ইকরামুল বিয়ের আগে ছিলেন একজন ভবঘুর কবি।কাম কাজ নাই শুধু কবিতা লিখে কবিতা পাঠ করে সময় কাটান।নামাজ কালামেরতো বালাই ছিলো না-ন্যায় নীতির তোয়াক্কাও কখনো করেননি।তবে কলেজ লাইফে খুব সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতেন।বেশ কয়েকটি কবিতা তার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশও হয়েছে।এই কবি’র কবিতার প্রেমে মজে জাতকুল না ভেবে মালতী ইকরামুলকে ভালবেসে ফেলেন।দুই পরিবারের অমতে তারা এক সময় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কিন্তু জাতের ভিন্নতায় তারা পরিবার পরিজন ছাড়তে বাধ্য হয়ে অন্যত্র আলাদা সংসার পাতেন।সাংসারিক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ইকরামুল চিন্তায় পড়ে গেলেন।আয় রোজগারহীন তাদের জীবন চলবে কী ভাবে!মালতীর কিছু স্বর্নের জিনিস ছিলো তা বিক্রি করে সেই অর্থে এ যাবৎ সংসার চালিয়েন,তাওতো শেষ হবার পথে।জীবনকে কর্ম মুখী না করে বড় সখ করে ভলবেসে বিয়ে করে যেন পড়লেন বড় বিপদে।হঠাৎ ইকরামুলের মনে পড়ল তার বাবার কথা।সে বলত-

যদি কখনো জীবন কঠিন কোন মুহুর্ত এসে সামনে দাড়ায় তখন মসজিদে; প্রবেশ করে আল্লহর দরবারে ভুল ত্রুটির ক্ষমা চেয়ে তার সাহায্য চাইবে-দেখবে-তিনি মহান,কোন না কোন উছিলায় সমাধানের রাস্তা দেখিয়ে দিবেন।

কথাগুলো মনে পড়তেই সে আর দেরী করল না।ঘরের বাথ রুমে গিয়ে ওজু করে,সো-কেজে সাঁজিয়ে  রাখা পাঞ্জাবীটা বের করে পড়ে- মাথায় টুপি দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মসজিদের ঊদ্দ্যেশে।এদিকে মালতী হঠাং তার এমন কান্ড দেখে শুধু অবাক নয়নে চেয়ে রইলেন কিছুই বললেন না।মালতী অপেক্ষায় রইলেন তার ফেরার পথ চেয়ে।মনে মনে ভাবছেন-অনেক সময় চলে গেল সেতো এখনো আসল না।খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন মালতী।অবশেষে এলেন-সাথে নিয়ে এলেন সম্ভবত কোন এক মাদ্রাসার ছাত্র হবে।

ছেলেটি মালতীকে প্রথম দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন।অভয় দিলেন ইকরামুল।
-সমস্যা নেই-আসো আমার সাথে-ও’আমার ওয়াইফ-মালতী।
এবার ছেলেটি অবাক হলেন তার নাম শুনে।সে কিছু বলতে চেয়েও বলল না কিন্তু সুচতুর ইকরামুল তার ভাব দেখে ঠিকই বুঝতে পারলেন।ইকরামুল বললেন,
-ও’হিন্দু ঘরের আর আমি মুসলমান ঘরের তাই ভাবছতো- কেমনে কী!তাই না?আমাদের মাঝে কোন সমস্যা হয় না, ও’ ওর ধর্ম পালন করে আর আমি আমার ধর্ম পালন করি।এ নিয়ে আমার আর ওর পরিবার এবং পাড়া প্রতিবেশীরা ক্যাচাল করলে আমরা পরিবার এবং মহল্লা ছেড়ে এখানে চলে আসি।পৃথিবীতে আগেতো মানুষ এসেছে তার পরেতো ধর্ম এলো তাই না? সুতরাং ধর্মের চেয়ে মানুষ আমার কাছে অনেক বড়।
ছেলেটি একটু মুচকি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেন।হয়তো ছেলেটি বুঝতে পেরেছিলেন যে-তার এখনো মগজ ধুলাই হয় নাই-তাই তিনি পাগলের প্রলাপ বকছেন।

ছেলেটিকে ইকরামুল দ্রুত তার ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে বসতে বললেন আর তিনিও চটপট রেডি হয়ে দ্রুতই চলে আসছেন বলেন বলে চলে গেলেন তার বেডরুমে।এদিকে ইকরামুলের ওয়াইফ মালতী ড্রয়িং রুমে ছেলেটির সামনে এলে ছেলেটি তাকে একবার দেখে মাথা নীচু করে দৃষ্টি রাখলেন জমিনে।মালতী অবাক হলেও মনে মনে ইসলাম ধর্মের প্রতি তার সন্মান বেড়ে গেল-ভাবলেন হয়তো ছেলেটি ধর্মের বাধ্য বাধকতার মাঝে আছে ।ছেলেটির জন্য রান্না ঘর হতে ট্রেতে পিরিচ করে কিছু বিস্কুট আর জল এনে টি টেবিলে রেখে দিয়ে পাশে বসলেন।
-তুমিতো আমার ছোট ভাইয়ের মত-লজ্জা কীসের! নেও খাও।
তবুও ছেলেটি মাথা উচু না করেই বললেন।
-শুকরিয়া..
মালতীও নাছোর বান্দা কত মুসলমানের সন্তান দেখেছেন!কত মুসলিম পরিবারের সন্তানরা তার পিছনে লাইন মারার চেষ্টাও করেছেন কিন্তু তিনি এই প্রথম একজনকে দেখলেন যার দৃষ্টি যেন মেয়ে মানুষের প্রতি কোন লোভই নেই!কিন্তু কেন?জানতে হবে তাকে।মালতী এবার তার আরো কাছে গিয়ে বসলেন।সে খানিকটা দুরে সরে মাথা নত অবস্থায় বিস্কুট খাচ্ছে।
-এই ছেলে!কী ব্যাপার বলোত? তুমি সেই কখন থেকেই মাথা নত করে  কথা বলছো আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছো না।আমি কী দেখতে অসুন্দর?নাকি বাঘ ভাল্লুক!
ছেলেটি মাথা নত এবং বিস্কুট চিবানুবস্থায়।
-না,না,.. তা নয় ভাবী।বিষয়টা হলো আমাদের ইসলাম ধর্মে মতে,পরনারী কেন-নিজের সাবালক মেয়ের সামনেও শালীনতা রেখে চোখে পর্দা রেখে কথা বার্তা বলাটা ফরজ।
-মানে?এই ছেলে! আমিতো তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়! তোমার বড় বোনের মত!আমার সামনে তোমার  আবার কীসের পর্দা!শুনি?
-না ভাবী,আপনি যা  ভাবছেন তা নয়,আবার আপনি যা ভাবছেন তা হতে আবার কতক্ষণ! শয়তান কখন আবার মনকে প্রভাবিত করে,মনকে ভুল বা পাপ পথে চালিত করবে তা কেউ আমরা নিশ্চিৎ নই তাইতো আমাদের ধর্মে সাবালক হলেই পর্দা ফরজের বিধান আছে তাতে উভয় নিরাপদ ও সম্মানের  সহিত বসবাস  করে দুনিয়াবী কাজ  কর্ম করতে পারি।
-তাই বলে এই ভাবে এতোক্ষণ কারো মুখ কেউ না দেখেই কথা বলব?
-উপায় নেই।শয়তানকে আল্লাহ মানুষের শিরায় উপশিরায় চলার অনুমতি দিয়েছেন কোন এক কারনে; তাইতো হাদিস আছে-যদি কোন পর্দাহীন নারীরকে দেখো প্রথম বার তবে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে আর যদি ঐ নরীকে (অপ্রয়োজনীয়)মনে দ্বিতীয় বার দেখার সাধ জাগে এবং দেখো তবে ভাববে তোমায় শয়তানে ভর করেছে-তখন তা হবে তোমার জন্য পাপ।নিশ্চয় পাপীদের স্থান পরকালে জাহান্নামে।

এর মধ্যে ইকরামুল হাতে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে ড্রইং রুমে আসলেন।ছেলেটি  দাড়িয়ে গেলেন।মালতী অবাক হলেন।
-কী! কোথাও কী যাচ্ছো তুমি?
-ও হ্যা তোমাকেতো বলাই হয়নি-আমি চিল্লায় যাচ্ছি ৪০ দিনের জন্য।
-মানে? তাহলে আমি এখানে একা একা থাকবো কী করে?
-আমি সেই ব্যাবস্থাও করে রেখেছি।তোমার সাথে এ কয়দিন হনুফা(তার বোন)থাকবে।ওর জামাই গত পরশু বিদেশ চলে গিয়েছেন।মায়ুইমাকে বলে ম্যানেজ করেছি।তাছাড়া মোবাইলতো আছেই।

ইকরামুল চিল্লা থেকে ফিরে এসেছেন নতুন রূপে নতুন ভাবে।তার মুখ ভর্তি দাড়িগোফ  আর মাথায় সুন্নতী পাগড়ী,পড়নে নিত্য দিনে পরিধেয় পায়জামা পাঞ্জাবী তার দেহের সাথে বেশ মানিয়েছে।স্ত্রীকেও আসতে যেতে সালাম দিচ্ছেন শুধু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না যে তুমিও আমার ধর্মে আসো।স্বামী স্ত্রী দুই ধর্মের দুজন হওয়ায় ঘরের ভেতর সব ধরনের ইবাদত পুজা বন্ধ।দেখতে অসুন্দর  হবে তাই তাদের মনের মাঝে  অঘোষিত এমন আইন।

ইকরামুল এখন পুরোপুরি ইসলামী মতে ইসলামী বেশে চলছেন।নামাজে নিয়মিত ওয়াজেও অংশিদারীত্ব।এর মধ্যে সে বেশ কয়েকটি মসজিদ মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন।কামাই রোজগার বেশ ভালই হচ্ছে।কিন্তু তাতেও যেন তার পুষে না তার আরো টাকা চাই।
পৃথিবীতে হয়তো এই একটি বস্তু টাকা' যা অর্জনে মানুষের  কোন লাগাম থাকে  না।চাহিদার ওভার হবার পরও একটা সময় এটা মানুষের জীবনে আফীমের মত নেশা হয়ে  যায়। এমনি ভাবনায় এক সময় সে এক পীরের মাজারে গেলেন।

পীরের মাজারে এলাহী কান্ড দেখে অবাক হলেন।অসংখ্য  ভক্ত মুরিদানার পদচারণ পুরো বিশাল এক মাঠ জুড়ে।অসংখ্য খিচুরী রান্নার ডেগ সারি বদ্ধ ভাবে চুলোয় বসানো-রান্না হচ্ছে মুরিদান আশেকানদের জন্য খিচুরী।ইকরামুল জানতে পারলেন আজ'ই গরু ছাগল মিলিয়ে জবাই হয়েছে প্রায় শ'খানেক।অন্য দিকে একটু খেয়াল দিয়ে দেখলেন এখানে শুধু তিনি একাই আসেনি!এসেছেন এদেশের ক্ষমতাধর বড় বড় বেশ কয়েক জন রাজনৈতীীক ব্যাক্তিবর্গ।আসছে নির্বাচনে নাকী তারা প্রার্থী হবেন তাই হুজুরের নিকট দোয়া  নিতে এসেছেন।

মাঠের পশ্চিম পাশে ছোট পরিসরে পাহাড়ে টিলার ন্যায়  উচুতে পীর সাহেবের সাজানো বসার স্থানে পীর সাহেব বাদ আছর হতে সেখানে মুরিদানদের সেবায় আসন গ্রহন করেন।তার আগে সাক্ষাতের জন্য সিরিয়াল লাগে আর সিরিয়াল যত বেশী কাছে চাইবেন তার জন্য তত বেশী মান্যত লাগবে।।

ইকরামুল সাহেবের মান্যতের পরিমানটা মনে হয় বেশ ভালই ছিলো বলে সিরিয়ালটাও খুব সহজে পেয়ে গেলেন।হাজারো মুরিদানাদের পেছনে ফেলে হজুরে সামনে গিয়ে দাড়ালেন।পীরের আসন আকাশচুম্বী তাইতো মুরিদ আকাশের দিকে চেয়ে হুজুরের দরবারে তার মানস কামনা পেশ করছেন।
-হুজুর…
এখানেই ইকরামুলকে পীর সাহেব থামিয়ে দিয়ে বললেন।
-আমি জানি তুমি এখানে কেনো এসেছো-তুমি তোমার এলাকার রহমতের সাথে গিয়ে দেখা করো কাজ হয়ে যাবে।।
-হুজুর …
আবারো তার কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন।
-যা বলতে চেয়েছো তা না বলাই ভাল।আমি তোষামোদী আর প্রশ্ন করা পছন্দ করিনা।তুমি যেতে পারো।

ইকরামুল আর কোন কথা না বাড়ীয়ে হুজুরকে সালাম দিয়ে ফিরে এলেন তার এলাকায়।বাসায় এসে চুপচাপ বসে আছেন।মালতী তার পাশে বসল।মনের কোণে লুকায়িত কথাগুলো মালতীকে বলছেন।
-জানো আজ পীরের দরবারে গিয়ে অবাক  হলাম-পীরকে আমি কিছুই বললাম  সে কী ভাবে বুঝল আমার তার সাথে সাক্ষাতে উদ্দ্যেশ্য কী ছিলো!আবার যখনি আমি তাকে প্রশ্ন করব সে কী ভাবে জানল আমার মনের কথা।

এর মধ্যে ইকরামুলের মোবাইলে রিং বেজে উঠল।আননোন নাম্বার।ফোনটা রিসিভ করেন।
-আসসালামুআলাইকুম
-ইকরামুল বলছেন?
-জ্বী,আপনি?
-আমি পীর সাহেবের লোক-রহমত।আপনি কী এখন একটু দেখা করতে পারবেন?
-জ্বী জ্বী আমি এখনি আসছি।

চলবে-

ভুমিকাঃ আমি কেবল সামাজিক অবক্ষয়ের কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।কোন ধর্মে আঘাত দেয়া বা ধর্ম অবমাননা করা আমাার উদ্দ্যেশ্য নয় বরং পবিত্র ধর্মগুললোর ভেতরে নিজ স্বার্থ হাসিলে লুকিয়ে থাকা শয়তানদের মুখোশ উম্মোচন করার চেষ্টা করেছি  এবং সব কিছুর উর্ধে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে রেখে মানুষের ভেতরে অমানুষগুলোর চরিত্র রূপায়ণে  চেষ্টা করেছি।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ