: বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলে মেয়র পদে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি শওকত হোসেন হিরন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের প্রার্থী ছিলেন। তার পরাজয়ের নেপথ্যে বেশ কয়েকটি কারন রয়েছে। দ্বাম্ভিকতার আস্ফালন ! মাফিয়া স্টাইলের দাপট প্রদর্শন ! জাপা থেকে আ’লীগে ঠাঁই অত:পর ২০০৮ সালের ৪ আগষ্টের নির্বাচন পরবর্তী মেয়র শাসনামলে হিরন দলের ত্যাগী নিবেদিত তৃনমুল নেতা কর্মীদের চরমভাবে অবমূল্যায়ন করে। কখনো কখনো নানা কায়দায় অত্যাচার চালানোর দৃশ্যে রূপ নেয়।
একটি কথা রাজনীতির ময়দানে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে শওকত হোসেন হিরন আধনিক নগরী গড়ার পথ বেয়ে আসছিলেন। কৌশলী পন্থায় রাজনীতির ময়দানে হিরনের ব্যক্তি ইমেজ’র হিড়িক তোলা হয়। কিন্তু ব্যক্তি ইমেজ যে বাড়ছে না কমছে নাকি শুধুই নামকাওয়াস্তে চাউর ঘটানো হয়েছিল “ব্যক্তি হিরন ফ্যাক্ট”। এমন কথাও বাতাশে ছেড়ে দেয়া হয় যে দলের পরিচয়ের চেয়েও হিরনের নিজের ব্যক্তি ভোট ব্যাংকের পাল্লা ভারী। সুতারং চাটুকর রাজনীতিতে বিভোর থাকা হিরন ভাবতে পারেন নি তিনি বিশাল ভোটের ব্যবধানে হেরে যাবেন।
বিশেষ করে শওকত হোসেন হিরনের দ্বাম্ভিকতায় ভর করা, দলের ত্যাগী তৃনমুল কর্মীদের উপেক্ষা, আর্শিবাদপুষ্ঠ অরুন বরুন তরুন এই সিন্ডিকেটের ব্লাকমেইল,টেন্ডারবাজী, সাংবাদিক নির্যাতন, বেয়াদপীপনায় চরম উশঙ্খৃলতা আর চাটুকর রাজনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ার কারনে তার ললাটে জুটলো না স্বাধের মেয়রের চেয়ার। প্রথমে মোম্বাই শহরের ন্যায় আদলে বরিশাল সিটি সাজানো এরপর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহরে পরিনত করার শ্লোগানের প্রচারনায় মাতোয়ারা হয়ে উঠে হিরন । নির্বাচনী আচরন বিধিমালা ভঙ্গ করে বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন কালারের ব্যানার,ফেস্টুন, বিলবোর্ডে নগরী ছেয়ে ফেলে জানান দেয় “বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহরে” পরিনত করার শ্লোগান। প্রচারনায় বলা হয় হিরনকে পুনরায় মেয়র পদে জয়যুক্ত করলে পরিকল্পিত নগর উন্নয়নে এগুবে।
অন্যদিকে,নগরীর হোয়াইট কালার সন্ত্রাসীদের ব্যানার,ফ্যাস্টুন ও বিলবোর্ড সাটানোতে জনমনে হিরনের কর্মকান্ডের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রভাব পড়ে শওকত হোসেন হিরনের ছোট ভাই ডিস ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত মামুন মাহমুদের বেপরোয়া স্টাইলের টেন্ডারবাজীতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া। বড় ভাই মেয়র এজন্য ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনে মামুন মাহমুদ গড়ে তুলেন অপরাধ জগতের সিন্ডিকেট। যাকে বলা হয় আন্ডারওয়ার্ল্ড। ব্লাকমেইলের আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিসিসির সকল ক্ষমতার উৎসই ছিল যেন জাপা থেকে আ’লীগে আসা আবুয়াল হোসেন অরুন। দপ্তরে দপ্তরে অরুনের দাপট ছিল আপরাধ জগতের গ্যাংদের ন্যায়। দপ্তরের দায়িত্বশীলদের মারধর,লাঞ্চিতের ঘটনার জন্ম দেয়। সাজানো নাটকের মাধ্যমে ট্রাপে ফেলে অর্থ লুটে নেয়া, দক্ষিন বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষের ওপর চড়াউ হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় ঘটে যা ভোট ব্যাংকে আঘাত হানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর। সাংবাদিক নির্যাতনেরও কালো অধ্যায় সৃষ্টি করে হিরনের আর্শিবাদপুষ্ঠরা। দলের তৃনমুল ত্যাগী নিবেদিত নেতা কর্মীরা নিরব ক্ষোভে চোঁখের জলেও ভেসেছে। এরমধ্যে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন,ক্ষমতাসীন দলে থেকেও বিরোধী দলের চেয়েও খারাপ অবস্থানে পাড় করে সময়। উল্টো তাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের খড়গও নেমে আসে। হিরনের আশিবাদপুষ্ঠরা দলের একটি বৃহাৎশকে দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে। ছাত্রনেতা,যুবলীগ নেতা,আ’লীগ নেতাদের ওপর চড়াউ হয় অরুন বরুন তরুন সিন্ডিকেট। নগরজুড়ে হিরনের কাছে ভীড় করা পল্টিমারা নেতাদের কারনে একরকম জিম্মিদশায় কাটায় দলের জন্য নিবেদিতরা। দাপট প্রদর্শন চলে জাপা থেকে হিরনের হাত ধরে আ’লীগে আসা সুযোগ সন্ধানীরা। যারা শুধুই অর্থনৈতিক ফায়দা লুটতেই আ’লীগে ভীড় করে। এরা হিরনের আর্শিবাদপুষ্ঠ হয়ে যতসব বিতির্কিত কর্মকান্ডের জন্ম দিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। দলকে ঐক্যবদ্ধের বিপরীতে গ্রুপিং রাজনীতির জন্ম দেয়। দলের নীতি আর্দশের উল্টো রথে চড়ে অগাধ বিত্ত বৈভবের মালিক বনে যেতে নিজ দলের মধ্যেই রক্তের হেলিখেলায় মেতে উঠেছিলেন হিরনের আর্শিবাদপুষ্টরা। দলীয় প্রতিপক্ষ নিধনে গুলিবর্ষনের ঘটনা ঘটে। প্রতিবাদ করার জো নেই। রেহাই পেত না। নিরব ক্ষোভে বিরাজমান থাকে দলের নিবেদিত কর্মীরা। দলের মধ্যে থেকেই কথা উঠে এসব ন্যাক্কারজনক বিবেগবর্জিত কর্মকান্ডের কলকাঠি নাড়েন স্বয়ং শওকত হোসেন হিরন। এ যেন মুখোশ পরিহিত ভদ্রলোক। ক্লীনম্যান কখনো ফাটাকেষ্টের অভিনয় দেখালেও সেসব হিরনের মুখোশের আড়ালে মাফিয়াগিরিতে ভেস্তে যায়।
ওদিকে, বিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার পর বর্বরতার আচরন শুরু করে। সাজানো টোপে ফেলে সভ্য সমাজে অসভ্য আচরনের হুঙ্কার তুলে। বেপরোয়া! বেশামাল! হয়রনাীতে টালমাটাল হয়ে পড়েন হিরন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাজানো ফাঁদে ফেলে ফাঁসিয়ে দিতে ছকনুযায়ী চলেন। হয়রানীর বিষয়টি প্রভাব পড়ে নির্বাচনী ভোট ব্যাংকে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৫ জুনের নির্বাচনের দিনে পরাজয় ভেবে জাপার শাসনামলের জনমনের আতংক শওকত হোসেন হিরন প্রকাশ্যে নিজেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ঝাঁকুনি তুলেন। এতে আরো বিতির্কিত হন তিনি। কতটা নিকৃষ্টতম হলে প্রতিদ্বন্দ্বি মেয়র প্রার্থীর গায়ে হাত তুলতে পারে! কোন বিবেগবাগ মানুষই নির্বাচনের দিনক্ষনে হিরনের আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ভুমিকায় অবর্তীন হওয়াটা মেনে নিতে পারে নি। নির্বাচনের দিন দুপুর সোয়া দ্ইুটার দিকে হিরনের নিজের সন্ত্রাসী স্টাইল প্রদর্শনে হতবাক হন নগরবাসী। নগরীর লালাদিঘির পাড় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে হিরন নিজেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আহসান হাবীব কামালের ওপর চড় মারেন। একই সঙ্গে কিল ঘুষি মারেন বরিশাল ৬ আসনের সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান রাজনের ওপর। মুহুর্তেই নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে হিরনের এহেন টেরোরিজম। যা আ’লীগের সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও বিষয়টিকে জঘন্যতম বলে মন্তব্য করেছেন। হিরনের রাজনীতির কালো অধ্যায়ে যোগ হলো সন্ত্রাস প্রক্রিয়ার আরেক বর্বরতা। ফলে আঘাত হানে ভোট ব্যাংকে।
এদিকে, ভোটের হিসেব নিকেশে হিরনের বাসভন সংলগ্ন এলাকার কেন্দ্রেই আশানুরূপ ভোট পাননি তিনি। তুলনামুলক কম ভোট পেয়েছেন। বিপরীতদিকে হিরন তুলনামুলক বেশি ভোট পেয়েছেন বরিশাল আওয়ামী লীগের অভিভাবক খ্যাত,সাবেক চীফ হুইপ আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র কালিবাড়ি রোডস্থ বাসভবন সংলগ্ন দুটি কেন্দ্রে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে দ্বিগুন ভোট পেয়েছে হিরনের টেলিভিশন প্রতীকে। এরমধ্যে কালিবাড়ি রোডের স্বারসত বালিকা বিদ্যালয়ে টেলিভিশন প্রতীক পেয়েছে ১১৭৫ আর আনারস প্রতীক পেয়েছে ৫৭৩ ভোট। একই রোডের অপর কেন্দ্র সরকারি বরিশাল কলেজ কেন্দ্রে টেলিভিশন প্রতীক পেয়েছে ১২১০ এবং আনারস প্রতীক পেয়েছে ৬৩৯ ভোট।
প্রসঙ্গত : বরিশাল সিটি কর্পোরশনের নির্বাচনে ১০০টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী শওকত হোসেন হিরনের টেলিভিশন প্রতীক পেয়েছে ৬৬ হাজার ৭শ’ ৪৮ আর বিএনপি তথা আঠারো দলীয় জোট সমর্থিত নাগরিক পরিষদের প্রার্থী আহসান হাবীব কামাল’র আনারস প্রতীক পেয়েছে ৮৩ হাজার ৭’শ ৫১ ভোট। এরবাইরে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক ছাত্রনেতা মাহমুদুল হক খান মামুনের দোয়াত কলম প্রতীক পেয়েছে ১ হাজার ৮শ’৭ ভোট।
সবমিলিয়ে জাপা থেকে আ’লীগে আসীন হওয়া শওকত হোসেন হিরনের মাফিয়া স্টাইলের টেরোরিজম,দাম্ভিকতা আর দলের ত্যাগী তৃনমুল নেতা কর্মীদের নিরব ক্ষোভের বিস্ফোরনে ভরাডুবিতে বেশ প্রভাব ফেলেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এরকমই মন্তব্য। তাদের ভাষ্য, দেশের অন্য সিটি নির্বাচনে আ’লীগের পরাজয় ছিল ভিন্ন কারনে আর বরিশালে শুধুই শওকত হোসেন হিরনের বিরুদ্ধে তৃনমুল নেতা কর্মী সমর্থকদের নিরব ক্ষোভ’র প্রকাশ ঘটিয়েছে ভোটের মাধ্যমে।
লেখক : (রাজনৈতিক বিশ্লেষক/সাংবাদিক)
Mail :ahmedjalalbsl@gmail.com
২টি মন্তব্য
বনলতা সেন
জানলাম অনেক কিছু ।
ব্লগার সজীব
ধর্ম সম্পর্কে মিথ্যে প্রচারনা এই নির্বাচনে লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ের প্রধান কারন।