নদী (২০তম পর্ব)

ইঞ্জা ১৭ মে ২০১৭, বুধবার, ১১:৪২:৪১অপরাহ্ন গল্প ২৪ মন্তব্য

images-2

 

রাতে খাওয়ার পর জীবনের মা জীবনকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসেছে গল্প করছেন, এক সময় মিনা, অনিক, অন্য ভাই আর ভাইদের বউ সবাই এসে ড্রয়িং রুমে গল্পে যোগ দিলো, সবাই আসার পর জীবনের মা কথা তুললেন।
জীবন, মেয়েটা তো বড় হচ্ছে, তা বিয়ে তা তো একটা করা উচিত, আর কতোদিন এইভাবে একা থাকবি?
না মা, বিয়ে করা আমার দ্বারা সম্ভব না, জবাবে জীবন বললো।
কেন কি সমস্যা?
বোঝোই তো, মেয়ে বড় হচ্ছে, এখন অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসলে সেই মেয়েটা যদি আমার মেয়েকে মেনে না নেয়, তাহলে হিতে বিপরীত হবে।
সমস্যা যেন না হয় তেমন একটা মেয়েকে বিয়ে করবি।
না মা, কার মনে কি আছে কি ভাবে বুঝবো, সম্ভব না, তুমি এই বিষয়টা বাদ দাও।
ভাইয়া তেমন একটা ভালো মেয়ে আমি দেখে রেখেছি তোমার জন্য, মিনা হেসে বললো।
এই তুই চুপ থাক, তুই এখনো ছোট, তুই এসবের কি বুঝিস, জীবন ধমক লাগালো।
জীবন, তুই সমস্যাকে এড়াতে চাইলে কি সমস্যা তোকে ছাড়বে?
কেন এমন বলছো মা?
মেয়েটা মা খুঁজতেছে, তুই বুঝিসনা?
ভাইয়া, নাবিলার একটা মা দরকার, মেঝ বউ বলে উঠলো।
রুকসানা ঠিকই বলছে, আমার দাদুরীর মা দরকার, এইটা তোর এতদিনে বুঝা উচিত ছিলো।
মা বুঝি, কিন্তু মেয়েদের প্রতি আমার ভরসা আর নেই।
দেখ তোর বউ যা করেছে তা সব মেয়ে করেনা, ওই মেয়েটা ছিলো একটা ডাইনি, যে নিজের বাচ্চাকেও ছেড়ে চলে গেলো কিন্তু আমার দাদুরী এইভাবে একা একা থাকবে তা তো ঠিক না, মেয়ে যখন বড় হয় তখন বাপের চাইতে মার দরকার বেশি হয়, যা তুই বুঝবিনা।
মা সম্ভব না, তুমি এই কথা বাদ দাও, বলেই জীবন মিনাকে বললো, এই তুই রুমে গিয়ে বড় ব্যাগটা নিয়ে আয়।

মিনা গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে এলো টানতে টানতে, জীবন ব্যাগটা খুলে মার জন্য আনা একটা শাড়ী নিয়ে এগিয়ে দিলো।
জীবনের মা বললো, এইগুলা এখন রাখ, আগে আমার সাথে কথা বল, এগুলা পরেও দেওয়া যাবে।
মা, বলেছি তো, এমন ভালো মেয়ে কই পাবে, নাবিলার মাও তো ভালো ছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হলো দেখেছো তো।
আমার কাছে মেয়ে আছে এবং তুইও চিনিস, জীবনের মা হেসে হেসে বললেন।
কে মা, অবাক হয়ে জীবন তাকালো মার প্রতি।
যার কাছে আমার দাদুরী এই মূহুর্তে আছে।
জীবন চমকে উঠলো, প্রথমে আমতা আমতা করলো, তারপর বললো, মা নদী কিন্তু খুব অসহায় একটা মেয়ে, ওকে আমি আশ্রয় দিয়েছি সময়ে।
তাতে কি হয়েছে?
না মা, এইটা সম্ভব না, আমি বিয়ের প্রস্তাব দিলে উনি মাইন্ড করতে পারেন, উনি হয়ত ভাববেন আমি উনার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি।
ধুরর কি যা তা বলছিস, আমার দাদুরীকে ওই মেয়েটা যে ভাবে ভালোবাসে শুনলাম, আবার দাদুরীও মেয়েটাকে ভালোবাসে, এইসব তোর চোখের সামনেই ছিলো, দেখিসনি?
দেখেছি মা, কিন্তু?
কিন্তু কিসের, ওই মেয়েটা শুনেছি আগামী মাসে তোর বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠবে, তখন তোর মেয়ের কি হবে চিন্তা করেছিস, মেয়েটা তো পাগল হয়ে যাবে।
কি বলছো মা, চিন্তিত হয়ে উঠলো জীবন।
বাবা, তুই আর না করিস না, আমি এখনই মেয়েটার মার সাথে কথা বলবো, উনাকে আমি প্রস্তাব দেবো।
মা, বিষয়টা বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেলোনা?
না, বরঞ্চ দেরি হয়ে যাচ্ছে, মিনার বিয়ের আগেই তোর বিয়ে হবে।
জীবন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, তাহলে একটু অপেক্ষা করো, আমি নদীর মতামত জানতে চাই।
ঠিক আছে, তুই কথা বলে দেখ।

জীবন উঠে নিজ রুমে চলে এলো, মনটা খুব এলোমেলো হয়ে রয়েছে, ভাবছে নদীকে ও কি বলবে, নদী কিভাবে রিএ্যাকট করবে, নদী ওকে ভুল বুঝবেনা তো?
এক সময় জীবন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, সেলফোনটা নিয়ে সাগরের নাম্বারে কল দিলো।
অপর পাশে একটা রিং হতেই সাগরের গলা ভেসে এলো, আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
আমি জীবন বলছি।
ভাইয়া, জি ভাইয়া বলুন।
নাবিলা কেমন আছে, ও কোনো ডিস্টার্ব করছে না তো?
না না ভাইয়া, ও অনেক লক্ষি মেয়ে, এই মাত্র আপু ওকে খাইয়ে দিলো।
তাই, তা তোমার আপুকে একটু দিতে পারবে?
শিওর ভাইয়া, একটু হোল্ড করুন।
একটু পর নদীর কণ্ঠ শোনা গেল, হ্যালো জীবন।
জি কেমন আছেন, নাবিলা ডিস্টার্ব করছে নাতো?
আরে না না, আপনি তো জানেন, ও আমাকে খুব পছন্দ করে, এই কিছুক্ষণ আগে আম্মা ওকে কোলে তুলে নিয়ে গেলো, ফ্রুটস খাওয়াবে বলে।
তাই খুব ভালো, তা,রাতে থাকবে তো ও, নাকি কান্নাকাটি করবে?
না না করবেনা, ওর অভ্যাস হয়ে গেছে, ও আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবেনা, দেখুন না ওর জ্বর পর্যন্ত চলে গেছে।
আপনি যখন অন্য বাসায় উঠবেন, তখন কি হবে ওর?
নদী চমকে উঠে চুপ হয়ে গেল।
কি জবাব দিলেন না?
মানে মানে..
আপনি চিন্তায় পড়ে গেছেন?
হুম।
আমার মা যখন একি প্রশ্ন করলো আমিও কিছু বলতে পারি নাই।
নদী চুপ করে রইল।
মা আমাকে খুব চাপাচাপি করছে বিয়ে করার জন্য।
ওই দিকে নদীর বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো নাবিলার কথা ভেবে।
আমি না করে দিয়েছিলাম, কিন্তু মা শুনতে রাজি না।
নদী নিশ্বাস চেপে শুনছে।
এখন কি করি বলুন তো, জীবন জিজ্ঞেস করলো, অচেনা অজানা একটা মেয়েকে আমি আমার মেয়ের মা করে আনলে, যদি নতুন মেয়েটা আমার মেয়েকে অবহেলা করে।
নদী আর চুপ থাকতে পারলোনা, মুখ ফসকে বললো, না না আপনি এমন কিছু করতে পারেন না, নাবিলার ক্ষতি হয়ে যাবে।
তাহলে কি করবো বলুন?

নদী কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলো, তারপর বললো, আপনি কি করতে চান?
আমি এমন কাউকে চাইছি যে নাবিলাকে নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবাসা দেবে, আগলিয়ে রাখবে সব সময়, ওর সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে তার নতুন মা।
এমন মেয়ে কি খালাম্মা পেয়েছেন, নদী উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো?
হুম পেয়েছেন।
আপনি দেখেছেন মেয়েটিকে?
হুম দেখেছি।
নদী একদম চুপ মেরে গেল, মনে হাহাকার যেন।
কি কিছু বলছেন না যে, জীবন জিজ্ঞেস করলো।
বড় একটা নিশ্বাস ফেলার আওয়াজ পেলো জীবন, তারপর শুনলো নদী বলছে, আসলে আমি কি বলবো, এ আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।
নদী, আপনি যদি মাইন্ড না করেন একটা কথা বলতে চাই?
জি বলুন।
আপনি আমার নাবিলার মা হতে চাইবেন?
নদী চমকে উঠলো, জি কি কি বললেন?
নদী, আপনি ঠিকই শুনেছেন, আমার মেয়ের জন্য একজন উত্তম মার দরকার, কথাটিকে আমার দৃষ্টতা যদি মনে না করেন, একটু ভেবে দেখবেন কি বিষয়টা?
নদীর চোখের কোণে পানি জমে চিকচিক করছে, একটা আঙ্গুল দিয়ে নদী তা মুছে বললো, খালাম্মা কাকে পছন্দ করেছেন?
আপনাকে।
আর আপনি?
জীবন চুপ করে থাকলো।
কি বললেন না, নদী তাগাদা দিলো।
আপনি রাজি থাকলে আমি খুশি হবো।
খালাম্মা কি আসবেন?
মা মনে হয় আপনার আম্মা, মানে খালাম্মার সাথে এখন কথা বলবেন।
কিন্তু আমি এই বিয়েতে রাজি না।
জীবন থমকে গেল, জিজ্ঞেস করলো, আপনার অন্য কোনো চিন্তাভাবনা আছে, থাকলে...
মুখের কথা কেড়ে নিলো নদী, আমি আমার স্বামীকে আপনি আপনি করতে পারবোনা।
জীবন চমকে উঠলো, তারপর হেসে দিলো, ওকে অসুবিধা নেই, আপনি ওহ সরি তুমি আমাকে তুমি করেই বলতে পারো।
নদীও হাসতে লাগলো।

জীবন রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো মার পাশে।
কি হলো, নদী কি বললো?
মা তুমি ওর মার সাথে কথা বলতে পারো।
পারো নয়, আমি অলরেডি কথা বলেছি, আগামী পরশু দিন তোদের বিয়ে হবে, বেয়াইনের সাথে আমার কথা হয়েছে, আসরের নামাজের পর আকদ হবে।
জীবন হা হয়ে শুনলো, তারপর চোখ নামিয়ে বললো, একটু অপেক্ষাও করতে পারলে না মা।
পরদিনঃ
মা, ভাই বোন আর বউরা বেড়িয়ে গেল বিয়ের শপিং করতে, জীবন একা রুমে বসে আছে, সেলফোন বাজছে দেখে জীবন ফোন নিয়ে দেখলো অচেনা নাম্বার, রিসিভ করে হ্যালো বললো।
জীবন আমি, নদী।
কি খবর, কেমন আছো?
জীবন, ভাবছিলাম তোমার মেয়ের সাথে কথা বলা কি উচিত না?
মানে, বুঝি নাই?
এই যে যার জন্য আমরা বিয়ে করবো, তাকে আমরা জানাবো না?
তা তো ঠিক।
তাহলে এক কাজ করো, আমাদের পাশেই যমুনা ফিউচার পার্কের ফুড কোর্টে চলে আসো, ওখানে খাবো আর মেয়ের সাথে কথাও হবে।
ঠিক আছে, গাড়ী একটাও নেই, আমি সিএনজি নিয়ে আসছি, আসতে আসতে ঘন্টা খানেক লাগবে।
ঠিক আছে, চলে আসো।
জীবন পোঁছে কল দিলো, কোথায় তোমরা?
তুমি লিফট থেকে নামলেই হাতের ডানের রেস্টুরেন্টটি।
ওকে পেয়েছি বলেই ফোন কেটে দিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো, এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলো নাবিলা ছুটে আসছে, জীবন দুই হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খেলো।
ড্যাড তুমি এসেছো দেখে আমি খুব হ্যাপি।
তাই, তোমার আন্টি কই?
আন্টি ঐ দিকে।
চলো যায়, মেয়েকে কোলে নিয়েই নদী কাছে গেলো জীবন বললো, হাই।
হাই, জীবন বসলে নাবিলা জীবনের কোল থেকে নেমে গিয়ে নদীর কোলে বসলো।

বেবি এইদিকে আসো, ড্যাডের কোলে।
নাবিলা নদীর কোল থেকে নেমে জীবনের কোলে গিয়ে বসলো।
সুইট হার্ট, আন্টিকে তোমার কেমন লাগে?
খুব খুব ভালো, এত্তো এত্তো ভালো, দুই হাত দুই দিকে মেলে দিয়ে বুঝাতে চাইলো কতো বেশি ভালো।
তোমার আন্টি তো লন্ডনে ফিরে গিয়ে নতুন বাসায় চলে যাবে, তখন তুমি কি করবে?
কেন যাবে, মেয়ের সরল প্রশ্ন।
ওমা যাবেনা, উনি তো আমাদের বাসায় এইভাবে থাকতে পারবেন না।
কেন পারবে না?
এইটা তো উনার বাসা না বেবি।
তাহলে আমি যেতে দেবোনা, আন্টি তুমি যাবেনা, তুমি আমার সাথে থাকবে, ওকে?
নদী মিষ্টি হাসলো।
বেবি, আন্টি যেন যেতে না পারে, সেই জন্য তোমার আন্টিকে তোমার মম হতে হবে।
মম, নাবিলা একটু চিন্তা করলো তারপর বললো, ওকে আন্টি আমার মম হবে।
তাহলে তো তোমার মমকে জিজ্ঞেস করো, উনি তোমার মম হবে কি না?
মম, তুমি আমার মম হবে?
নদী হাত বাড়ালে নাবিলা তড়িঘড়ি করে জীবনের কোল থেকে নেমে নদীর কোলে গিয়ে বসেই জিজ্ঞেস করলো, বলোনা, তুমি আমার মম হবে?
হাঁ মামনি, আমিই তোমার মম হবো, নদীর চোখে পানি ছলছল করছে, নদী নাবিলাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
মম, নাবিলা আদুরে গলায় ডাকলো।

ছয় মাস পরঃ

আআআআআ চিৎকারে জীবনের ঘুম ভেঙ্গে গেল, জীবন লাফ দিয়ে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে, কি হয়েছে?
আমার পেইন হচ্ছে, দেখছোনা, নদী ফোঁফাতে ফোঁফাতে জবাব দিলো।
পেইন হচ্ছে, পেইন হচ্ছে চিৎকার করে উল্লাসিত জীবন দৌড় দিয়ে পাশের রুমে গিয়ে ওর মা আরর শাশুড়িকে ডাক দিলো, মা মা বেবি আসতেছে, বলেই আবার নিজ রুমে গেলো, দ্রুত ফোন তুলে নিয়ে ৯১১ এ কল দিয়ে এম্বুলেন্স পাঠানোর, ফোন কেটে দিয়ে বললো, এম্বুলেন্স আসতেছে, বলেই দ্রুত নদীর জিনিষ পত্র ঘুচাতে শুরু করলো।
নদীর মা আর জীবনের মা নাবিলাকে নিয়ে পড়িমরি করে বেডরুমে এলো, জীবন উনাদের গত কয়েকদিন আগে লন্ডনে নিয়ে এসেছে।
নাবিলা জিজ্ঞেস করছে, মম মম তুমি এমন কেন করছো?
মামনি, বেবি আসতেছে, নদী কষ্টে কাতরাতে কাতরাতে জবাব দিলো।
মা তোমরা থাকো, আমি নদীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি, বলেই জীবন নদীকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে গেল।
জীবন আমরা যাবো, নদীর মা বললেন।
আচ্ছা মা আপনি আসুন, মা তুমি তোমার নাতনিকে নিয়ে থাকো, ড্রয়িং রুমের সোফায় নদীকে বসিয়ে জীবন সামনের দরজা খুলে এম্বুলেন্সের অপেক্ষা করতে লাগলো।

সমাপ্ত

ছবিঃ Google.

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ