প্রফেসর জোহার মৃত্যু ও গণঅভ্যূত্থান

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তখন ১৯৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফার দাবিতে এবং শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে উত্তাল। ১৯৬৯ সালের শুরুতে ৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১১ দফা দাবির পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে তাদের আন্দোলন শুরু করে। ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি পুলিশ। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নাম্বার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এই খবর প্রচারিত হতেই ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় বের হয়ে মন্ত্রীদের বাড়িসহ অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বাসায় আগুন লাগিয়ে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সরকার সান্ধ্যকালীন আইন জারি করে।

 

১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। শামসুজ্জোহা বুঝতে পারলেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা আছে, তাই তিনি জীবনবাজি রেখে ছাত্রদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সেনাসদস্যদের সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন শামসুজ্জোহাএবং বলেন-আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবেনা,যদি গুলি বর্ষণ হয় তবে কোন ছেলের গায়ে লাগার পূর্বে আমার গায়ে লাগবে”। ক্যাপ্টেন হাবীব নামে এক মিলিটারি সেদিন ছাত্রদের ওপর গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেদিন ড. জোহার সব কথা উপেক্ষা করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর পথ অনুসরণ করে মুক্তিকামী মানুষের জন্য বীরের মত জীবন দিলেন নূরুল ইসলাম ও আবদুস ছাত্তার। এ খবর রেডিওতে প্রচার হবার পর কারফিউ ভঙ্গ করে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। প্রকৃতপক্ষে ঐ রাতেই গনঅভ্যূত্থ্যান চূড়ান্ত রুপ নেয়। সে রাতে রাস্তায় নেমে আসা নাম না জানা সাধারণ মানুষদের অনেই শহীদ হয়েছিলেন যাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস আমরা ভুলে গেছি হয়তো।

 

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্রনেতা আবদুর রহমানের ভাষ্য মতে, “ড. জোহার মৃত্যুর আগের দিন ১৭ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি, আগরতলা ষঢ়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, সার্জেন্ট জহুর হত্যা, নির্যাতনের প্রতিবাদ,মনি সিং সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট আহবান করা হয়েছিল। ধর্মঘট চলাকালীন দুপুরে বিনা প্ররোচনায় ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ওপর পুলিশ লাটিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ১৩ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। আহত রক্তাক্ত ১২/১৪ ছাত্রকে একটি ছোট গাড়ীতে ঠাসাঠাসি করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ সময়ে প্রক্টর হিসেবে ড. জোহা সবসময় বিপদগ্রস্থ ছাত্রদের পাশে ছিলেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাজ্ঞনে ছাত্র শিক্ষকদের প্রতিবাদ সভায় ড. জোহার আবেকময় বক্তব্য ছাত্র শিক্ষকদের যেমন ব্যাথিত করেছিল, তেমনি স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের দৃঢ় অঙ্গীকারের শপথ নেয়ার ক্ষেত্রেও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেছিলেন,“ সিরাজদ্দৌলাকে অন্ধকুপ হত্যার মিথ্যা দূর্নাম দেয়া হয়েছিল। আজ অন্ধকূপ দেখে এসেছি। ছোট্ট একটা গাড়ীতে বার চোদ্দজন রক্তাক্তদেহী ছাত্রকে ঠাসাঠাসিকরে তোলা হয়েছিল। আমার ছেলের রক্তের দাগ আমার গায়ে লেগেছে সেজন্য আমি গর্বিত…”

এর ৫ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত ড. জোহাকে আহত অবস্থায় কাজলা গেটের সামনে থেকে উদ্ধার করে নেয়া নেয়া হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। অপারেশন থিয়েটারে ড. জোহাকে নেয়ার পর হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত প্রফেসর শামস্-উল হক ও সাবেক ঐ ছাত্র নেতা আবদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ড. জোহার দেহ পোষ্টমর্টেম করার সময় যে সমস্ত চিকিৎসক ছিলেন তাঁদের চাপ দিয়েও পাকিস্তান সরকার গুলিতে নিহত হওয়ার সার্টিফিকেট আদায় করতে পারেনি। কিন্তু শহীদ আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ড. জোহার মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে জনতা ফুসে ওঠে ও গণঅভ্যূত্থান বেগবান হয়।

 

ভাষাসৈনিক জোহা

অন্যায়ের সাথে আপোষহীন ড. জোহা ভাষা আন্দোলনেরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন যদিও তার নাম গণ অভ্যুত্থানের সাথেই জড়িয়ে আছে বেশি। ভাষাসৈনিক ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ভাষার দাবিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হলে সেই বিক্ষোভে ড. জোহা ছিলেন সামনে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যেছাত্র সমাবেশ হয় সেখানে সক্রিয় উপস্থিতির জন্য পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকের মতো তিনিও আহত হন। পুলিশের গুলিতে জব্বার-রফিক শহীদ হন।সালাম ও বরকতকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মেডিক্যালের ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতায় শহীদের রক্তমাখা জামা সংগ্রহ করে প্রতিবাদ হিসেবে সলিমুল্লাহ হলের সামনে টানিয়ে দেন ড.জোহা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ছাত্র মুহাম্মদ দারা ও মুরাদ খয়েরী খুব সহজে উর্দু ভাষায় বাংলা ভাষার পক্ষে সে সময়ের পাকিস্তান সরকারের ন্যক্কারজনক মনোভাব ও আচরণ গণমাধ্যমে তুলে ধরেন।পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সংবাদ দেওয়া, সংগঠিত করার জন্য ড. জোহার উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নেতার মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান কাজে তিন সদস্যবিশিষ্ট (মো. আবুল কাশেম, ২. শামসুজ্জোহা, ৩. মো. আশরাফুল হক) সাইকেল বাহিনী গড়ে ওঠে। তাদের কাজ ছিল, যেভাবে হোক আইবি’র লোকদের চোখকে ফাঁকিদিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার কাছে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া ও সবাইকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য মনোবল অটুট রাখা। বড় রাস্তা ব্যবহার না করে তারা অলি-গলি ব্যবহার করতেন। কখনও বিপদের মখোমুখি হলে ঢাকার যেকোনো বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। এছাড়াও আরো অনেক আন্দোলনেই জোহার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

...............................................................................................................................................................

ডঃ সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহার জন্ম ১ মে, ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায়। প্রফেসর জোহাকে এদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবি হিসেবে গন্য করা হয়। দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে জোহা সপরিবারে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনা জেলার উল্লাপাড়া থানার বড় পাঙ্গাসীতে চলেআসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে স্নাতক সম্মান শ্রেনীতে ভর্তি হন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আবাসিক হন।

১৯৫৩ সালে রসায়ন বিভাগে বিএসসি অনার্স, ১৯৫৪ সালে এমএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন।পরে ১৯৫৭ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১ সালে। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন ১৯৬৮ সালের উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কাধে তুলে দেয় প্রক্টরের সুবিশাল ও মহান দায়িত্ব।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন নিলুফার ইয়াসমিনের সাথে এবং ১৯৬৬ সালে তাদের একমাত্র কন্যা সাবিনা জোহার জন্ম হয়।

তাঁর মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হল। নাটোরে তাঁর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিবছর ‘জোহা সিম্পজিয়াম’ পালন করে।

তার প্রয়াণ দিবসে আমাদের কামনা, যুগে যুগে শামসুজ্জোহার মতো এমন মহান দেশপ্রেমিক জন্ম নিক যারা হবে অন্যায়ের প্রশ্নে আপোষহীন ও প্রতিবাদী।

 

 

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ