এই সময় শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাঁদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি না? শহীদ সাহেব দিল্লিতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এক ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। যতদূর আমার মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। যদি দেখা যায় যে, গণপরিষদে বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি পাকিস্তানে যোগদানে পক্ষপাতী, তবে বাংলাদেশ পুরাপুরিভাবে পাকিস্তানে যোগদান করবে। আর যদি দেখা যায় বেশি সংখ্যক লোক ভারতবর্ষে থাকতে চায়, তবে বাংলাদেশ ভারতবর্ষে যোগ দেবে। যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাও থাকতে পারবে। এই ফর্মুলা নিয়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। বৃটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে যেয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন, "শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।" মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে একথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন একথা স্বীকার করেছিলেন।
যুক্ত বাংলার সমর্থক বলে শহীদ সাহেব ও আমাদের অনেক বদনাম দেবার চেষ্টা করেছেন অনেক নেতা। যদিও এই সমস্ত নেতারা অনেকেই তখন বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই ফর্মুলা গ্রহণ করেছিলেন। জিন্নাহর জীবদ্দশায় তিনি কোনোদিন শহীদ সাহেবকে দোষারোপ করেন নাই। কারণ, তাঁর বিনা সম্মতিতে কোনো কিছুই তখন করা হয় নাই। যখন বাংলা ও আসাম দুইটা প্রদেশই পাকিস্তানে যোগদান করুক, এর জন্যই আমাদের আন্দোলন ছিল, তখন সমস্ত বাংলা পাকিস্তানে আসলে ক্ষতি কি হত তা আজও বুঝতে কষ্ট হয়! যখন বাংলাদেশ ভাগ হবে এবং যতটুকু পাকিস্তানে আসে তাই গ্রহণ করা হবে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে---তখন সে প্রশ্ন আজ রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা বদনাম দেয়ার জন্যই করা হয়। বেশি চাইতে বা বেশি পেতে চেষ্টা করায় কোন অন্যায় হতে পারে না। যা পেয়েছি তা নিয়েই আমরা খুশি হতে পারি। খাজা নাজিম উদ্দিন সাহেব ১৯৪৭ সালের ২২শে এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন, 'যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু মুসলমানের মঙ্গলই হবে।' মওলানা আকরম খাঁ সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, "আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে।" এই ভাষা না হলেও কথাগুলির এই অর্থ ছিল। আজাদ কাগজ আজও আছে। ১৯৪৭ সালের কাগজ বের করলেই দেখা যাবে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-৭৩ ও ৭৪)
১১টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
আসলেই সবজায়গায় কেউ না কেউ গাদ্দার থাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
থাকেই। কষ্ট এটাই, এসব গাদ্দারদের কুকর্মের কারণে আমাদের আজীবন কোন না কোনভাবে খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে।
নীহারিকা
এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই ধারাবাহিকভাবে দিচ্ছেন বলে ভালো লাগছে। জানছি অনেক অজানা ঘটনা।
কষ্ট করে পোস্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
প্রহেলিকা
ধন্যবাদ আপনাকে অবশ্যই। আপনার মাধ্যমেই পড়া হয়ে যাচ্ছে পুরোটা বই।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমার মাধ্যমে পড়া হয়ে যাচ্ছে জেনে ভালোই লাগছে। তবে কথা কি জানেন, আমি না দিলেও পড়ুয়া মানুষ আপনি হয়তো পড়েই নিতেন কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য করে লিখতে শুরু করেছিলাম তারা কি আদৌ পড়ছে? জানতে পারলে ভালো লাগতো আরো বেশি।
জিসান শা ইকরাম
আজ জাতির জনকের সমাধিতে গিয়েছিলাম, সমাধিস্থলে থাকাবস্থায় আপনার কথা হঠাৎ করে মনে হয়েছে,
জাতির পিতার আত্মজীবনী লিখছেন আপনি,
ধন্যবাদ আপনাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ইস কি দারুণ হতো রুবা’পু ভেবে দেখো, যদি পুরো বাংলা আমাদের হতো।
ভালো থেকো। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মাঝেমধ্যে এমনটা আমারও মনে হয় দিদি। একই ভাষাভাষী, একই জাতি অথচ শুধুই ধর্মীয় কারণে ভিন্ন দেশ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ব্রিটিশ বুদ্ধি সাধে কি আর বলে! আর আমরা হলাম তাদের হাতের খেলনা।
ওই গানটা শুনেছো নিশ্চয়ই?
“তেলের শিশি ভাঙ্গলো বলে খুকুর ‘পরে রাগ করো
তোমরা যে সব ধ্যাড়ে খোকা বাংলা ভেঙ্গে ভাগ করো।”