বাংলাদেশে নারী নির্যাতন নিয়ে নাই বা বললাম, এসব সবাই জানে। পুরুষতান্তিক এই সমাজে নারীদের প্রতি মনোভাব কতোটা নিচু, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে দেশ কতোখানি এগিয়ে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়। মানসিকতার পরিবর্তনে মিডিয়ার করণীয় অনেক হওয়া ত্ত্বেও মিডিয়া অনেক আপত্তিকর কাজও করে যাচ্ছে।

 প্রসঙ্গ মিডিয়ায় নারী ও বিজ্ঞাপনে নারীদের অবস্থান। মিডিয়া জগতে যেসব নারীদের পদচারণা ঘটছে তাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা একটু ভিন্ন হয় সচরাচর। আর দশটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাদের ভাবা হয়না কারণ আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তারা যথেষ্ট স্বাধীনতার বদৌলতেই আজ মিডিয়ার মতো জায়গায় অবস্থান করে নিয়েছেন। দেশের মানুষ বিশেষত নারীরা তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়, তাই তাদের গুরুত্ব আছে বৈ কি।

 কিন্তু মিডিয়ার এই নারীরাই যখন এমন সব বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হন, যেখানে নারীদের অপমান করা হয়, নারীদের সমাজে নিচু অবস্থান ও নারীদের এসব মেনে নেয়ার মানসিকতা তুলে ধরা হয়, তখন সেটা সত্যিই বিব্রতকর। তাদের বোঝা উচিত, মিডিয়া অনেক বড় একটা প্রভাব ফেলে জনমনে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পরিবর্তনে মিডিয়া অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক বিষয়ে মিডিয়া এই মহান দায়িত্ব পালনও করে আসছে। সমস্যা হলো বিজ্ঞাপনে নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেটা কতোখানি যৌক্তিক।

 বেশিরভাগ ডিটারজেন্ট পাউডার বা কাপড় কাচা সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, নারীরাই কাপড় ধুয়ে দিচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের। স্বামীর কাপড় ধুয়ে দিয়ে পরিষ্কার কম হলে বউকে মেজাজ দেখিয়ে বলবে-“এর চেয়ে পরিষ্কার হয় না।” অথবা, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে স্বামী খুব বিপাকে পড়েছে বউ বাপের বাড়ি চলে যাওয়ায়- কিভাবে এতো ময়লা কাপড় ধোবেন স্বামী এসব দ্বারা এটাই কি বোঝাচ্ছে না যে, কাপড় ধোয়া এককভাবে নারীর কাজ, এসব পুরুষদের বিষয় না। এই শিক্ষাই যদি মিডিয়া দেশকে দেয়, তাহলে নারী স্বাধীনতা সম্ভব না। এসব বিজ্ঞাপনে নারীদের উচিতই না চুক্তিবদ্ধ হওয়া। দরকার হলে নির্মাতা ভাল বিজ্ঞাপন বানাবেন যেখানে দেখাবে নারী ও পুরুষ উভয়ই গৃহস্থালীর কাজ মিলেমিশে করছেন।

 গুঁড়া মসলাগুলোর বিজ্ঞাপনেও এই চিত্র দেখা যায়। রান্না ভাল হয়নি বলে খেতে বসে স্বামী খাবার ফেলে উঠে যেতে যেতে বলে- “রাঁধতেও জানো না।” বউ যথারীতি রান্নাঘরে গিয়ে কাঁদেন। এসব কি নারী স্বাধীনতা নাকি পুরুষদের দাসত্ব মেনে নেয়ার অনুপ্রেরণা? অন্যভাবে কি দেখানো যেতো না?

প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখানো হয়, মেয়েদের কালো বর্ণের কারণে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে না ও পরে প্রসাধন সামগ্রী দিয়ে ফর্সা বা সুন্দর হয়ে গেলে তাকে পছন্দ হয়ে যায়। দেখতে এসে গায়ের রঙ দেখে বান্ধবী বা বোনকে পছন্দ হয় অথবা প্রসাধন সামগ্রীর বদৌলতে ভালবাসা বাড়ে-কমে। এসব কতোখানি নৈতিক? নারীরা কি পুরুষদের উপভোগ্য বস্তু যে তাদের চোখে নিজেকে কামনীয় ও সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হবে, তা না হলে তাদের কাছে কোনো মূল্য নেই। বর্ণভেদ ও নারীদের অবমাননার চরম বহিঃপ্রকাশমূলক এসব বিজ্ঞাপন আমাদের কি কোনো ভাল শক্ষা দিচ্ছে??  

  একটা বাচ্চা বড় হয় এসব বিজ্ঞাপনে দেখে। সে এই শিক্ষাই পাবে যে এসব কাজ পুরুষদের না এবং ভবিষ্যতে সে এটাই প্রয়োগ করবে। এই শিক্ষাই কি আমরা ভবিষ্য প্রজন্মকে দিতে চাই? একটা সত্যিকার উন্নত মানসিকতার প্রজন্ম এভাবে তৈরি করা সম্ভব না। অবিলম্বে নারীদের হেয় করে বিজ্ঞাপন বানানো বন্ধ করা দরকার, নয়তো আরেকটা নিচু মানসিকতার প্রজন্ম গড়ে উঠবে যা কখনোই কাম্য না।  নারী-পুরুষ ভেদাভেদহীন সমাজ গঠনে মিডিয়ার উচিত এসব আপত্তিকর বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও প্রচার না করা। মানুষ হোক উন্নত রুচির ও মানুষের ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাসী।

মতামতটি প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকায়-   womenchapter.com/views/3916

 

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ