎ এক ভয় এসে ভর করলো রাহেলাকে।অহনা যদি কখনো জানে সে আশরাফ সাহেব আর রাহেলা বেগমের পালিতা কন্যা তাহলে কি হবে!
রাহেলা মনে মনে ঠিক করলেন,নাহ কক্ষনো অহনাকে জানতে দেয়া যাবে না এই সত্য।এতোটা বছর যেভাবে তিনি এই সত্য কে চাপা দিয়ে এসেছেন,তেমনি বাকিটা জীবন এভাবেই সত্যটা লুকিয়ে যাবেন।হ্যাঁ,তাকে লুকাতেই হবে।

এদিকে অহনা খুব খুশি, কাল তার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা। আব্বু আম্মুকে সে জানাবে তার আর অর্নবের সম্পর্কের কথা।বাবা মা নিশ্চয় মানা করবেন না।অর্নব ঢাকা মেডিকেল থেকে সদ্য পাশ করা ডাক্তার, বেশ ভাল ফ্যামিলির ছেলে। বাবা মা খুশি ই হবে অর্নবের কথা শুনলে।লাস্ট চ্যাপ্টার টা শেষ করে অহনা তার ডায়েরী টা নিয়ে বসলো।এই ডায়েরী টা তার আব্বু তাকে এক জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলো।জীবনের বিভিন্ন স্মরনীয় ঘটনা সে ডায়েরী তে লিখে রেখেছে।যেমন-
*আমার খুব জ্বর হল সেদিন।কিচ্ছু খেতে পারছিলাম না।আমি খাইনি দেখে আব্বু-আম্মু ও না খেয়ে আছে।সারারাত আমার পাশে বসে থেকেছে।
*আজ আমি স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি।আব্বু আমাকে একটা সুন্দর কলম দিয়েছেন।সেটা দিয়েই লিখছি।
*আজ আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যাথা পেয়েছি।আব্বু আম্মুর সে কি অবস্থা আমার জন্যে।ডাক্তার আংকেল আসতে একটু দেরি হওয়ায় আব্বু ডাক্তার আংকেল কে খুব বকেছেন।মাঝে মাঝে খুব অবাক হই এরা দুজন আমাকে যেন একটু বেশি ই ভালবাসেন।আমার আব্বু আম্মু পৃথিবীর বেষ্ট আব্বু আম্মু।

আজ অহনা লিখল-
*কাল আমার শিক্ষাজীবন শেষ হচ্ছে।এত দূর এগুতে পারতাম না,যদি না দুজন খুব প্রিয় মানুষ আমার হাত ধরে না এগিয়ে নিতো। আব্বু আম্মু তোমাদের খুব ভালবাসি।খুব খুব বেশি।

পরদিন খুব সকালে আব্বুর জন্যে চা বানালো অহনা।অহনার আব্বু অহনার হাতের চা খেতে খুবই পছন্দ করেন।
:আব্বু!
:কি রে মা,তুই?। আমার জন্যে চা বানালি?। আজ না তোর পরীক্ষা?
:হ্যা আব্বু তো কি হয়েছে আমি আমার আব্বুর জন্যে চা বানিয়েছি।এতে পড়ার কোন ক্ষতি হয়নি।আমি ফুল প্রিপেয়ারড পরীক্ষার জন্যে।
:বাহ, দে চা দে দেখি কেমন হল আমার আম্মার চা।
:এই নাও।
:হুম,ফার্স্ট ক্লাস।তোকে সেরা চা রাঁধুনির মেডেল দিতে হবে দেখছি।অসাধারণ মা!
:মেয়ে কার দেখতে হবে না!
:হা হা হা.... হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো আশরাফ সাহেবের।তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখছেন,তার মেয়েকে।মাশাআল্লাহ,মেয়ে না যেন পরী।কেমন খিলখিলিয়ে হাসছে।আল্লাহ তাকে এই উপহার দান করেছেন নিশ্চয় কোন পূণ্যের বিনিময়ে,ভাবলেন আশরাফ সাহেব।
:এই আব্বু, কি হল?কি ভাবছ?
:কিছু না মা।
:আচ্ছা আমি রেডি হই,পরীক্ষার সময় হয়ে এলো।

অহনা রেডি হয়ে,আব্বু আম্মুকে সালাম করলো। আশরাফ সাহেব বললেন,
:মা তোর জন্যে আমার আলমারি তে একটা প্রেজেন্ট রেখেছি।নিয়ে আয় তো।
:প্রেজেন্ট!ওয়াও।থ্যাংক ইউ আব্বু।

অহনা দৌড়ে গেল আব্বুর রুমে।আলমারি খুলে ড্রয়ার খুলতেই দেখল, বেশ সুন্দর একটা কলম।কলম নিয়ে ফিরে আসতেই দেখল একটা ছোট্ট ডায়েরী।কি মনে করে সেটা খুলল,তাতে লিখা

'অহনা,আমার মেয়ে।আমার আর রাহেলার শুন্য জীবনের পূর্নতা আমাদের মেয়েটা। আল্লাহ্‌ র অশেষ রহমতে একদিন এক ষ্টেশনে পেয়েছিলাম আমাদের এই পরীটাকে।হয়ত আল্লাহর পাঠানো কোন ফেরেশতাই অহনাকে আমাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন। এই উপহারকে আমরা সর্বোচ্চ ভালবাসা দিয়ে বড় করব,হে পরওয়ারদিগার। শুকরিয়া।

মুখের রক্ত সরে গেল অহনার।তাহলে সে তার আব্বু আম্মুর মেয়ে না?।সে জন্মপরিচয়হীন??।কে তার বাবা মা?। খুব কান্না পেল অহনার।আব্বু আম্মুর ডাক শুনল।
:কি রে মা,প্রেজেন্ট পছন্দ হয়েছে?
:হ্যাঁ,আব্বু।
:কি হয়েছে মা?এমন লাগছে কেন তোকে?
আশরাফ সাহেব আর রাহেলা দুজনেই চিন্তিত।
:না,কিছু হয়নি।যাই
আশরাফ সাহেব আর রাহেলার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া রেখেই অহনা বেরিয়ে এলো।

পরীক্ষা শেষ। অহনা যাচ্ছে অর্নবের কাছে।সত্যটা সে অর্নবকে জানাবে।যাকে জীবনসংগী করবে তার কাছে কিছু লুকাবে না অহনা।
:অর্নব।
:হ্যাঁ অহনা বলো।কি হয়েছে?হঠাৎ এতো জরুরী তলব।
:অর্নব আমি তোমাকে ঠকাতে চাই না।কিন্তু সত্যটা তোমার জানা উচিত।
:কিসের সত্য?
:অর্নব, আমি আমার আব্বু আম্মুর পালিতা মেয়ে।তারা আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন।জন্মপরিচয়হীন একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে যদি তোমার আপত্তি থাকে, বলতে পারো।
:তুমি কিভাবে জানলে এই সত্য?
:আব্বু আম্মু আমাকে বলেন নি।তারা আমাকে যথেষ্ট ভালবাসেন। আমি তাদের কাছেই ফিরে যাবো।মানুষরূপী দুজন ফেরেশতা কে আমি কখনো একা ফেলে যাব না।কিন্তু তুমি কি আমাকে মেনে নিতে পারবে?
:অহনা,আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কে,কি তোমার পরিচয় সেটা মুখ্য নয়।মুখ্য হল,তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয়জন।যাকে ছাড়া আমি এই পৃথিবীতে সত্যি ই একা।আমি তোমার পাশে আছি।

***তখন সন্ধ্যা।অহনা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাতে একগুচ্ছ ফুল।কাল আব্বু আম্মুর বিবাহবার্ষিকী। তাদের এই ফুল দিয়ে উইশ করবে অহনা। আজ অহনা সত্যি ই খুব খুশি, ফেরেশতার মত বাবা মা,অর্নবের মত জীবনসংগী, এই সুন্দর পৃথিবী আর কি চাই।
এদেরকেই সে ভালবাসবে অহর্নিশি.....

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ লেখা

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ