জীবন যুদ্ধ – ১ম পর্ব

রেজওয়ান ৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ০৯:০৭:৪৯পূর্বাহ্ন গল্প ১১ মন্তব্য

সেই ক্লাস নাইনের সহজ সরল কিন্তু ডানপিটে নাবিলের থিতু হয়েছিলো বারো বছরে নয় টা স্কুল পরিবর্তন করে মফস্বলের এরকটি স্কুলে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মা'য়ের বড় ছেলের কাছ থেকে তাঁদের একটু বেশিই চাওয়া, কড়া শাসনে বড় করার চিন্তা যার ফল ছেলের বখে যাওয়া! শুরু হলো ছেলের নতুন করে পথ চলা পাইলট হওয়ার নিমিত্তে সাইন্স নিয়ে পড়াশুনা কিন্তু ওই…

স্কুলের বাধা-ধরা নিয়ম, শুধু মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন উত্তর দেখে ছাত্র/ছাত্রীদের ভাগ্য নির্ধারণ !! নাবিল অনেক ভাল ছাত্র, কনফিডেন্ট কিন্তু পুথিগত বিদ্যায় মনোযোগী না বিধায় পেলো আর্টস কিন্তু সে পড়বে না, উপায় না দেখে নিজের সকল স্বপ্নকে মাটি চাপা দিয়ে শেষে অ্যাডমিশন নিল ব্যবসায় শিক্ষা শাখায়। শুরু হলো তার উদ্ভৎ জীবন যাপন। কারো সাথে কথা বলে না ঠিক মত খায় না। ক্লাস করে না, সারাদিন বাসায়ই থাকে, এরপরেও তথাকথিত সমাজের মিথ্যে অভিযোগ, এলাকার লোকের কথায় কান দিয়েই পরিবারের সবাই ভাবতে শুরু করলো ছেলে হয়তো নেশা করে। ( যে ছেলে সিগারেট পর্জন্ত খায় না, ড্রাগ নেবেকি!!) কোনো কিছু যাচাই বাছাই না করে শুরু হলো ফ্যামেলি কোর্ট মার্শাল কোর্টের বকা-ঝকা/মারামারি! তকমা পেয়ে যায় নেশাখোর বখাটে!! ডিপ্রেশনের কারণে বাসার চেয়ে বাহিরেই থাকা হয় বেশি। এক সময় সিগারেট ধরলো, মিসলো এলাকার সব বখাটে ছেলেদের সাথে, জড়িয়ে গেলো ছাত্র রাজনিতীতে, মারামারি - কাটাকাটিতেই চলে যেতো সারাদিন, (যদিও তার মন ছিলো অনেক কোমল-নরম) এমন এক সময় লোকজন তাকে দেখলেই লোকে ভয় পেয়ে দুরে দুরে থাকে, ভয়ে ছট বড় সবাই সালাম দেয়, সম্মান দেখায় কিন্তু পেছনে দেয় বকা...!! সে জানে কিন্তু ভাবে পেছনেতো রাজাকেও বকা দেওয়া হয় এ আর এমন কি! কিছুদিনের মধ্যেই এলাকার বড় ভাই তকমা পেয়ে গেল সেই ছোট্ট ছেলেটি, মজা পায় সে, এ যেন এক রঙিন দুনিয়া। কাউকেই সে তোয়াক্কা করেনা। এক সময় নাবিলের পরিবার জানতে পারে, পরিবারে অনেকেই না বুঝিয়ে মারতে মারতে নাবিলকে বাসা থেকে বের করে দেয়।

ছোট্ট ও কম বয়সেই এলাকার পরিচিতি থাকায় শেল্টার পেতে সময় লাগেনি এলাকার তৎকালিন এম্পির, ছেলেকে আর পায় কে...! নাইনের কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহন নাকরেও সে পাশ এবং টেন-এ ভর্তী! হয়ে উঠলো আরো ভয়ংকর তৈরী করলো গ্যাং (বুলেট!) শুরু করলো চাঁদাবাজি, সবার কাছ থেকে না যারা ইস্মাগ্লিং করে, ড্রাগের ব্যবসা করে তাদের কাছ থেকে !! এ সকল কিছুর পরেও সে আম জনতার একটি মহল থেকে সাপোর্ট পেত কারণ সে কোনো নিরীহ মানুষ কে কষ্ট দেয়নি,গরিবের ক্ষতি করেনি। কোনো রিকশাচালকে মারেনি, হাফ ভাড়ার জন্য বাস হেল্পারকে মারেনি, কোনো নারীকে উত্যক্ত করে না, যদি কেউ করতো তাদের বেধম মারা হতো, এমন ভাবে মারা হতো যাতে অন্য কেউ এমন কাজ করার সাহস না পায়। পরবর্তীতে একটা অনাথ আশ্রম ও পথসশিশুদের জন্য এক টা স্কুল করে, নিজ এলাকায় কোনো মদ-গাজার সাপ্লাইয়ার নেই, সিনেমা হলে এক টিকিটে দুই ছবি চলে না..কোনো উলটা পালটা হলেই কথার আগে হাত চলতো নাবিলের। তারপরেও তথাকথিত সমাজে, পরিবারের কাছে সে খারাপ! এগুলো নিয়ে মাথা সে ঘামায় না খুব একটা। চলতে থাকে নিজের মত করে। দেখতে দেখতে তার ১৩ জন গ্রুপের সদস্য/সদস্যা ছোট বড় মিলিয়ে হয়ে গেল ৫৫ জন যাদের সবাই ১৮+ যাদের মুল লক্ষ -

“যার আছে তারটা নেও যাদের নেই তাদের দেও...! তেলে মাথায় তেল দিও না...!!”

চোখের বিষ হয়ে উঠেছিলো এই বুলেট গ্যাং কিন্তু কে শোনে কার কথা এলাকার বেশ কয়েকজন নেতার সাপোর্ট, পুলিশ ও কিছু বলতো না কারণ তারা যা না পারতো তা বুলেট গ্যাং করে দেখিয়েছে...

আড্ডা, মারামারি, মিসিল-মিটিং নিয়েই চলতে থাকে নাবিলের দিন। এদিকে নতুন একটি দল তৈরী হয় নাবিলের বিপক্ষে। বুলেট গ্রুপের নতুন সদস্যের মধ্যে এক জন হীরা, কিছু কিছু কাজ করে সে নাবিলের নজরে আসে। স্ট্রং সাহসী ও কিছু ভাল কাজের কারণে নাবিল হীরাকে বিশ্বাস করে এক সময় তারা ভাল বন্ধু হয়ে যায়। দিন যায় তাদের বন্ধু্ত্বের গভীরতা বারে। অনেক কিছু শেয়ার করে। এমন কোনো কাজ নেই নাবিল হীরা কে না জানিয়ে করে না।

এদিকে হীরা তেমন কিছুই শেয়ার করে না বরং সে নাবিল কে ব্যবহার করা শুরু করে কিন্তু নাবিল বুঝে না। সামনে SSC পরীক্ষা তাই নাবিল গ্রুপে সময় দিতে পারে না আগের মত। আর এটাকেই হাতিয়ার হিসেবে হীরা কাজে লাগায়। নতুন কিছু মেম্বার জয়েন্ট করায় নাবিলের অনুমতি ছাড়া।

SSC পরীক্ষার পর নাবিল যখন গ্রুপে সময় দেয়া শুরু করে তখন ই বুঝতে পারে গ্রুপ আগের মত নেই লোভে পরে প্রায় সকলেই এখন হীরার কথা শোনে গ্রুপের প্রথম দিকের কিছু মেম্বার্স রা ছাড়া। নাবিলকে তেমন পাত্তা দেয় না কিন্তু সমনে কিছু বলে ও না ভয় পায়।

এক সময় হীরা বিপক্ষ গ্রুপের সাথে মিলে প্ল্যান করে দু গ্রুপ না করে এক করার নাবিল বাধা দেয়। এটা হীরা মেনে নিতে পারে না। বিপক্ষ দলের লিডার সোহেলের সাথে হীরা দেখা করার প্ল্যান করে এক রেস্টুরেন্টে।

-কেমন আছ হীরা? -এইতো ভাল, তোমার কি অবস্থা? -ভাল। -চলো খাবারের অর্ডার দিয়ে কাজের কথায় আসি! -হুম সেই ভাল। -তো নাবিলের একটা বিহিত করা উচিৎ কি বলো? -জি ও খুব বেশিই বারছে বুঝাইছি অনেক কিন্তু কোনো কথাই শোনে না বলে এলাকার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ড্রাগসের ব্যবসা আবার ঢুকতে দিলে। -তাহলে তো সমস্যা, নিজের কথা চিন্তা না করে এলাকা-এলাকা করলে হবে? এভাবে চলতে দিলে আমরা যে পথে বসে যাবো, কিছু একটা করা দরকার খুব তাড়াতাড়ি। -খুব বেশি বারলে রাস্তা থেকে সরায়া দিতে আমার হাত কাপবে না এই বলে হীরা উঠে যায় খাবার শেষে হাত ধোয়ার জন্য। সোহেল যেন এইটার জন্যই অপেক্ষা করত্র ছিলো। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে তাহলে চলো সব কিছু গুছাই যা প্রফিট হবে ৪০-৪০ তোমার-আমার আর বাকিটা গ্রুপের খরচের জন্য।

নাবিল বুঝতে পারে না ওর মত ও কাজ করে যায়। টিএনওর সঙ্গে মিটিং করে পথশিশুদের স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করে। সুন্দর একটা নাম ও দেয় স্কুলের "street light" পানি-বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে গ্রুপের প্রথম দিকের দুই জন মেম্বার্স অয়ন আর তাজ নিয়ে। তাজ নাবিলের অনেক বিশ্বস্থ এবং সে নাবিলকে আদর্শ মন করে। নাবিল ও তাজকে অনেক স্নেহ করে,ভালবাসে। কিন্তু ইদানীং একটু দুরত্ব চলে আসছে তাজ-নাবিলের মধ্যে। এ নিয়ে নাবিলের অনেক মন খারাপ কথা বলতে চায় সে কিন্তু ইগো আর লজ্জায় বলে না যদি তাজ আর ও দুরে সরে যায় এই ভয়ে।

ইদানীং নাবিলের মনটা ভাল থাকে না। নিজেকে একা ভাবে কারণ যে হীরাকে সে এত বিশ্বাস করেছে সে হীরাই তার বানানো সকল গ্রুপ মেম্বার্স নিয়ে বিপক্ষ দলের সাথে হাত মিলালো!?! নাবিলের SSC রেজাল্ট দিয়েছে। কলেজ ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। গ্রুপে যায় না আগের মত কারণ সে বুঝে পেছনে তাকে নিয়ে কথা হয়। শুধু বিকেলের আড্ডায় যায় তাজ-অয়নের আর রিয়াজের সাথে। এগুলো ও হীরা-সোহেলের সহ্য হয় না খুব তাড়াতাড়ি ই নাবিলকে মারার প্ল্যান চলে।

রমজান মাস, নাবিল নামাজ-রোজায় মন দেয় আর একা একা নিজের মত থাকে। রাজনৈতিক পরিচিতি থাকার কারনে ভাল একটি কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। নতুন কলেজ নতুন মানুষ সহজে মিশে না কারো সাথে সব সময় ভাবে যদি আবার ধোকা খায়! একা একা ভাবে এসব আর মন খারাপ করে গাজার নেশায় চুর হয়ে বসে থাকে। এই গাজা যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গি। কেউ বুঝতে পারে না সে নাশা করছে। এদিকে ঈদের সময় ঘনিয়ে আসে street light এর ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনা দরকার। ৫ বছরে এই প্রথম বারের মত নাবিল তার মা কে ফোন দেয়।

-কেমন আছ মা? - ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে কে? কিন্তু বুঝতে পারে নাবিল ই কল করেছে -মা আমি নাবিল। অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। তোমার হাতে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে মা? খাইয়ে দিবে?? বলেই হু হু করে কেঁদে উঠে নাবিল। -ওপাশে শাড়ির আচলে মা মুখ ঢাকে, চোখ মুছে। বলে তো পরশুদিন ২৫ রমজান বাসায় চলে আসিস বাবা। এখন থেকে তুই আমাদের সাথেই থাকবি। তোর বাবা যে কত খুজেছে তোকে কিন্তু লোকোচক্ষুর ভয়ে তোদের ক্লাব ঘরের কাছে ও যায়নি। জানিস প্রতিদিন খাবার সময় তোর কথা বলে যে তুই খেয়েসিস কিনা? সব সময় ভয়ে থাকে কেউ তোর কোনো ক্ষতি করলো কিনা? তুই চলে আয় বাবা, আমরা তোকে আরর বকবো না, মারবো না। তুই তোর মত চলবি তর স্কুল চালাবি। পারলে আমরা তোকে সাহায্য করবো কিন্তু মারামারি-কাটাকাটি ছেড়ে দিয়ে তুই আমাদের কাছে চলে আয় বাবা। -খুব তাড়াতাড়ি ই তোমাদের কাছে চলে আসবো মা। অনেক মিস করি তোমাকে। এই ২৫ রমজানেই চলে আসবো। আজ রাখি তাহলে বাবা কে সালাম দিও মা। আল্লাহ্‌ হাফেজ বলে ফোন কেটে দেয় নাবিল। অনেক্ষণ কান্না করে, দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে কখন যে রাত দশ টা বেজে গেছে খেয়াল ই করেনি। বড় একটা নিস্বাস নিয়ে সিগারেট জ্বালায় সে…

“গল্পের সকল স্থান, নাম ও চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু গ্রাম-বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে অতি সাধারণ ঘটনা, কারো সাথে মিলে গেলে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন”

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ