বিজয় মাসের শুভেচ্ছা

রিমি রুম্মান ৫ ডিসেম্বর ২০২০, শনিবার, ১১:১৬:১৪পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৫ মন্তব্য

দেখতে দেখতে বিজয়ের মাস চলে এল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের প্রবাসীদের নাড়ির সম্পর্ক। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেনো দেশ, দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আমাদের তাড়িত করে প্রতি পদে। কিন্তু দেশের বাইরে যে দেশে আমি বসবাস করি, সে আমার দ্বিতীয় জন্মভূমি। কেননা জীবন ও জীবিকার তাগিদে, নতুন জীবন গড়ার লক্ষে এই দূরের দেশে আসা মানে নতুন করে জন্মগ্রহণ করা। ভিনদেশের আলোবাতাসে কাটিয়ে দিয়েছি জীবনের ২৫টি বছর। কিন্তু যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে 'চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল' প্রবাদটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জীবনের দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকলেও মনের আড়াল হয়নি কখনো দেশ মাতৃকা। পঁচিশ বছর একজীবনের হিসেবে অনেক দীর্ঘ সময়। নিজের জন্মভূমিতে এতগুলো বছর কাটানো হয়নি আমার, যতবছর কেটেছে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে। তবে কী দেশ এবং দেশের মানুষের কথা ভুলতে বসেছি ? পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা, উন্নত জীবন, নানাবিধ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি ? না, বরং এইসব সুযোগ সুবিধাদি ভোগ করার মধ্যদিয়ে একরকম দীর্ঘশ্বাস তাড়া করে ফিরে প্রতিনিয়ত। এই যেমন, নিউইয়র্ক শহরের পাবলিক বাসে যাতায়াতের সময় এমন অনুভূতি হয়। বাস স্টপেজগুলোতে বাস থামলে হুইল চেয়ারে কোনো শারীরিক ত্রুটিযুক্ত মানুষ কিংবা বয়স্ক কেউ বাসে উঠবার সুবিধার্থে বাসটি খুব ধীরে মাটির খুব কাছাকাছি নেমে আসে। আর তাতে অনায়াসে মানুষটি বাসে উঠতে পারে। দৃশ্যটি দেখতে যতটা অসাধারণ লাগে, পাশাপাশি তারও অধিক কষ্টবোধে সকলের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে। মনে হয়, আহা, এই সুবিধাটি যদি আমার দেশের মানুষ পেত!

গতকাল দীর্ঘদিন বাদে আমার এক পুরনো ভাড়াটিয়ার সাথে ফোনালাপ হয়। কুশলাদি বিনিময় শেষে আমাদের সপরিবারে মাস দেড়েক আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার সংবাদ জানাই। করোনাভাইরাসের হাত থেকে সম্ভবত পৃথিবীর কারোরই নিস্তার নাই, এমন কথোপকথনের মাঝে জানতে পারি তাঁরাও পরিবারের প্রায় সকলেই আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই এপ্রিলের দিকে। সবাই মোটামুটি কম বেশি ভোগান্তির মধ্য দিয়ে গেলেও বিপত্তি বাঁধে উনার বাবাকে নিয়ে। মাত্র ক'বছর আগে দেশ থেকে ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছিলেন উনার বাবা। গত এপ্রিলে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ থাবায় বৃদ্ধ বাবা ১৮ দিন ভেন্টিলেটরে ছিলেন। হাসপাতাল এবং নার্সিং হোম মিলিয়ে আরও দুই মাসের অধিক সময় চিকিৎসা নিয়ে অবশেষে বাড়িতে ফিরেছেন। শারীরিকভাবে এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়, বিধায় বাড়িতে এসে ফিজিও থেরাপি দিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের মানুষজন। উনার হাসপাতাল বিল এসেছিল নয় লক্ষ ডলারেরও অধিক। অর্থাৎ প্রায় এক মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিলের এক পয়সা দিতে হবে না তাদের। পুরোটাই বহন করবে নিউইয়র্ক সিটি। বিষয়টি মন ভালো করা সংবাদ। আশ্বস্ত হবার সংবাদ। এমন তীব্র ভালোলাগার অনুভূতির মাঝেও কোনো কারণ ছাড়াই আমার বার বার মনে হচ্ছিল, আহা আমার দেশে কত মানুষ চিকিৎসার অভাবে রোগ-শোকের সাথে যুদ্ধ করে হেরে যায় রোজ, সে খবর আমরা ক'জন রাখি! ন্যূনত্বম মৌলিক সুবিধাটুকুও যদি পেতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর মানুষগুলো! ফোনের এ প্রান্তে আমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ গোপন করতে ব্যস্ততার অজুহাতে ফোন নামিয়ে রাখি।

ডিসেম্বরের প্রথম দিনে জরুরি কাজে বের হয়েছি। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে পার্কিং গ্যারেজে অপেক্ষা করছি গাড়ি গরম হবার জন্যে। সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই দেখি বাড়ির পাশের বিশাল স্কুল বিল্ডিং। সেখানে কিছু মানুষের লাইন। দিনের এই সময়টাতে বাইরে বেরুবার সময় প্রায়ই মানুষের লম্বা লাইন দেখা যায়। তাড়াহুড়ায় কিংবা ব্যস্ততায় কখনো কৌতূহল জাগেনি কেনো, কিসের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে এত মানুষ! কিন্তু সেদিন খানিকটা কৌতূহল জাগে। সকলের হাতে ব্যাগ। লাইন দ্রুতই ছোট হচ্ছে। আবার অনেকেই যোগ দিচ্ছে নতুন করে। আমি বাহিরে কাজ সেরে ফিরে এসে যখন গাড়ি পার্ক করছিলাম, তখনো ৩/৪ জন লাইনে দাঁড়িয়ে। তারা এগিয়ে যাচ্ছেন একে একে। ব্যাগ ভরে কিছু নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কৌতূহলী মনে আমিও গিয়ে শেষ ব্যক্তিটি হিসেবে দাঁড়াই সেখানে। সামনে এগোতেই দেখি টেবিল ভর্তি খাবারের প্যাকেট নিয়ে তদারকিতে ব্যস্ত দুজন কর্মী। আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ' কয়জন' ? আমি এর অর্থ বুঝতে দেরি হওয়ায় উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারো প্রশ্ন করলেন, তোমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত? কিছু না বুঝেই বললাম, পাঁচজন। আমার সঙ্গে কোনো ব্যাগ না থাকায় তারা নিজেরাই দুটি ব্যাগে খাবার ভরে হাতে ধরিয়ে দেয়। বাড়িতে এনে খুলে দেখি ব্যাগ ভর্তি পুষ্টিকর খাবার। লো ফ্যাট মিল্ক, চকলেট মিল্ক, বেবি ক্যারট, বিস্কিট, অরেঞ্জ, ভেজিটেবলস ফ্রাইড রাইস, চিকেন নাগেট, ব্রেড সহ আরো অনেক খাবার! প্রতিদিন মানুষকে বিনামুল্যে, বিনা জিজ্ঞাসায় এত এত খাবার দিচ্ছে! আমায় বাহির থেকে ঘরে ফিরতে দেখে যথারীতি ছেলেরা ছুটে আসে। খাবার দেখে ছোট ছেলের চক্ষু ছানাবড়া! চোখ গোলাকৃতি করে বলে উঠে, ' এইসব খাবার তুমি কোথায় পেলে? এসব তো আমরা স্কুলে খাই'! বড় জন বলল, ' মা, খাবারগুলো আনা ঠিক হয়নি। আমাদের তো কিনে খাবার সামর্থ্য আছে। যাদের অভিভাবকের চাকুরি নাই, খাবার কেনার সামর্থ্য নাই, এই খাবারগুলো তাদের অনেক কাজে লাগত।' আমার আর বলা হয়নি যে, কৌতূহল বশত সেখানে গিয়েছিলাম। ভেতরে ভেতরে একখণ্ড আবেগ হয়ে থমকে থাকলাম। আমি তো এমনটিই চেয়েছি চিরকাল। আমার সন্তানরা মানবিক মনের মানুষ হোক। তারা মানুষকে ভালোবাসুক। সমাজের অনগ্রসর মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হোক। তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।

করোনাভাইরাস মহামারীর সংক্রমণ রোধে নিউইয়র্ক নগরীর স্কুলগুলো চলতি বছরের ১৬ই মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মাঝে কিছুদিন স্কুল খোলা ছিল। সংক্রমণ বাড়ায় আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই থেকেই নগর কর্তৃপক্ষ স্কুল ভবনগুলোতে খাবার বিতরণ কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে থাকাকালীন শিশুদের যেন পুষ্টিকর খাবারের সংকটে পড়তে না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। এটি অনেক পরিবারে স্বস্তি নিয়ে আসে। মহামারীর সময়ে পরিবারগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা থাকলেও অন্তত না খেয়ে থাকতে হবে না কাউকে। বিষয়টি অসচ্ছল পরিবারগুলোকে অন্তত চিন্তামুক্ত রাখছে। আমি খাবারের প্যাকেটগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম যখন, আমার কেবলই বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কথা মনে পড়ছিল। পুষ্টিকর খাবার দূরে থাক, কোনোমতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই যেন বিরাট চ্যালেঞ্জ তাদের জন্যে। ওই যে বললাম, পাশ্চাত্যের উন্নত জীবন যাপন, নানাবিধ নাগরিক সুবিধা পেলেও একরকম দীর্ঘশ্বাস তাড়া করে ফিরে সকলের অগোচরে! পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেনো, অবচেতন মনে দেশ, দেশের মানুষের কথা ভাবনা করি আমরা প্রবাসীরা। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশটা যে আমাদেরই জন্মভুমি। সকলকে বিজয় মাসের শুভেচ্ছা।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ