প্রথম প্রেম প্রথম ভালোবাসা

ক্লাস টুতে পড়ি,স্কুলে যাচ্ছি। বাসা থেকে একটু সামনেই মেইন রোড, রিকশার জন্য অপেক্ষা।হালেমার এক হাতে আমার স্কুল বেগ আরেক হাতে আমার হাত খানা শক্ত করে ধরা।আমাদের গ্রামেই তার বাড়ি, তেরো জন ভাই বোনের বিশাল সংসার,সবার ছোট সে। বাবা একজন বর্গা চাষী নিজস্ব জায়গা বলতে বাড়ির ভিটা টুকুই।

হঠাৎ মাঝবয়সী এক সুন্দরী নারী লাল শাড়ি পরা সিঁথিতে সিঁদুর, রিকশা থামিয়ে হালেমাকে বললো আমাকে তার রিকশায় উঠিয়ে দিতে। ভয়ে হালেমা আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।_____আমি ওর দিদি মনি,গোবিন্দ শ্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসিস্টেন্ট হেড মিস্টেজ।অতপর সেই দিন থেকেই হালেমার হাত ছেড়ে দিদি মনির হাত ধরে আমার স্কুলে আসা যাওয়া শুরু।

মা অস্থির তার ছেলেকে লাল পরীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। হালেমাকে বকাঝকা,বাপের অফিসে ফোন।সাথে সাথেই বাবার আবার স্কুলে ফোন। অবশেষে মা শান্ত হলেন, সেই লাল পরী আর কেউ নন তার ছেলের স্কুলেরই একজন শিক্ষিকা।

দিদি মনি ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী, মিষ্টি মায়বী রুপ ছিলো তার, পান খেয়ে ঠোঁট দুটো সবসময় থাকতো লাল হয়ে আর সেই বাঁকা ঠোঁটের ভাঁজে লুকিয়ে থাকতো তার ভুবন মাতানো হাসি। জন্মগতভাবেই ডান পায়ে হালকা সমস্যার কারনে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতেন। এ যেনো জোসনা বিলানো রুপোলী চাঁদের গায়ে কিঞ্চিত কলঙ্কের দাগ। দিদি মনির কথামতো প্রতিদিন সকালে এই রাস্তার মোরে তার জন্য অপেক্ষা করা আর স্কুল শেষে তার হাত ধরেই বাড়ি ফেরা, কখনো চকলেট কখনোবা আইসক্রিম হাতে।

আমি কখনোই ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হতে পারিনি তবে তিন চার পাঁচ এর মধ্যে ঘুরাঘুরি করেই কাটিয়েছি আমার প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্কুল জীবন। একদিন দিদি মনির ক্লাসে সবাই পড়া পারলো আমি ছাড়া। যথারীতি বেঞ্চের উপর কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে হলো। পুরো ক্লাসে আমি একা,অন্তত একজনও যদি আমার মতো কান ধরে দাড়িয়ে থাকতো তবে হয়তো এতোটা খারাপ লাগতো না। তারপর আবার বেঞ্চ থাকে নেমেই দিদি মনির সামনে গিয়ে হাত পাততে হলো,ঠাস ঠাস দুহাতের তালুতে দুটো বেতের বাড়িও পরলো।

স্কুলের ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো। মনটা ভিষন খারাপ। অভিমানের পাহাড় চেপে বসলো অবুঝ মনটার উপর। ভাবছি দিদি মনির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবো। আর তাই অন্যান্য দিনের মত ওনার রুমে না গিয়ে আজ একাই মেইন রোডে এসে রিকশা নিলাম। বাসাও চিনতে পারলাম কিন্তু রিকশা ভাড়া! টিফিনে কদবেল আর আচার খেয়ে তো পয়সা শেষ। কি আর করা রিকশা মামাকে সোজা বাসায় নিয়ে গেলাম।

 

মার অনেক প্রশ্ন কিভাবে আসলাম,কেন এভাবে আসলাম ইত্যাদি ইত্যাদি আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ। অভিমানের আগুন দাউদাউ করে জলছে,আমি যে প্রেমের ইতি টেনে এসেছি আজ। যাইহোক,যেভাবেই হউক বাসায়তো আসতে পারলাম কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই। তাই আজ আমার মা শান্ত হলেও দিদিমনি অশান্ত। যথারীতি আইসক্রিম আর চকলেট নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে দিদিমনি আমাদের বাসায় হাজির। এই প্রথম ওনি তার প্রেমিকের বাসায় আসলেন,এসেই তাকে জড়িয়ে ধরলেন।

আমার বাবা পিডিবিতে চাকরি করতেন আজ চিটাগং তো কাল সিলেট এভাবেই চলে আমার শৈশব। দিদিমনির সাথে আমার প্রেম যখন তুঙে বাবার বদলির অর্ডার হলো সিলেট থেকে ঢাকা। আমাদের অসমাপ্ত প্রেম অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়ে আর কখনোই আলোর মুখ দেখেনি।দুই ভুবনে দুই বাসিন্দা হয়েই পরে রইলো।

আজ আমি মধ্যে বয়সী যুবক,ইলেকট্রিক্যাল ম্যানেজার হিসেবে একটি গ্রুপ অফ কম্পানিতে চাকরি করি। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছি সিলেট। জাফলং, মাধবকুন্ড ঘুরে মৌলবিবাজারের এক আবাসিক হোটেলে উঠি,একদিন স্টে করবো বলে। পরের দিন সকালে এক সাথে নাস্তা করার পর,বন্ধুরা আর আমাকে খুজে পাচ্ছে না। ওদের না জানিয়ে দিদিমনির সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়ে পরলাম। খুজে পেলাম আমার সেই শৈশবের স্কুল, গোবিন্দ শ্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়। অনেক কিছুই বদলে গেছে,শুধু বদলায়নি স্কুলের সামনের খেলার মাঠটা আর পিছনের দীঘির মতো বড় পুকুরটা। সেই পুরনো পুকুরে মানুষ সাঁতার কাটছে, মাঠে বাচ্চারা খেলা করছে, ক্লাসে শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়াচ্ছেন আগের মতই।হয়তো আমার মতো কান ধরে কেউ দাড়িয়েও আছে বেঞ্চের উপর।

একে দেখি ওকে দেখি কিন্তু আমার হারিয়ে যাওয়া সেই দিদিমনিকে আর খুজে পেলাম না। কিন্তু এতো গুলো বছর পরেও তার আঁচলের সেই মায়া জড়ানো গন্ধটুকু ঠিকই অনুভব করিলাম আর তার ভুবন ভুলানো সেই মিষ্টি হাসিটাও দেখিলাম,যা আজ অকপটে ভেসে উঠল চোখের সামনে আগের মতই।

যেখানেই থাকো দিদি মনি,এপার কিংবা ওপারে, ভালো থেকো।
ভালোবাসি তোমায়।তুমিই যে আমার প্রথম প্রেম প্রথম ভালোবাসা।

 

 

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ