1991_bangladesh_cyclone_29_apr_1991_0623z

ম্যারি এনের ছবি গুগল থেকে।

 

২৯ শে এপ্রিল ১৯৯১।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডিওতে শুনলাম ঘূর্ণিঝড় ম্যারি এন কাছে এসে পড়েছে ১০নং সিগনাল এবং লক্ষ্য চট্টগাম উপুকুল, সারাদিন অফিস করলাম অজানা আআশংকা নিয়ে, সন্ধ্যা হতে না হতেই গাড়ী নিয়ে বাসা মুখো হলাম দেখলাম চারিদিকে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসা চুপ চাপ, কোন বাতাস চলাচল নেই। রাত ৮ টার দিকে চারিদিকে লাল হয়ে উঠল যেন সামনের বিপদ আসছে তার জানান দিচ্ছে মোটামুটি বাতাসও হচ্ছে থেমে থেমে, এর মধ্যে ঝড় শুরু হলো, তার কি প্রচন্ড রূপ, রাত ১০ টার দিকে বাড়তে লাগল বাতাস তার রুদ্র রূপ ধারণ করে, ২৪০ থেকে ২৬০ কি.মি. স্পীড ছিলো বাতাসের গতিবেগ, ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

SONY DSC

ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে আল্লাহ্‌কে ডাকছি সবাই, সাগরের পানি আসার কোন সমস্যা ছিলই না বলতে গেলে কারণ আমাদের বাসাটা তুলনা মূলক ভাবে উচু জায়গাই ছিলো চট্টগ্রামের পূর্ব নাছিরাবাদ। ঝড়ের কারণে জানালার বেশ কিছু গ্লাস ভেংগে গেছে বাতাসে, উকি দিয়ে দেখলাম সব গাছ মাটিতে লুঠাচ্ছে, আমাদের সামনের ইলেক্ট্রিক পোল ভেংগে গেছে, টিএনটি লাইন অনেক আগেই শেষ, সারারাত চলল ঝড়ের টান্ডব সোঁ সোঁ শব্দে।
সকাল ৭.৩০ বেরুলাম বাইরে, দেখি সামনের উঠানে কিচ্ছু নেই, চারিদিকের ছোট গাছ গুলা ভেংগে চুরে পড়ে আছে, বড় গাছ গুলা যেন একদম ন্যাড়া হয়ে গেছে, প্রচুর পাখি এই দিক সেইদিক মরে পড়ে আছে, কিছুই দাড়িয়ে নেই। ৯.৩০ বা কাছাকাছি সময়ে বেরুলাম গাড়ী নিয়ে, দেখছি চারিদিকে গাছপালা কিছুই নেই হয়ে গেছে শুধু দাঁড়িয়ে আছে তাদের ন্যাড়া কান্ড, অনেক প্রতিকুলতা পাড় হয়ে গেলাম পতেংগার কাছাকাছি কিন্তু সবাই বলল আর যাবে না বা যাওয়া যাবে না কারন সামনে পানি আছে এখনও যা গতরাতে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছিল। ভিতরে আর না গিয়ে  আসে পাশের এলাকা ঘুরলাম সব যেন নাই নাই অবস্থা, দুপুর পর্যন্ত ঘুরে বাসাই চলে আসলাম, মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে চলে গেলাম আবার পতেঙ্গাতে, চারিদিকে শুধু কান্না আর মাতম সজন হারাদের, চারিদিকে লাশ আর লাশ পচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে, দেখলাম কয়েকটা বড় জাহাজ মাটির উপরে উঠে এসেছে, কয়েকটি জায়গাই দেখলাম বড় বড় কন্টেইনার কয়েক মাইল ভিতরে পানিতে ভেসে ঢুকে পড়েছে আর সামনে যা পেয়েছে তাই ডলে পিষে নিয়ে চলে গেছে। বেঁচে যাওয়া এলাকার লোকদের মতে সাগরের পানি এমনভাবে এসেছে যেন সমুদ্র খালি করে পানি সব উপরে উঠে এসেছে, এমনও শুনেছি বাবা তার এক মাত্র ছেলেকে বাঁচানোর জন্য নিজ মেয়েকে হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে পানি থেকে বাঁচার জন্য, কারো কারো গায়ের সম্পূর্ন কাপড় উধাও হয়ে গেছে, কিচ্ছু ছিলনা শরীরে, হয়েছে বাবা মা সন্তান হারা, সন্তান পিতা মাতা হারা। ঐ এক রাতে আমরা হারিয়েছি সরকারিভাবে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ।
এইসব দেখে দ্রুত বাসায় ফিরে এসে আমার কয়েকজন স্টাফ আর পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে বের হলাম প্যারাসিটামল, নাপা, ওরাল স্যালাইন কেনার জন্য, প্রায় বিশ হাজার টাকার মেডিসিন কিনে চললাম বাজারে, বাজারে গিয়ে কিনলাম প্রচুর গুড়, লবন আর মুড়ি, এইসব করে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো দেখে সব কিছু বাসায় রেখে চললাম আত্মীয় স্বজনদের খবর নিতে, সবার খবরাখবর নিয়ে বাসায় ফিরে আসি রাত প্রায় দুইটাই।
পরদিন খুব ভোরে উঠে ঘরে বানানো গুড় আর লবন দিয়ে বানানো শুকনা স্যালাইন, আলাদা প্যাকেট করে রাখা মুড়ি আর মেডিসিন নিয়ে, চলে গেলাম চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের ভিতরে, গেইট খোলায় ছিলো, একজন গার্ড টাইপের মানুষ বললো, স্যার খুব ভালো করেছেন, এই পথে আপনারাই প্রথম, সোজা ফ্লাইট ল্যান্ডিং ধরে শেষ মাথায় চলে যান, ঐদিকে খুব খারাপ অবস্থা মানুষের, আমরা সোজা মাইক্রোবাস নিয়ে চলে গেলাম, যাওয়ার পথে দেখছি, ঘূর্ণিঝড় কি টান্ডব না করেছে, এইদিক ওদিক পড়ে আছে যুদ্ধ বিমানের দেহবাশেষ যার একটা এখন শোভা পাচ্ছে তেজগাঁও বিমানবন্দরের গেইটের মুখে, ভিতরে গিয়ে গাড়ী থামানোর আগেই মানুষ এসে ঘিরে ধরেছে আমাদের ত্রাণের খোঁজে, সেইখানে একজন একজন করে আনা সব ত্রাণ দিতে থাকলাম, কিন্তু যা নিয়ে গিয়েছিলাম তাই অল্পতেই শেষ হয়ে গেল দেখে মন খারাপ হয়ে গেল, চারিদিকে হাহাকার অবস্থা, আশে পাশে মানুষ মরা, গরু ছাগল ইত্যাদি মরে থাকায় খুব গন্ধ ছিলো বিধায় আমরা নাকে মুখে কাপড় চাপা দিয়েছিলাম, ত্রাণ শেষ হয়ে যাওয়ায়, বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে আসছিলাম, হটাৎ দেখি একটা ট্রাক এলো খিচুড়ি নিয়ে আর তা দেখে আমরা আনন্দে কাঁদতে লাগলাম, পরবর্তি এক সপ্তাহব্যাপী নিজের খরচে ত্রান বিতরনে নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখলাম।
কয়েকদিনের মধ্যে আমেরিকান আর্মি এলো বিরাট বিরাট হোভার ক্রাফট নিয়ে, জীবনে প্রথম দেখলাম সেই হোভার ক্রাফট, তারা এসেই পানি বিশুদ্ধ করতে শুরু করলো তাদের সাথে আনা মেসিনের মাধ্যমে, সাথে সাথে বিশাল পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা।
এই ঘূর্ণিঝড়ে আখাউরা পর্যন্ত ট্রেন লাইন বিধস্ত ছিল, ইলেক্ট্রিসিটি প্রায় এক সপ্তাহের উপর ছিলনা, ঢাকা চট্টগ্রাম রোড চালু হতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল, যারা পানির কারণে গাছে, ছাদে উঠে বসেছিলো, তাদের ভাষ্যমতে, সেইরাতে বড় বড় গাছপালা, নারিকেল গাছ যা সহজেই ভাঙ্গেনা, সেইসব গাছকে আকাশে ঘুড়ির মতো আকাশে উড়ছিলো, ঘুর্নিঝড়ের হাওয়াটা এতো গরম ছিলো যে, চট্টগ্রাম সহ আশেপাশের অঞ্চলের যত গাছ দাঁড়িয়ে ছিলো, সব কটির ডালপালা জ্বলে গিয়েছিল, যা এরপরে প্রায় এক বছর লেগেছিলো সবুজ হতে, মানুষ মরার হিসাব করা হলেও, গরু ছাগল, হাঁস মুরগী, পাখি সহ যা কিছু মরেছিলো, তার কোন হিসাব ছিলোইনা।

এরপর থেকে কখনো ঘূর্ণিঝড় আসছে শুনলে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠে, প্রকৃতির সেই নির্মম রুপ যেন এই দেশের মানুষ আর না দেখে, এই দোয়া পরম করুণাময় আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের কাছে।

সমাপ্ত।

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

  • আবু খায়ের আনিছ

    ১০ নাম্বার বিপদ সংকেত/ ১০ নাম্বার রেড এর্লাট
    ২৪০ থেকে ২৬০ কি.মি. (স্পীড) ছিলো বাতাসের গতিবেগ।

    দেশের উত্তর প্রান্তে থাকি বলে দক্ষিণাঞ্চলের বিপদটা বুঝতে পারি না, ঝড় বৃষ্টি এগুলো আমাদের কাছে আনন্দের বিষয়, কিন্তু অপরপ্রান্তে তা কান্নার কারণ।
    উপলব্দি করার চেষ্টা করি মাত্র, কিন্তু তাতে কি পূর্ণ দুঃখটা উপলব্দি করা যায়?

  • চাটিগাঁ থেকে বাহার

    ঠিক আছে আপনার লেখাটি। আমি গুগল থেকে অনেক ব্লগারের লেখা সংগ্রহ করলেও আপনার এই লেখাটি সেখানে ছিলো না।
    ♦ভয়াল ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ ♦ নামে আমি সংকলিল গ্রন্থের যে পান্ডলিপি রেডি করেছি সেটি যদি প্রকাশিত হয় তাহলে তা হবে ঐ সংক্রান্ত একমাত্র গ্রন্থ। তাতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আমাকে মূল্যবান তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। পান্ডলিপিটি বর্তমানে ঢাকার একটি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছি। তিনি মনোনীত করলে এবারের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে তা মোড়ক উন্মোচন হতে পারে। আমার ফান্ড প্রবলেম ছিলো বলে গত বছর তা প্রকাশ করতে পারিনি।
    আপনার বর্ণনায় অনেক রিয়েলীটি ফুটে উঠেছে।
    যথা সময়ে পোষ্ট করেছেন বলে ধন্যবাদ। আমি ঐ দিন চকবাজার ঘাসিয়ার পাড়ায় ছিলাম।

  • নীলাঞ্জনা নীলা

    হ্যান্ডপাম্প ভাইয়া আপনি অনেক বড়ো মনের মানুষ, আগেও বলেছি, আবারও বললাম।
    পত্রিকায় দেখেছিলাম, এমন যেনো আর না হয়!

  • চাটিগাঁ থেকে বাহার

    নাছিরাবাদ, চট্টগ্রাম থেকে ইঞ্জা(আসল নাম দিবেন, আপত্তি না থাকলে) লিখেছেন: সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডিওতে শুনলাম ঘূর্ণিঝড় ম্যারি এন কাছে এসে পড়েছে। ১০নং সিগনাল এবং লক্ষ্য চট্টগাম উপকূল। সারাদিন অফিস করলাম অজানা আশংকা নিয়ে। সন্ধ্যা হতে না হতেই গাড়ী নিয়ে বাসা মুখো হলাম । দেখলাম চারিদিকে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসা চুপ চাপ, কোন বাতাস চলাচল নেই। রাত ৮ টার দিকে চারিদিকে লাল হয়ে উঠল যেন সামনের বিপদ আসছে তার জানান দিচ্ছে। মোটামুটি বাতাসও হচ্ছে থেমে থেমে, এর মধ্যে ঝড় শুরু হলো। ঝড়ের কী প্রচন্ড রূপ। রাত ১০ টার দিকে বাড়তে লাগল বাতাস তার রুদ্র রূপ ধারণ করে। ২৪০ থেকে ২৬০ কি.মি. স্পীড ছিলো বাতাসের গতিবেগ। ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

    ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে আল্লাহ্‌কে ডাকছি সবাই। আমাদের বাসায় বলতে গেলে সাগরের পানি আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ আমাদের বাসাটা তুলনামূলকভাবে উচু জায়গায় ছিলো, চট্টগ্রামের পূর্ব নাছিরাবাদ। ঝড়ের কারণে জানালার বেশ কিছু কাচের গ্লাস ভেংগে গেছে। উকি দিয়ে দেখলাম সব গাছ মাটিতে লুঠাচ্ছে। আমাদের সামনের ইলেক্ট্রিক পোল ভেংগে গেছে। টিএন্ডটি লাইন অনেক আগেই শেষ, সারারাত চলল ঝড়ের টান্ডব সোঁ সোঁ শব্দে।

    সকাল ৭.৩০ বেরুলাম বাইরে, দেখি সামনের উঠানে কিচ্ছু নেই। চারিদিকের ছোট গাছগুলা ভেংগেচুরে পড়ে আছে। বড় গাছগুলা যেন একদম ন্যাড়া হয়ে গেছে। প্রচুর পাখি এদিক সেদিক মরে পড়ে আছে, কিছুই দাঁড়িয়ে নেই। সকাল ৯.৩০ বা কাছাকাছি সময়ে বেরুলাম গাড়ী নিয়ে। দেখছি চারিদিকে গাছপালা সবকিছু নেই হয়ে গেছে। শুধু দাঁড়িয়ে আছে তাদের ন্যাড়া কান্ড। অনেক প্রতিকুলতা পাড় হয়ে গেলাম পতেংগার কাছাকাছি কিন্তু সবাই বলল সামনে আর যাবে না বা যাওয়া যাবে না। কারণ সামনে পানি আছে এখনও যা গতরাতে ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছিল। ভিতরে আর না গিয়ে আসে পাশের এলাকা ঘুরলাম। সব যেন নাই নাই অবস্থা। দুপুর পর্যন্ত ঘুরে বাসায় চলে এলাম, মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। পরদিন সকাল সকাল বের হয়ে চলে গেলাম আবার পতেঙ্গাতে। চারিদিকে শুধু কান্না আর মাতম স্বজনহারাদের। চারিদিকে লাশ আর লাশ, পচা গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে। দেখলাম কয়েকটা বড় জাহাজ মাটির উপরে উঠে এসেছে। কয়েক জায়গায় দেখলাম বড় বড় কন্টেইনার কয়েক মাইল ভিতরে পানিতে ভেসে ঢুকে পড়েছে আর সামনে যা পেয়েছে তাই ডলে পিষে নিয়ে চলে গেছে। বেঁচে যাওয়া এলাকার লোকদের মতে সাগরের পানি এমনভাবে এসেছে যেন সমুদ্র খালি করে পানি সব উপরে উঠে এসেছে। এমনও শুনেছি বাবা তার এক মাত্র ছেলেকে বাঁচানোর জন্য নিজ মেয়েকে হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে পানি থেকে বাঁচার জন্য। কারো কারো গায়ের সম্পূর্ন কাপড় উধাও হয়ে গেছে, কিচ্ছু ছিল না শরীরে। হয়েছে বাবা মা সন্তান হারা, সন্তান পিতা মাতা হারা। ঐ এক রাতে আমরা হারিয়েছি সরকারিভাবে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ।

    এসব দেখে দ্রুত বাসায় ফিরে এসে আমার কয়েকজন স্টাফ আর পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে বের হলাম, প্যারাসিটামল, নাপা, ওরাল স্যালাইন কেনার জন্য। প্রায় বিশ হাজার টাকার মেডিসিন কিনে চললাম বাজারে। বাজারে গিয়ে কিনলাম প্রচুর গুড়, লবণ আর মুড়ি, এসব করে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলো দেখে সব কিছু বাসায় রেখে চললাম আত্মীয় স্বজনদের খবর নিতে। সবার খবরাখবর নিয়ে বাসায় ফিরে আসি রাত প্রায় দু’টায়।

    পরদিন খুব ভোরে উঠে ঘরে বানানো গুড়-লবনের শুকনা স্যালাইন, আলাদা প্যাকেট করে রাখা মুড়ি আর মেডিসিন নিয়ে চলে গেলাম চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের ভিতরে। গেইট খোলাই ছিলো, একজন গার্ড টাইপের মানুষ বললো, স্যার খুব ভালো করেছেন, এই পথে আপনারাই প্রথম। সোজা ফ্লাইট ল্যান্ডিং ধরে শেষ মাথায় চলে যান, ঐদিকে খুব খারাপ অবস্থা মানুষের। আমরা সোজা মাইক্রোবাস নিয়ে শেষ মাথায় চলে গেলাম। যাওয়ার পথে দেখছি, ঘূর্ণিঝড় কি তান্ডব না করেছে। এদিক ওদিক পড়ে আছে যুদ্ধ বিমানের দেহাবশেষ যার একটা এখন শোভা পাচ্ছে ঢাকায় তেজগাঁও বিমানবন্দরের গেইটের মুখে। ভিতরে গিয়ে গাড়ী থামানোর আগেই মানুষ এসে ঘিরে ধরেছে আমাদের ত্রাণের খোঁজে। সেখানে একজন একজন করে আনা সব ত্রাণসামগ্রী দিতে থাকলাম। কিন্তু যা নিয়ে গিয়েছিলাম তা অল্পতেই শেষ হয়ে গেল দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। চারিদিকে হাহাকার অবস্থা, আশে পাশে মানুষ মরা, গরু ছাগল ইত্যাদি মরে থাকায় খুব গন্ধ ছিলো বিধায় আমরা নাকে মুখে কাপড় চাপা দিয়েছিলাম। ত্রাণ শেষ হয়ে যাওয়ায়, বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে আসছিলাম। হটাৎ দেখি একটা ট্রাক এলো খিচুড়ি নিয়ে আর তা দেখে আমরা আনন্দে কাঁদতে লাগলাম। পরবর্তি এক সপ্তাহব্যাপী নিজের খরচে ত্রাণ বিতরনে নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখলাম।

    কয়েকদিনের মধ্যে আমেরিকান আর্মি এলো বিরাট বিরাট হোভার ক্রাফট নিয়ে। জীবনে প্রথম দেখলাম সেই হোভার ক্রাফট। তারা এসেই পানি বিশুদ্ধ করতে শুরু করলো তাদের সাথে আনা মেসিনের মাধ্যমে। সাথে সাথে বিশাল পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা।
    এই ঘূর্ণিঝড়ে আখাউড়া পর্যন্ত ট্রেন লাইন বিধস্ত ছিল। ইলেক্ট্রিসিটি প্রায় এক সপ্তাহের উপর ছিল না। ঢাকা চট্টগ্রাম রোড চালু হতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগেছিল। যারা পানির কারণে গাছে, ছাদে উঠে বসেছিলো, তাদের ভাষ্যমতে, সেইরাতে বড় বড় গাছপালা, নারিকেল গাছ যা সহজেই ভাঙ্গেনা, সেইসব গাছ আকাশে ঘুড়ির মতো উড়ছিলো। ঘূর্ণিঝড়ের হাওয়াটা এতো গরম ছিলো যে, চট্টগ্রাম সহ আশেপাশের অঞ্চলের যত গাছ দাঁড়িয়ে ছিলো, সব কটির ডালপালা জ্বলে গিয়েছিল। যা এরপরে প্রায় এক বছর লেগেছিলো সবুজ হতে। মানুষ মরার হিসাব করা হলেও, গরু ছাগল, হাঁস মুরগী, পাখিসহ যা কিছু মরেছিলো, তার কোন হিসাব ছিলোইনা।
    এরপর থেকে কখনো ঘূর্ণিঝড় আসছে শুনলে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠে। প্রকৃতির সেই নির্মম রূপ যেন এই দেশের মানুষ আর না দেখে, এই দোয়া পরম করুণাময় আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের কাছে।

  • মেহেরী তাজ

    ভাইজান বৈশাখ মাসে ছোট ছোট যে ঝড় গুলো দেখি তাতেই ভয়ে অস্থির থাকি আমরা। মানে উত্তরাঞ্চলের মানুষেরা। এতো বড় কোন দূর্যোগ দেখলে যা জানি কি হবে।
    সেই সময়ের নিজ উদ্যোগে করা কাজের জন্য এখন আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
    এমন কিছুর মুখোমুখি আর কখন ও না হোক এ দেশ।
    সুন্দর পোষ্ট ভাইজান।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ