নবজাতক ও চিরকুমারকাহিনী

শাহ আলম বাদশা ৯ আগস্ট ২০১৪, শনিবার, ০২:৩৯:৩৫অপরাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

পূর্বপ্রকাশিতের পর

সেদিন জ্বরের দরুণ কলেজে যায়নি কোরিয়া। পরীক্ষার বাকিমাত্র পনের দিন। কিছু জরুরি নোটের প্রয়োজনে কলেজে খুঁজে না পেয়ে কোরিয়ার বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় কাকলী। এর আগেও দুয়েকবার ওদের বাড়িতে এসেছিল সে। কলেজছুটির পরই রওনা দেয় কাকলী। ওর বাসা কলেজের কাছাকাছি হলেও কোরিয়ার বাড়ি থেকে আধামাইল দূরে। বিকেলের পথ-ঘাট ফাঁকা-ফাঁকা, ছোট্ট শহরের রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। প্রখর রোদ মাড়িয়ে রিক্সায় সে দ্রুতই চলে আসে। রিকসা থেকে নেমেই ডাক দেয়, কেরিয়া— এই কোরিয়া-। ডাকশুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে কোরিয়ার ছোটবোন, ওঃ আপনি, ভালো আছেন আপা? আসেন, ভাই ঘরেই আছে–

:কী সৌভাগ্য আমার, গরীবের ঘরে হাতির পা যে? কোরিয়াও ডাকশুনে বেরিয়ে আসে বাইরে।

এরপর ওর ছোটবোন চলে যায় অসুস্থ বাপের ঘরে আর কোরিয়া কাকলীকে নিয়ে ঢোকে নিজের ঘরে।

:শোন, দেরী করবো না কিন্তু। তোমার ইংরেজি আর পদার্থের নোট দুটো নিতে এসেছি, বরে কাকলী।

:নিয়ো, এত তাড়ার কী আছে। বসো, একটু চা-টা খাও-

:নাগো, দেরী হলে আবার কৈফিয়ত দিতে হবে, জানোই তো?

ঠিক আছে বসো, আমি নোটগুলো খুঁজি—বলেই কোরিয়া দ্রুত গিয়ে খিললাগিয়ে দেয় ওর ঘরের দরজায়।

:কী ব্যাপার, দরজা বন্ধ করলে কেন? কাকলী অজানা আতঙ্কে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

:না, মানে বহুদিন পর এলেতো; একান্তে কিছুকথা বলবো আরকি? বলামাত্রই ওকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কোরিয়া।

:ছিৎ ছিঃ কোরিয়া, ছাড়ো, ছেড়ে দাও, চিৎকার দেবো কিন্তু—বলে ওর বলিষ্ঠ বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে সে।

হঠাৎ চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তির আঁওয়াজ আর মেয়েলীকণ্ঠ শুনে পাশের ঘর থেকে ওর বাপ চেঁচিয়ে ওঠে- কোরিয়ার ঘরে কেরে, মা? এতেই ভয়ে কাকলীকে ছেড়ে দেয় সে। আর অমনি দরজাখুলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে যায় কাকলী। অতঃপর বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। দেখা হয়না দু’জনার সাথে দু’জনার। বরং এইচএসসি পাশের পর বিয়ে হয়ে যায় কাকলীর। ফলে কোরিয়াও ওয়াদা করে বসে, জীবনে সে আর বিয়েই করবেনা! আজ কিনা সেই চিরকুমার কোরিয়াই রেডিমেড সন্তানের বাপ? আবার ছেলের রেডিমেড মাতাও জুটেছে একখান—-এসব ভেবে আপনমনেই হাসে একচোট!

দুপুরের খাবার খেতে খেতে দুটো বেজে যায় কোরিয়ার। তখনও আসেনা ময়না। তাই কিছুটা টেনশনবোধ করে। ভাবে, মেয়েটা বড়বেশী খামখেয়ালী। তবে কি ওকে ক্ষেপানোর জন্যই দেরী করছে সে? অবশ্য ওরচে ময়নার কাছেই যে ভালো আছে এবং থাকবে ছেলেটা, এটা ভেবে পরক্ষণে শান্ত হয় । শরীরটা ক্লান্ত থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তায় আবার ডুবে যায় সে। নারীজীবনের পূর্ণতা ও সার্থকতা নাকি মাতৃত্বে। নতুবা পরিপূর্ণ বৈষয়িক সুখসম্ভোগের পরও নিঃসন্তান নারী অন্তর্জ্বালা নিয়েই বা মরে কেন? এইযে ময়না, একজন সন্তানহীনা নারী, স্বামীসুখ সম্ভোগের পর সাময়িক বঞ্চিত হলেও খুব একটা অসুখী থাকার কথা নয়। কিন্তু বন্ধ্যা হিসেবে সন্তানহীনতার যে অভাববোধ ও অতৃপ্তি তার কি কোন নিরাময় আছে! কেবলমাত্র একটি চাঁদমুখ সন্তানই পারে সে অভাব দূর করতে? একারণেই হয়তো বাচ্চাটা পেয়ে কিছুটা হলেও তৃপ্তির হাসি ফোটে ময়নার মুখে। এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যার আর বেশী দেরী নেই। মোরগ-মুরগীর কক-কক্ আঁওয়াজে আঙ্গিনা মুখরিত। নবজাতকের কথা স্মরণ হতেই দ্রুত ছুটে যায় ময়নাদের বাড়ি।

উঠোনে ময়নার বাবাকে দেখতে পেয়েই শুধায়–চাচা, ছাওয়া কই, ময়না কোনটে?

:একনা ব্যাড়বার গেইছে, এ্যালায় আইসপে—-বইসো ক্যানে, চাচা হেসে হেসে বলেন, খুব দেখি মায়া ধরি গেইছে বাহে?

কোরিয়া লজ্জায় মুখ ঢাকে যেন। এমন সময় দেখা যায়, বাচচা কোলে ময়না বাড়ির দিকেই আসছে। কোরিয়ার কেন যেন মনে হয়, কতদিন দেখেনা ছেলেটাকে। তাই কোলে নেয়ার লোভসামলাতে না পেরে ছুটে যায় ময়নার কাছে।

:কী ছাওয়ার বাপ, ছাওয়ার নাম তুইনেন, নাকি হামরায় থোমো? দেখা হওয়ামাত্র ময়না কৌতুক করে মিটিমিটি হাসতে থাকে।

:মুই বাপ হইলে তুই কি মা-ও নাকি, অ্যাঁ—-ঠাট্টার মোক্ষম একটা জবাব দিতে পেরে খুব খুশী হয় সে। কিন্তু ময়নার জবাব শুনেতো একেবারে থ’!

:মা-ও হইলেই বা কী, মোর তো বিয়াও হছলো, মা-ও কওয়া যায়। কিন্তু তোমরা বিয়াও না করি ছাওয়ার বাপ্ হন্ ক্যামন করি, কন তো?

পৌরুষে আঘাত লাঘায় চরম লজ্জায় ঘেমে ওঠে কোরিয়া। আর বাচ্চাকোলে হাসতে হাসতে পালায় ময়না। সে-ও পিছুপিছু চলে আসে ওদের বাড়িতে। ময়নার বিদ্রুপাত্মক কথাগুলো দারুণ ভাবিয়ে তোলে ওকে। কী ইঙ্গিত করে ময়না, বুঝতে বাকি থাকেনা ওর। সত্যিতো, বিবাহিত নারীকে অনায়াসে সন্তানের মা বলাই যায়। কিন্তু অবিবাহিত একজন পুরুষকে সন্তানের বাপ বলাটা হাস্যকর বৈকি? নাহ্, ওকে নতুন করে ভাবতে হবে বিয়ের ব্যাপারটা। কাকলী বিয়ে করে সুখী হলে, সে-ই বা বোকার মতো চিরকুমার থাকবে কেন? এতদিন পর বিয়ের সত্যিকার একটা যৌক্তিকতা যেন খুঁজে পায় সে! তাছাড়া ময়নার মতো মেয়েরা সংসারী ও গুণবতী। হোকনা সে এসএসসি ফেল, স্ত্রী হবার সবগুণ আছে ওর। আবার জোহর আলী চাচার মুখোমুখি হতেই সুখস্বপ্নগুলো কোথায় মিলিয়ে যায়। সুতরাং থতমত খেয়ে শাসনের ভঙ্গিতে প্রশ্নছুঁড়ে দেয় ময়নার দিকে, সারাদিন ছাওয়াটাক নিয়া গেলু না ক্যানে, ময়না?

:আব্বা কইল্, তোমরা চ্যাংড়া মানুষ, ইয়ার যন্তোনা সবার পাবার নন। তাই—-

:হ্যাঁ বাহে, তোমার বউ-বাচ্চা নাই; খুব কষ্ট হইবে তোমার। কথাটা আগোৎ কবার চাচনু, এ্যালা কং। মোর ময়না মা-ই পুষুক বাচ্চাটাক, কী কন বাহে? কথাকেড়ে নিয়ে মেয়ের পক্ষেই একটানা বলে যান চাচা।

কোরিয়ার ভাবান্তর বোঝা যায়না এতে, মনে হয় খুশীই হয়! কারণ ছেলেটা মাতৃস্নেহে মানুষ হবে, এটাইতো পরম পাওয়া? কিন্তু ময়নার কাছে মানুষ হলে ছেলেটা কি চিনবে ওকে, বাবা বলেও ডাকবেতো–এটাই ওর দুশ্চিন্তা? তবে বাচ্চাটার স্বার্থে মনকষাকষিতেও যেতে চায়না সে। তাই মাথানেড়ে সম্মতি জানিয়ে ভারমুক্ত হয়ে চলে যায় বাড়ীতে।

ময়নার সাথে কোরিয়ার বিয়ের আয়োজন চুড়ান্ত, জমজমাট বিয়ের আসর! বিয়ের আসরে কাজী এবং মাওলানাও প্রস্ত্তত। ওর মনে আজ অব্যক্ত আনন্দের ঢেউ! কিন্তু হঠাৎ ঘরের মোরগগুলোর সমবেত কুক্ কুরু কুক্ চিৎকারে সুখস্বপ্নটা টুটে যায় হঠাৎ? সুখানুভূতিটা এখনো লেগে আছে ওর মনে! রাতে ঘুমানোর আগে সে ময়নাকে বিয়ের পাকাপোক্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে নেয় সে। হয়তো এরই প্রতিফলন ঘটে স্বপ্নে, ভেবে খুব ভালো লাগে ওর। ফজরের আজান হবে হবে, চারিদিকে হালকা কুয়াশার ভাব। ব্রাশ করতে করতে মসজিদের দিকে রওনা দেয় সে। যতোই এগোয় শীতার্ত প্রকৃতিটা ততোই ধোঁয়াটে ও ঘোলাটে দেখা যায়। বড়রাস্তা ধরে দ্রুততালে হাঁটতে থাকে সে। ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলে তাকেই বিয়ের ঘটক করে পাঠাবে আজ। বিয়ের আনন্দে আবেগতাড়িত সে, পা’দুটো তাই এমনিতেই দৌঁড়ায় যেন!

বিকেলে জ্ঞান ফিরলে পরিস্থিতি কিছুই বুঝে উঠে পারেনা। প্রথমে সে চোখেও দেখতে পায়না কিছুই? শরীরে প্রচন্ড বেদনা অনুভব করলেও চোখ কচলাতে কচলাতে সামনে তাকানোর কোশেশ করে। কোনকিছু যেমন ঠাঁওর করতে পারেনা তেমনি সামনের সবকিছুই ধোঁয়াটে-অস্পষ্ট মনে হয়। কিন্তু কিছু ভুতুরে চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে সে এবং তড়িঘড়ি শোয়া থেকে উঠে বসতে গিয়েই ’উহ্’ বলে পড়ে যায় বেডে। আমি কোথায়, তোমরা কারা, সঙ্গেসঙ্গে ভয়ার্ত প্রশ্নও করে বসে!

:আমরা নার্স, এটা হাসপাতাল। আপনি এক্সিডেন্ট করেছেন, একজন জবাব দেয়।

:উহ্ বাবারে, আমার পায়ে কী হয়েছে; উঠে বসতে গিয়ে সদ্য অপারেশনকৃত পায়ের ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে? কিন্তু ব্যালান্স হারিয়ে বেডে পড়ে গিয়ে ডুঁকরে কেঁদে ওঠে আমার পা কই, আমার পা—–

:আপনি নড়াচড়া করবেন না, শুয়ে পড়ুন—নার্সরা ওকে জোর করে বেডে শুইয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে।

:কোরিয়া ভাই, চিন্তা করেন না, ভাল্ হয়য়া যাইমেন্—-। ময়নাও বুকফাঁটা কান্না চেপে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়, ভয় কিসের হামরা আছি না!

:এ মূহুর্তে কোরিয়া না বুঝলেও ময়না ঠিকই জানে যে, সে আর কোনদিন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না। ঘাতক ট্রাক ওর দুটো পা-ই হাঁটু পর্যন্ত চূরমার করে দিয়েছে। ভাল্ মানুষটার যে কী হয়য়া গ্যালো, বাচ্চার জন্যও আর কোনদিন কিছু কিনবার যাবার পাবার নয়? আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ময়না। অবশ্য সেও যে, কোরিয়াকে নিয়ে রঙিনস্বপ্ন দেখেনি তা কিন্তু অস্বীকার করা যাবেনা। এ মুহূর্তে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া এবং প্রচণ্ড বেদনায় ময়নার চোখফেটে তাই অশ্রুঝরে টপ-টপ-টপ্——।

আর সেই অশ্রু কোলের শিশুর চোখে-মুখে পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে-ওয়া—ওঁয়া—ওঁয়া বলে। নবজাতকের কান্নায় যেন সম্বিৎ ফিরে পায় কোরিয়া, কী হৈল্ ময়না, ছাওয়াটা কান্দে ক্যা? দে’তো মোর কোলোত্— বলে শুয়ে থেকেই হাতবাড়ানোর চেষ্টা করে ময়নার দিকে!! (শেষ)

আগের পর্ব পড়ুন

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ