জ্বালা এবং জ্বালা-পোড়া

সাবিনা ইয়াসমিন ২৩ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ০৮:৩৭:০৩অপরাহ্ন গল্প ৪০ মন্তব্য

জ্বালা_

বৈশাখের দুপুরে ভাতঘুমের অলসতা ভেঙে গ্রামের সকল নারী-পুরুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হয়েছে গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত একমাত্র বট গাছটার নীচে। একটু পরেই সালিশ শুরু হবে। গ্রামের মাথা কিসমত আলি সাহেব । তিনি প্রতি শুক্রবার গ্রামের মুসল্লিদের জুম্মার নামাজ পড়ানোর কারণে প্রধান ইমাম সাহেবের পদটাও ধরে রেখেছেন, তিনি সালিশ ডেকেছেন। অন্যান্যরা এসেছেন বিষয়টি জানতে ও দেখতে।

অভিযোগ শোনালো কিসমত আলির বডিগার্ড-বার্তাবাহক-একান্ত চামচা নুরু মিয়া। তার ভাষ্যমতে জানা গেলো, প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর ছাত্র-ছাত্রী সব বাড়ি চলে গেলেও স্কুলের গণিত শিক্ষক সাগর ও সহকারি প্রধান শিক্ষিকা লতা বাড়ি যায় না। তারা দুজন সন্ধ্যা পর্যন্ত একসাথে বসে স্কুলের রুমে কি জানি করে। নুরু কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে পেয়েছে তারা চেয়ার টেবিলে বসে হাসা-হাসি করে আর খাতায় কিসব লেখে। তবে গতকাল দেখেছে মারাত্বক ঘটনা। লতা আপাকে সাগর স্যার একটার পর একটা মিষ্টি নিজের হাতে খাওয়াচ্ছিলো। লতা আপা চার নম্বর মিষ্টিটা খেতে চাইছিলো না, তাই সাগর স্যার লতা আপার গাল ধরে জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। লতা আপা সাগর স্যারের উপর রাগ না করে হাসতে হাসতে সাগরের পিঠে দুটো কিল বসিয়ে দিয়েছিলো। এই দৃশ্য নুরু মিয়া আর সহ্য করতে পারেনি। দৌড়ে এসে কিসমত আলিকে সবিস্তারে জানিয়েছে। কিসমত আলি খুবই ধর্ম পরায়ণ ব্যাক্তি। সে সাগর ও লতাকে গ্রাম্য সালিশে ডেকেছেন। এসব নোংরামির বিচার গ্রামবাসীর সামনে করা উচিৎ, গ্রামবাসীদের কেও তিনি ডেকেছেন। বিচার শুরু হলো...

কিসমত আলি - সাগর সাহেব আপনি বিবাহিত মানুষ, ঘর সংসার আছে। তারপরেও এইকামডা ক্যামনে করলেন ! শিক্ষিত মানুষের লজ্জা শরম কম থাকে জানতাম, তাই বইলা এতো অধঃপতন ? ছিঃ ছিঃ পোলাপাইনেরে কি এসব শিখাইতে স্কুলে আসেন !!

সাগর- এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে মাতবর সাহেব। আমাদের নিয়ে আপনারা যা সন্দেহ করেছেন, তা ঠিক নয়। আমাদের স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। অনেকের পর্যাপ্ত বই কেনার টাকাও নেই। কিন্তু তারা ভালো করে পড়াশোনা করতে চায়। এরা যেনো পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারে সেটা ভেবে আমি ও লতা ম্যাডাম এদেরকে বই ও নোট হাতে লিখে কপি করে দেই। অন্যান্য শিক্ষকরাও মাঝে মাঝে এটা করে। লতা ও আমি একে-অপরকে সাহায্য করি। একই স্কুলে কাজ করার সুবাদে আমার ও লতার মাঝে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আমরা বন্ধু।

কিসমত আলি- তাই বলে স্কুল ছুটির পর মিষ্টি খাওয়া, কিলাকিলি করা, এসব কি সাহায্যে আসে আপনাদের ! আর নারী-পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় এ্যামুন কথা কেউ কোনোদিন শুনছে ? আমাদের সবাইরে কি বেকুব মনে করেন ? শোনেন, এসব নষ্টামি এই গ্রামে চলবে না। আপনি আজই আপনার বউ-বাচ্চা আর জিনিস পত্র নিয়া গ্রাম ছাড়বেন। লতা এই গ্রামের মাইয়্যা, তার বিয়া-শাদি হয় নাই, বাপ মইরা গেছে। বুড়া মায়ের দেখাশোনা আর ম্যাডাম গিরি করতে করতে নিজেও আধবুড়ো হয়ে গেছে। তাই তারে মাফ করে দেয়া হলো। এই বয়সে এই মাইয়্যারে গ্রাম ছাড়া কইরা আর পাপের ভাগি হইতে চাইনা।

গ্রামের মানুষ সবাই কিসমত আলির রায় মেনে নিলো। দু-চার জন বাপ-মা ,যাদের ছেলেমেয়ে দের সাগর আর লতা নোটবই বানিয়ে দিতো, তারাও  কিছু বলার চেষ্টা করলো না। কে চায় এসব নোংরামিতে সমর্থন দিতে !

লতা এতক্ষণ সব শুনছিলো। এমনকি বিচারের রায় দেয়ার পরেও সে কিছু বলেনি। চুপচাপ দাড়িয়ে দেখেছে/শুনেছে। প্রায় সবাই চলে যাওয়ার পর সে সাগরের সামনে এসে বললো-

সাগর তোমাদের সাথে আমার জন্যেও দুটো বাসের টিকিট এনো প্লিজ। নতুন চাকুরীতে এক তারিখে জয়েন করার কথা। এক সপ্তাহ আগেই যেতে চাই। তোমাদের সাথে ঢাকা শহর ঘুরে দেখবো। রেনু , আমাদের নিবি তোদের সাথে ?

রেনু ,সাগরের স্ত্রী প্লাস লতার বাল্য বান্ধবী।

ওদের কথাগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলো কিসমত আলি, না শোনার ভান করে। তার দিকে তাকিয়ে সাগর-রেনু-লতা তিন জনেই মাটিতে থুথু ফেলে চলে গেলো।

আবার ! উফফ, এই থুথুর জ্বালা যে কত ভয়ংকর তা শুধু কিসমত আলিই জানে। কলা বিক্রেতা বাপের মেয়ে লতা, আজ থেকে দশ বছর আগে এভাবে থুথু দিয়েছিলো তার মুখে। কিশোরী মেয়েটি পড়াশোনা ছেড়ে কিসমত আলির ২য় বউ হতে চায়নি বলে, এক সন্ধ্যায় তাকে জাপটে ধরেছিলো পুকর পাড়ে। লতাকে পায়নি, পেয়েছিলো লতার একদলা থুথু। সেদিনের জ্বালাটা নেভাতে আজকের এতো আয়োজন ছিলো। কাজ হলো না, আজ আবার জ্বলে উঠলো ;

জ্বালা–পোড়া_

নুরুর মনটা বেশিই খারাপ লাগছে। বউটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। বিয়ে করেছে ছয়মাস হতে চলছে, কিন্তু বউয়ের কাছে গুনে গুনে ছয় বারও যেতে পারেনি। বউটা সারাদিন কিসমত আলির তিন বউয়ের ফাই-ফরমাশ খাটে। রাতের বেলায়ও বেচারীর শান্তি নেই। যখন তখন বউটাকে ডেকে পাঠায় তার রুমে। আজ আবার ডাকছে। এবার বউকে না পাঠিয়ে নুরু নিজেই গেলো...
* হুজুর ডেকেছেন ?
** তুই এসেছিস কেন ? বউকে পাঠা, ওকে দরকার। আজ শরীরে অনেক জ্বালা-পোড়া হচ্ছে। মাথা ঠিক নাই।
* কিন্তু হুজুর, আপনারতো তিনটা বউ। তাদের না ডেকে অন্যের বউকে ডাকা কি ঠিক ? অন্য মানুষের বউরে ডাকলে আল্লায় পাপ দিবো না ? লতা আপা আর সাগর ভাইরেতো এই পাপের কারনেই গ্রাম থাইক্যা বাইর করলেন। ইমাম সাবের কাম কইরা এসব পাপ ক্যান করেন ?
** আরে মূর্খ, ধর্মের তুই কি জানিস ? ইমামতি কি তুই করিস না আমি ?
* জ্বি আপনি।
** শোন, আমাদের ধর্মে একজনের বউয়ের সাথে অন্যজনের সম্পর্ক করা নিষেধ। এতে পাপ হয়। কিন্তু চাকর-দাস আর তাগো বউয়ের উপরে মালিকের হক থাকে। মালিক যখন খুশি তখন তাগো ভোগ করতে পারে। এটাও একধরনের খেদমত করা।
* এগুলিতো আগেরদিনে হইতো। তখন কৃতদাস সিস্টেম ছিলো। এখনতো এগুলো ধর্মে নাই হুজুর।
** কে বলছে নাই ! সব আছে। আরবী দেশে আছে, পাকিদের দেশে আছে, আমাদের দেশেও আছে। তয় আমাদের দেশে এগুলো এখন  কম প্রকাশ হয়। সাগর লতার মতো মানুষের কারনে লোকজন একটু সজাগ থাকে। অনেক কথা হইছে, এখন গিয়া তোর বউকে পাঠা। তোরা হইলি আমার দাস-দাসি। আমার সেবা করা তোদের জন্যে ফরজ। মালিকের মনে জ্বালা-পোড়া উঠলে, সে তার দাসীকে ব্যবহার করতে পারে। যা, এবার।

সাগর, লতার পরিবারের সাথে আরো দুটো বাসের টিকিট যোগ করা হয়েছে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করতে পারেনি নুরু। তবে সে পালাতে চায়, এই দাষত্ব থেকে মুক্তি চায়। সে অশিক্ষিত চাকর মানুষ। অর্ধেক ইমাম কিসমত আলির ধর্মের ব্যাখ্যা শুনে সে ধর্ম থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মরার পর কি হবে এটা নুরুকে আর ভাবাচ্ছেনা। এতদিন ধরে তার বউটা   কিসমত আলির লালসার শিকার হয়েছে, সে কি তাকে ক্ষমা করবে ? ক্ষমাহীন জীবন নুরুকে কি নরক যন্ত্রনায় পোড়াবে না .... ?

0 Shares

৪০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ