সেই ১৯৮০ শতাব্দীর কথা বা তারও আগের কথা।তখন মোবাইল বা প্রযুক্তির আধুনিক ছোয়াঁ নাই বললেই চলে।তাই জানা হয়নি অনেক হাদিস বিরোধী কাজের অকর্মগুলো।যখনি মসজিদ ইমাম সাহেব ঘোষনা দিতেন কিংবা শাবান আরবী মাসের পনের তারিখ দিবাগত পবিত্র শবে বরাত রাত আসতো তার বেশ কয়েক দিন পূর্বে হতেই আমাদের আমলের মা চাচীরা প্রস্তুতি নিতেন পবিত্র এই দিন রাত্রটির।প্রস্তুতি গুলো ছিলো প্রবল হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমিক।যা করতে তাদের অনেক শ্রম দিতে হলেও মনে ছিলো প্রফুল্ল ও ছোঁয়াব পাবার ইচ্ছে।যেমন ভাতের চাউল সিদ্ধ করে এক প্রকার টিনের ছিদ্রযুক্ত কোলা দিয়ে ফালা নামক নুডুসের মতন এক প্রকার  সু-স্বাধু খাদ্য তৈরী করতেন যা রোদ্রে শুকিয়ে পরবর্তীতে বালু দিয়ে ভেজে কেউ মিঠাইতে চুবিয়ে টিন ভর্তি করে কেউ আবার বাহারী রকমের পিঠা তৈরী করে তার সু-স্বাধুতে ব্যাস্ত সময় কাটায়।

মা চাচীদের শবে বরাতের পুরো দিনটিই কাটত হালুয়া রুটি বানাতে বানাতে।এই সব তৈরীকৃত খাদ্য জামাই বাড়ী হতে শুরু করে পাড়ার মসজিদে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে আদান প্রদান করতেন।সন্ধ্যা হলেই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা টিনের কৌটায় মোমবাতি জ্বালিয়ে,আতশবাজিঁ জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়াত এ পাড়ায় ও'পাড়ায়।এই সব নিষিদ্ধ কাজ করতে গিয়ে যদিও অনেক সময় মা চাচীদের শরিরে আসত সন্ধ্যা শেষে ক্লান্তিকর ভাব তবুও শবে বরাতের নামাজের কোন ব্যাঘাত ঘটায়নি।কালক্রমে সত্যতা পাওয়া গেলো এ সব করা কোন হাদিসেই নেই তাই এখন এ সব উৎসবের কিছুটা হ্রাস পেলেও কিছুটা রয়ে গেছে সামাজিক কালচার হিসাবে।
তবে সব চেয়ে বড় সতর্ক ও খেয়াল রাখতে হবে,
এ রাতে জাগ্রত থাকতে গিয়ে ফজরের নামাজ যেন বাদ না হয়ে যায়।কেননা,এ সারা রাত বিশেষ আমলও ফজরের ফরজ নামাজের বিকল্প বা সমতুল্য হতে পারবে না।যেহেতু,ফজরের নামাজ হচ্ছে ফরজ আর এ রাতের বিশেষ ইবাদত বন্দেগী হচ্ছে নফল।

মুসলিম বিশ্বের আরবী পঞ্ছিকার মতে আসছে শা’বান মাসের ১৪তম তারিখের দিবাগত রাত হচ্ছে- লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত।লাইলাতুল বারাআত হচ্ছে-গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের রাত্রি।অর্থাৎ, এ রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে মুমিন-মুসলামনদের গুনাহ মাফ হয়ে থাকে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি হয়ে থেকে।তাই এ রাতকে বলা হয়েছে লাইলাতুল বারাআত বা মুক্তির রাত।অন্য দিকে পবিত্র মাহে রমজানের পূর্বের মাস হওয়ার কারণে শাবান মাসকে বলা হয়েছে রমজান শরীফের প্রস্তুতির মাস।এ রাতেই আল্লাহ তার বান্দাদের রিজিক,হায়াত বন্টন করেন।সলামি তমদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে পাঁচটি রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিশেষ পাঁচটি রাত হলো: দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবে মেরাজ, শবে বরাত ও শবে কদর। যাঁরা রাতের ইবাদতের গুরুত্ব অনুধাবন করেন, তাঁরা প্রতিটি রাতকে শবে বরাত বানিয়ে নেন।

এ রাতের মানব জীবনে গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী(সাঃ) একদা বলেছিলেন "শাবান মাস হল আমার মাস আর পবিত্র রমজান মাস হল মহান আল্লাহ তাআলার মাস।তিনি আরও বলেন,তোমরা শাবানের চাঁদ সঠিক ভাবে হিসাব রাখ।কেননা শাবানের চাঁদের হিসাব ঠিক হলে,রমজানের চাঁদের হিসাব সঠিক হতে সহায়ক হবে।(মিশকাত শরীফ-১১৫পৃ )
এ রাতের গুরুত্ব:
শা’বান এবং শবে বারাআতের করণীয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ(সাঃ)এরশাদ করেন,শাবান মাসের রোযা আমার নিকট অন্য মাসের তুলনায় অধিক প্রিয়।যখন তোমাদের নিকট শাবানের রাত্রি(শবে বারাআত)উপস্থিত হবে,তখন তোমরা সেই রাতটি জাগ্রত থাকবে নামাজ পড়ে,কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে,তাসবীহ পড়ে,যিকির করে, দুআ করে  এবং দিনের বেলা রোযা রাখ।কারণ,এ রাতে মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর থেকে ফজর পর্যন্ত দুনিয়ার আসমানে তাশরীফ আনেন এবং তিনি ঘোষণা করেছেন-
(y) আছে কি এমন কোন ব্যক্তি যে, তার গুনাহ মাফীর জন্য আমার নিকট প্রার্থনা করবে? আমি তার গুনাহ সমূহ মাফ করে দিব।
(y) আছে কি এমন কোন রিযিক প্রার্থনাকারী,যে আমার নিকট রিযিক প্রার্থনা করবে? আমি তার রিযিকের ব্যবস্থা করে দিব।
(y) আছে কি এমন কোন বিপদগ্রস্ত, যে আমার নিকট বিপদ থেকে মুক্তি চাইবে? আমি তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করব।
এভাবে পূর্ণ রাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হতে থাকবে এবং বান্দাদের উপর রহমত বৃষ্টির ন্যায় নাজিল হতে থাকবে।(ইবনে মাজাহ শরীফ)
(y) মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) এক বার হযরত আয়েশা(রাঃ), হে আয়েশা! তুমি কি জান? আজ রাত নিসাফে বা শাবান কী? হযরত আয়েশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) বলেন,ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো জানি না, দয়া করে বলুন।মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বললেন,আজ রাতে আগামী বছরে যে সমস্ত বনী আদম জমীনের বুকে জন্মগ্রহণ করবে এবং আরা মৃত্যুবরণ করবে, তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে বান্দাদের আমলনামা মহান আল্লাহর নিকট প্রকাশ করা হয়।
(y) অন্য এক হাদিসে নবী করিম ( সাঃ) বলেছেন,আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে যা শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত, সৃষ্টির দিকে(রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং শিরক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
(y) হযরত আলা ইবনে হারিস ( রঃ) থেকে বর্ণিত,
হযরত আয়িশা ( রাঃ) বলেন,এক বার রাসূল(সাঃ)নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে,আমার ধারণা হয় তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন।আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধা ঙ্গুলি নাড়া দিলাম।তখন তাঁর বৃদ্ধা ঙ্গুলি নড়ল।যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন,তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,
হে আয়েশা বা ও হুমাইরা! তোমার কি এ আশংকা হয়েছে যে,আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন?
আমি বললাম, তা নয়, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা দেখে আমার আশংকা হয়েছিল,আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কিনা।
নবীজী(সাঃ)জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ( সাঃ ) ভাল জানেন।
রাসূল ( সাঃ ) বললেন, এটা হল অর্ধ শাবানের রাত।আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানে তাঁর বান্দাদের প্রতি নজর দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা কারীদের ক্ষমা করেন,অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন।আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।( বায়হাকী,৩য় খন্ড-৩৮২পৃ )
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া উত্তম,যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে।এ ছাড়াও এ রাতে কুরআন তেলাওয়াত,যিকির আযকার ইত্যাদি আমল করা যায়।
(y) এ বিষটি মনে রাখতে হবে, এ রাতের আমল সমূহ বিশুদ্ধ মতানুসারে সম্মিলিত নয়;নির্জনে একাকী ভাবে করা বাঞ্ছণীয়।পুরুষদের জন্য তো ফরয নামাজ অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে।তার পর তারা এবং মহিলারা যা কিছু নফল পয়রার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বেন।এ সব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীসে নেই।আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না-(ইকতিযাউস সিরাতুল মুস্তাকিম,২য় খন্ড-৬৩১পৃ,মারাকিল ফালাহ-২১৯পৃ)
(y) হযরত আশরাফ আলী থানভী(রঃ)-এর মতেঃ
তিনি বলেন হাদীসে শবে বরাতের তিনটি কাজ সুন্নত মত করাকে সওয়াব ও বরকত লাভের উপায় বলা হয়েছে।
(y) প্রথমতঃ পনেরো তারিখ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা।সাথে সাথে গরীব মিসকীনদের জন্য কিছু দান করে সে দানের সওয়াবটুকু ঐ মৃতদের নামে বখশে দিলে আরও ভাল হয়।সেই মুহূর্তে হাতে না থাকলে,অন্য সময় গোপনে কিছু দান করে দেওয়া।
(y) দ্বিতীয়তঃ রাত জেগে একা একা বা বিনা আমন্ত্রণে জড়ো হয়ে যাওয়া দু চার জনের সাথে ইবাদতে মশগুল থাকা।
(y) তৃতীয়তঃ শাবানের পনেরো তারিখে নফল রোযা রাখা।

"আল্লাহ তাআলা আমাদেরর সকলকে আমল করার তৌফিক দান করুন"
"আমীন"

 

0 Shares

৪টি মন্তব্য

  • ইঞ্জা

    ভাই, শবে বরাত নিয়ে কিছু দ্বিমত আছে, আরব দেশ গুলিতে শবে বরাতের কোন মূল্য নেই, সেইখানে শবেবরাত উদযাপন করা হয়না, শবে বরাত শুধু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে পালন করা হয়, এরপরেও শবেবরাতের উছিলায় হলেও দেশের মানুষ দলে দলে আল্লাহ্‌র ইবাদত করে এই বড় বিষয়।

  • মৌনতা রিতু

    হুম, সেজদার হাদিসটি শুনেছিলাম। আসলে কি মনির ভাই, নিত্য নতুন ফতোয়া আর নিয়মে মানুষ এখন নাজেহাল।হুম, ঠিক বলেছেন মনির ভাই, আগে মা খালা, মামিদের দেখতাম, হাতে মেহেদি পরতো। সারাদিন রুটি হালুয়া করে সন্ধ্যায় গোসল করে নামাজ পড়তো সবাইমিলে একসাথে। কতো মজার নির্মল আনন্দের দিন ছিলো সেগুলো। তজবিহ্ পড়তো সবাই। আমরা ছোটোরা জিকির করতাম তাদের সাথে। আমাদের মুন্সিবাড়িতে কেউ ঘুমাতো না ধরতে গেলে। ছিড়া দাদা ইমামতি করতো। আমার দাদা বেঁচে থাকতে তিনি করতেন। বিক্লে মিলাদ হতো ‘দানাদার’ একধরনের ছোটো ছোটো মিষ্টি দিয়ে, যা আমার খুবই প্রিয় ছিলো। সত্যিই, এতো মতভেদ ছিলো না, ছিলো না তাই হানাহানি। আর এখন নাকি নতুন করে আবারও কোরআন শরীফ পড়া শিখতে হবে। আমরা যা আগে পড়েছি তা নাকি ভুল!
    যাইহোক, বিশ্বাস আর মন থেকে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা এটাই বড় কথা। তা যে যেভাবে যখন ডাকুক।
    বরাবরের মতো ভাল তথ্যমূলক লেখা মনির ভাই।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ