গত বছরের শেষদিকে গণচীনে উৎপত্তি হওয়া নতুন করোনাভাইরাসটি যখন ধীরে ধীরে সারাবিশ্বটাকে আক্রমণ করে ফেললো, তখন থেকেই বিশ্বের দেশগুলোর সরকার নিজ নিজ দেশের জনগণকে বাঁচাতে নানারকম পদক্ষেপ হাতে নিয়ে লকডাউন, শটডাউন, সন্ধ্যা আইনজারি ঘোষণা শুরু করলো। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্যও প্রতিটি দেশের জনগণকে সতর্ক করতে লাগলো। আমাদের দেশেও একসময় লকডাউন, শাটডাউন শুরু হয়ে গেলো। লকডাউন মানে জনজীবনের সবই ডাউন। এই ডাউন ঘরবন্দী সাজার মতো একরকম কারাভোগ করার মতনই।

তখন সারা দেশের মতো আমাদের এলাকাও একসময় লকডাউনের আওতায় পড়ে গেলো। সেসময় ঘাতক করোনাভাইরাসের ভয়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এলাকার কোনও মানুষ ঘরের বাইরে যায়নি। যদিও কেউ ঘরের বাইরে গিয়েছে, নিজের কাজ সেরে তড়িঘড়ি করে বাসায় বা বাড়িতে এসে আবার ঘরবন্দী হয়ে সময় কাটিয়েছে।

তখন এলাকার সব মানুষের মতো আমার অবস্থাও একইরকম হয়েছিল। সারাদিন যেমন-তেমন, রাতের  পুরোটা সময়ই একরকম সজাগ থাকতে হতো। কারণ তখন দিনের বেশিভাগ সময়ই ঘুমিয়ে থাকতাম। তাই রাতেরবেলা আর চোখে ঘুম আসতো না। সারারাত মোবাইল নাহয় ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতে হতো। ঠিক এভাবেই চলতে গাগলো লকডাউনের আলামতের দিন আর রাতগুলো।

এমনই এক রাতে মোবাইল আর ল্যাপটপ কিছুই ভালো লাগছিল না। চোখেও ঘুম আসছিল না। তখন গভীররাতে ঘরের দরজা খুলে বাইরে গেলাম। বাড়িটা অনেক বড়বাড়ি। দুইপাশে সারিবদ্ধ ভাড়াটিয়াদের থাকার ঘর। মাঝখানে ফাঁকা। মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা দেখতে একটা ফুটবল খেলার মাঠের মতন। সেই রাতটা ছিল ভরা পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নার আলোতে তখন পুরো বাড়ি আলোকিত। কিন্তু বাড়ির কোনও মানুষই মনে হয় সজাগ ছিল না। সেই রাতে মনে হয় পুরো বাড়িতে আমিই একমাত্র সজাগ ছিলাম।তাও ফুটবল খেলার মাঠের মতো উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে এদিক-ওদিক দেখতেছিলাম।

হঠাৎ আকাশ থেকে মানুষের কঙ্কালের মতো কী যেন একটা সামনে এসে দাঁড়ালো। মনে হলো, ইউটিউবে দেখা কোনোএক এলিয়েলের মুভি থেকে সরাসরি একটা এলিয়েন এসে আমার সামনে হাজির হলো। আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম! ভয়ে আমার সারা শরীর কাটা ধরে গেলো। তখন চিৎকার করে ঘরের গিন্নীকে যে ডাক দিবো, সেই সাহসটাও যেন মুহূর্তেই হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু জ্ঞান হারা হইনি। অজ্ঞানও হয়ে পড়িনি। তখনো আমার সঠিক জ্ঞান ছিলো। তবে আকাশ থেকে সামনে এসে দাঁড়ানো মানুষের মতো কঙ্কালটি দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। আর মুখে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, রাম রাম জপতে লাগলাম।

আমার কাঁপুনি দেখে মানুষরূপী কঙ্কালটি সামনে এসেই আমাকে বললো,

–ভয় পেয়ো না। আমি ভিনগ্রহ থেকে এসেছি। আমার নাম কোঁয়া কোঁয়া। আমরা আমাদের গ্রহ থেকে UFO (এলিয়েনদের বিশেষ মহাকাশযান) চড়ে প্রায়সময়ই তোমাদের এই সুন্দর গ্রহটা দেখতে আসি। আমি তোমাদের এই এলাকার উপর দিয়ে যখন আসা-যাওয়া করি, তখন অনেকসময় তোমাকে ফলো করি। তাই আজকে সরাসরি তোমার সামনে এসে হাজির হয়েছি, তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্যে। অবশ্য তুমি আমাকে দেখে ভীষণ ভয় পাচ্ছো! ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করবো না। তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবো, তুমি ঠিকঠাকমতো আমার কথাগুলোর উত্তর দিবে।

আমি ভয়েভয়ে বললাম,

–বলুন আপনি কী বলতে চান?

কোঁয়া কোঁয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

–তোমাদের এই গ্রহটির নাম কী?

আমি বললাম,

–এটা একটা কথা হলো! আমাদের এই গ্রহটির নাম এই দুনিয়ায় কে না জানে? আমাদের এই গ্রহটির নাম পৃথিবী। কেউ কেউ এটাকে দুনিয়াও বলে। আবার কেউ বিশ্বও বলে থাকে।

কোঁয়া কোঁয়া এবার জিজ্ঞেস করলো,

–তুমি কি কখনো নিজের চোখে আকাশ থেকে তোমাদের এই গ্রহটা দেখেছো?

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম! নাতো, আমি নিজের চোখে আকাশ থেকে তো পৃথিবীটা দেখিনি! এখন যদি আমি বলি দেখেছি। তাহলে এই কঙ্কালটা যদি প্রশ্ন করে, তুমি কীভাবে আকাশে উঠলে? তারপর তো আমি আকাশে ওঠার প্রমাণ দেখাতে পারবো না। তারপর হয়তো আমার বিপদ হতে পারে! তারচে বরং সত্য কথাই বলে দেই, দেখিনি। এই ভেবে আমি সত্য কথাই বললাম,

–না, দেখিনি!

আমার সত্য কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া হেসে আবার জিজ্ঞাসা করলো,

–তারপরও নিজের ধারণা থেকে বলতো তোমাদের গ্রহটি আসলে দেখতে কেমন হবে?

আমি আবারও ভাবতে লাগলাম! বই-পুস্তকে পড়েছি, পৃথিবী গোল। এখন যদি বলি গোলাকার, তাহলে যদি আবার প্রশ্ন করে, তুমি কী করে বললে গোলাকার? প্রমাণ দেখাও! তাহলে আমি সঠিক প্রমাণ এই ভিনগ্রহের কঙ্কালটাকে কী করে দেখাবো? তারচে বরং পৃথিবীটা গোল-ই বলে দিই, যা হবার তো হবে। মনে মনে এই ভেবে আমি বললাম,

–পৃথিবী গোল।

আমার কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া হেসে বললো,

–সত্যি পৃথিবীটা গোল? সে-জন্যেই তো তোমাদের গ্রহটিতে এতো হট্টগোল। চারদিকে সোরগোল। দেশ-বিদেশে লেগে থাকে গণ্ডগোল! দেশে দেশে অযথা যুদ্ধে খালি হচ্ছে কতো মায়ের কোল।

কোঁয়া কোঁয়ার কথা শুনে আমি রীতিমত বেকা হয়ে গেলাম। আমি মনে মনে ভাবছি! গোল বলেছি বলেই মনে হয় কোঁয়া কোঁয়া এরকম বলছে। আচ্ছা, গোলাকার বলে দেখি তো, কোঁয়া কোঁয়া কী বলে! এই ভেবে সাহস করে বললাম,

–গোল যদি না হয়, তাহলে হবে গোলাকার।

আমার কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া বললো,

–পৃথিবী গোলাকার? এ-জন্যেই তো তোমাদের গ্রহটির  অনেক স্থানে স্থায়ী হয়ে আছে ক্ষুধার্তের হাহাকার। বিচারের নামে করে অবিচার। ক্ষমতাবানদের হুঙ্কার। নিরীহ অসহায় মানুষকে করে অত্যাচার। যত্রতত্র অবৈধ অস্ত্রের ঝংকার। অনেক মানুষের থাকে আত্ম অহংকার। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করে বলৎকার। গরিবদের করে তিরস্কার। শিক্ষিতদের জন্য ধিক্কার। মুর্খরা পায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।

কোঁয়া কোঁয়ার এরকম কথা শুনে আমি আবারও থ বনে গেলাম! আমি আবারও মনে মনে ভাবছি! আসলে আমাদের গ্রহটি কেমন হতে পারে? একবার বললাম, গোল। তা কোঁয়া কোঁয়ার পছন্দ হলো না। আবার বললাম, গোলাকার। তাও কোঁয়া কোঁয়ার মনোমতো হলো না। তাহলে কি বলবো রুটির মতো চেপটা? নিশ্চয়ই পৃথিবীটা চেপটাই হতে পারে! এই ভেবে আমি আবার আমতা আমতা করে বললাম,

–আমার বলতে ভুল হয়েছে। আসলে আমাদের পৃথিবীটা রুটির মতো চেপটা।

আমার কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,

–তোমাদের পৃথিবীটা চেপটা? তাইতো সময় সময় দেখি তোমাদের বিজ্ঞানীদের মনের দূষিত ভাবটা! ওঁরা হাতের মুঠোয় নিতে চায় দুনিয়াটা। একসাথে কোটি কোটি মানুষ মারতে তৈরি করতে জীবানু অস্ত্রটা। এরকম ভাবতে ভাবতে বিজ্ঞানীরা হারাম করে ফেলেছে ওঁদের রাতের ঘুমটা।

আমি তখন কোঁয়া কোঁয়ার ডায়লগ শুনে ভয়ে কাঁপছি, আর মনে মনে ভাবছি! ভাবছি, না জানি আজ আমার কী হয়! আমার শারীরিক কাঁপুনি কোঁয়া কোঁয়া টের পেয়ে আমাকে বললো,

–তুমি এতো ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ের কোনও কারণ নেই। তুমি মনস্থির করে বলো তোমাদের গ্রহটি দেখতে কেমন হবে।

কোঁয়া কোঁয়ার কথায় আমার মনে ভয় কিছুটা দূরীভূত হলো। আমি আবার মনে সাহস জুগিয়ে বললাম,

–আমাদের পৃথিবীটা চক্রাকার।

আমার কথায় কোঁয়া কোঁয়া হাসতে হাদতে অস্থির হয়ে বললো,

–তোমাদের পৃথিবী চক্রাকার? এই চক্রাকারে ঘুরপাক খেয়েই বিশ্ববাসীর হাহাকার। অসহায়ত্বের আহাজার। অনেক ভালো ভালো মানুষও বনে যাচ্ছে রাজাকার। ধনীব্যক্তিদের বাড়ছে অহংকার। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দাপটে সারা পৃথিবী ছারখার। মারণাস্ত্রের আঘাতে মুহূর্তেই হয়ে যায় চতুর্দিক অন্ধকার। প্রতিটি দেশের আনাচে-কানাচে চলছে নারী ধর্ষণের কারবার। জায়গায় জায়গায় লাশ পড়ে থাকে অসহায় ধর্ষিতার।

কোঁয়া কোঁয়ার কথা শুনে আমার আর কোনও জবাব নেই। আমার মাথা রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমি এখন কোঁয়া কোঁয়ার সামনে থেকে পালাবার জন্য এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। কিন্তু কোঁয়া কোঁয়া আমার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখার কারণে আর পালাতে পারছিলাম না। তখন আমার এরকম পায়তারা দেখে কোঁয়া কোঁয়া বললো,

–তোমাকে বললাম, তুমি ভয় না পেয়ে সঠিকভাবে বলো, পৃথিবী নামক এই গ্রহটি দেখতে কেমন?

আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি'! কিন্তু কিছুতেই তো ছাড় পারছি না। কোঁয়া কোঁয়া আমাকে যেন যমের ধরা ধরেছে। কিছুতেই ও আমাকে ছাড়ছে না। উপায়ন্তর না দেখে এবার বললাম,

–অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করে বলে, পৃথিবী নাকি হুবহু একটা ফুটবল।

আমার কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া একটা ধমক দিয়ে চিৎকার করে বললো,

–পৃথিবী ফুটবল? তাইতো দেশে দেশে এতো দলবল। চলছে রাজনীতির কুট-কৌশল। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেই করে জবরদখল। করে হল দখল। করে  ভূমি দখল। দেখায় বাহুবল। আরও করে ভোট কারচুপির কলাকৌশল। তোমাদের ছোট্ট একটা দেশেও শতশত কতো রাজনৈতিক দল।

কোঁয়া কোঁয়ার ধমক শুনে আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল যে, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম  না। আমার পা দুটো থরথর করে কাঁপছিল। আমার এমন কাঁপুনি দেখে কোঁয়া কোঁয়া আমাকে বললো,

–তোমাকে না বলেছি, তুমি ভয় পেও না! তারপরও তুমি  ভয়ে কাঁপছো কেন? তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি আবার বলো, তোমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি দেখতে কেমন হবে? তুমি নির্ভয়ে বলতে পারো।

আমি তখন কাঁপতে কাঁপতে একটা নাবালক শিশুর মতো হয়ে বললাম,

–আমাদের পৃথিবী লম্বা একটা রাস্তার মতন।

কোঁয়া কোঁয়া এবার ক্ষিপ্ত না হয়ে শান্ত গলায় আমাকে বললো,

–পৃথিবীটা লম্বা রাস্তার মতন? তাহলে কেন করো না তোমরা জন্মদাতা পিতার যতন? কেন-ই-বা করো না  গর্ভধারিণী মায়ের যতন? সেই কারণেই আমাদের হচ্ছে যুগেযুগে এতো অধঃপতন। তোমারও হয়ে যাচ্ছ দিনদিন শয়তানের মতন। গর্ভধারিণী মাকে কষ্ট দিয়ে শ্বাশুড়িকে করছো যতন! নিজের মা-বাবাকে দাও কষ্ট, তাই তোমাদের সন্তানও হচ্ছে নষ্ট। যে-দিকে তাকাই শুধু দেখি  স্বার্থবাদী। না খেয়ে মরে মা-বাবা আর দাদা দাদী।

কোঁয়া কোঁয়ার কথা শুনে এবার আমি হাত দুটো জোর করে বললাম,

–আমার ভুল হয়েছে মিস্টার কোঁয়া কোঁয়া। আসলে আমাদের পৃথিবীটা চারকোণা।

আমার কথা শুনে কোঁয়া অট্টহাসি দিয়ে বললো,

–হা হা হা, পৃথিবী চারকোণা? এজন্যই তো আজ তোমাদের ধরেছে ভাইরাস করোনা। কারণ তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে মান না। সৃষ্টিকর্তার এবাদত উপাসনা ঠিকমতো করো না। তাঁর আদেশ-নির্দেশাদিও মানতে চাও না। এইজন্যই আজ তোমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটির ঘরে ঘরে ভাইরাস করোনা। যাঁরে পায় তাঁরেই ধরে, ছাড়ে না। এই ভাইরাসের কোনও ঔষধও হবে না। এর থেকে তোমরা সহজে রেহাইও পাবে না।

কোঁয়া কোঁয়ার কথায় আমি এবার একটু ক্ষিপ্ত হয়ে উল্টে তাকেই প্রশ্ন করলাম,

–দুরছাই, তাহলে আপনিই বলুন তো আমাদের পৃথিবীটা কেমন হতে পারে?

কোঁয়া কোঁয়া এবার শান্ত গলায় হেসে বললো,

–তোমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি আসলেই গোল। আর গোল-এর পরবর্তী শব্দগুলো: গোলাকার, বৃত্তাকার, চক্রাকার, গোলকায়, বর্তুলাকার, মণ্ডলাকার, বৃত্তীয়, পরিপত্র, তলবিশিষ্ট, বৃত্ততুল্য, বলয়াকার।

পরিশেষে কোঁয়া কোঁয়া বিদায়বেলা বলে গেল, –ছোট থেকে বড় হও, করো ঘর সংসার। সৎপথে চলো সবাই, করো না অহংকার। বাঁচার মতো বেঁচে থাকো, কাউকে করো না তিরস্কার। সত্যি তোমাদের পৃথিবীটা বড় চমৎকার!

গল্পটি সম্পুর্ন কাল্পনিক!

ছবি গুগল থেকে সংগ্রহ।   

 

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ