ছন্দ, মাত্রা, তাল-লয়,উপমা-উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি না থাকলে কিসের কবিতা? মুক্তছন্দের নামে অন্ত্যমিলবর্জিত কবিতাও যে ছন্দহীন কবিতা নয়–তা-ও বোঝেনা আজকালকার অনেক তথাকথিত গদ্যকবি।

আসলেই আবৃত্তির অযোগ্য কবিতা কখনোই ভালোকবিতা হতে পারেনা। আবার ভালোকবি মানেই ভালো গীতিকার- এটাও সত্য। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখি, যারা যতোবেশি ছন্দে পণ্ডিত, তারা ততোবেশি ভালো ছড়াকার। আর পারদর্শী ছড়াকাররাই মূলতঃ মানোত্তীর্ণ ছড়া-কবিতা ও গানলেখায় পটু হয়ে থাকে। প্রকৃত মানোত্তীর্ণ কবিতার আবৃত্তিও সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী হতে বাধ্য; আবার ছন্দহীন অকবিতার আবৃত্তি সুন্দর হতেই পারেনা। জোর করে তা আবৃত্তির চেষ্টা যতোই করা হোকনা কেনো?

ছন্দবিহীন কবিতা অনেক আগেও ছিল-একজনের এমন কথাশুনে আমারতো আক্কেলগুড়ুম! আসলে ছন্দ কী, আগে আমাদের তা বুঝতে হবে? তার কথায় মনে হলো–ছন্দসম্পর্কে তার সঠিক ধারণা নেই। ছন্দছাড়া কবিতা-ছড়া-গান হয়না, হতেই পারেনা; এটা অনেকেই বুঝতে চাননা।

অনেকেই হয়তো অন্ত্যমিলকেই ছন্দ বলেন। কিন্তু কবি মধুসুদন দত্ত বলেছেন–শব্দে শব্দে বিয়ে (অন্ত্যমিল) হলেই কিন্তু কবিতা হয়না। এটাও কিন্তু সঠিক কথা। শুধু অন্ত্যমিল থাকলে তাকে বড়জোর পদ্য বলা যেতে পারে।

কবিতার ভাষা বা শব্দ ও বাক্য হতে হয় সহজ-সাবলীল। তবে কবিতায় কঠিন শব্দ থাকতেই পারে। কিন্তু তা হতে হয় ছান্দিক বা ঝংকৃত বা রিদমিক অথবা শ্রুতিমধুর শব্দ, যা কবিতার ছন্দসৃষ্টিতে সহায়ক হয়। যেমন- আধুনিক শব্দটা খুব শ্রুতিমধুর না হলেও এটি অন্ত্যমিলযুক্ত বা অন্ত্যমিবিহীন উভয় কবিতায় ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু আধুনিকতা শব্দটা আদৌ কবিতার জন্য উপযুক্ত নয়। এ জাতীয় শব্দকে কবিতা-ছড়া বা গানে অবশ্যই পরিহার করা দরকার। এজাতীয় শব্দ গদ্যের জন্য উপযুক্তমাত্র। নজরুল বা রবীঠাকুরসহ নামীদামী কবিদের কোনো ছন্দহীন কবিতা ছিলোনা। তবে গদ্যকবিতা বা মুক্তছন্দের কবিতা তাদের আছে, যা আবার ছন্দোবদ্ধতো বটেই।

images (1)

আসলে ছন্দ জিনিসটা উপলদ্ধির বিষয়, দেখার জিনিস নয়। ছন্দের সাথে ভাষার ব্যাকরণেরও কোনো যোগ নেই। সুন্দর ও সাবলীল ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্যের সাথে মাত্রা, তাল, লয়, উৎপ্রেক্ষা, রূপকতা ইত্যাদি মিলিয়ে গঠিত হয় ছন্দ। আর পদ্য-কবিতা-ছড়া-গান আবৃত্তি করলেই কানে অনুরণিত হতে থাকে একপ্রকার রিদম বা সুর যা হৃদয়কে ভাল্লাগায় নাচাতে থাকে–এটাই মূলতঃ ছন্দ। আবার ছন্দের আছে সুনির্দিষ্ট ও সুগঠিত একটা ব্যাকরণ বা নিয়ম।

একটা উদাহরণ দিলে ছন্দের ধারণা পরিষ্কার হবে-পিচঢালা মসৃণ রাস্তায় গাড়িচালাতে খুব আরামবোধ হয়, কোনো ঝাঁকুনি না থাকায় ঘুমও পায় যাত্রীর। এই যে আরামবোধ বা সুখানুভূতি-এটাই ছন্দ। এজন্যই গানের সুরের ছন্দে অনেকেরই ঘুম পায়। আবার এবড়োথেবড়ো, ভাঙ্গাচোরা বন্ধুরপথে গাড়িচালিয়ে কি আপনি সেই সুখানুভূতি বা ছন্দ পাবেন? আপনি চরমভাবে বিরক্তিবোধ করবেন। এমনকি গাড়িতে ঘুমালেও গাড়ির ছন্দহীনতায় সে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আপনি রেগে যাবেন অবশ্যই। ছন্দহীন কবিতাপাঠেও পাঠকের তেমন বিরক্তি আসবে আসেই।

আমরা ছন্দ না জেনেও অনেকেই কবিতা লিখতে গিয়ে অকবিতা লিখি, যা পাঠককে বিভ্রান্ত করে; কবিতাবিমুখ করে তোলে। এতে কবিতার দোষ নেই। দোষ হচ্ছে তথাকথিত কবির, যারা পত্রিকার কলামের আদলে স্রেফ কিছু বাক্যসাজিয়ে কবিতা লিখতে চায়। ফলে তা আর কবিতা হয়না যদিও দেখতে কবিতার মতো। অথবা বেশকিছু দুর্বোধ্য শব্দসম্ভারে ভারী করে তোলে কবিতার শরীর, যা পড়তে ও বুঝতে চাইলে ডাকতে ইচ্ছে করে অগত্যা সেই কবিকেই।

আবার পদ্য-ছড়া আর গানের ক্ষেত্রে কেউ কিন্তু ছন্দহীনতার প্রসঙ্গ কখনো আনেনা। সাক্ষর-নিরক্ষর সবাই যেনো জানেই যে, পদ্য-ছড়া ও গান বা সঙ্গীত ছন্দছাড়া হয়ই না। কিন্তু কবিতা শব্দটি এবং এর ইতিহাসের মধ্যেই ছন্দের বাধ্যবাধকতা এবং অপরিহার্যতা থাকলেও আমাদের পূর্বসূরি কিছু কবিই গদ্যছন্দ-গদ্যকবিতা বা মুক্তছন্দের আবিষ্কার করায় ঘটেছে এই বিভ্রাট। যদিও তারাও কখনোই বলেননি যে, গদ্যকবিতা হবে ছন্দহীন; তবুও আমাদের এই বিভ্রান্তির কারণে আজ কবিতার তেমন কোনো কদর নেই।

অথচ একসময় আমরা দেখেছি হাটে-ঘাটে-বাজারে পয়ারছন্দে রচিত গেঁয়ো কবিদের কী হৃদয়গ্রাহী প্রেম বা লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনাসম্বলিত পদ্য? তারা তা ছাপিয়ে আবৃত্তি করেকরে বিক্রি করতো এবং তাদের ছন্দোবদ্ধ সেই পদ্যের হৃদয়গ্রাহী আবৃত্তিশুনে আমরাও কিনে নিয়ে পড়তাম। এটা খুব বেশিদিনের কথা নয়, অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা। আর আজ সেই ছন্দের এবং কবিতার কী দুর্দিন! জানিনে কতদিন আর কবিতার ওপর চলবে এমন অন্যায়-অবিচার!!

আবার বলি- ছন্দ স্রেফ অনুভবের বিষয় যা দেখা যায়না। তবে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী  “ছন্দ জানা ভালো কিন্তু এর দাসত্ব করা ভালো নয়” ছন্দের দাসত্ব না করার উপদেশের বিষয়টি নতুন কবিদের জন্য বিপজ্জনক বলেই আমি মনে করি। এটা ছান্দসিক কবিদের জন্যই অনুসরনীয় হওয়া উচিৎ, যারা ছন্দের পণ্ডিত এবং ছন্দের ভাঙ্গাগড়ায় সিদ্ধহস্ত। তিনি নতুন কবি বা সবার জন্যই গনহারে একথা বলেননি।

আবার গদ্যকবিদের অনেকেরই বানানের দশা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। যারা শুদ্ধভাষা জানেনা, বাক্যগঠনে বেশ দুর্বল। এমনকি শুদ্ধবানানসম্পর্কেও উদাসীন, তারা কোন যুক্তিতে কবিতা লিখতে আসে-এটা আমার বোধগম্য হয়না। যারা বাংলাব্যাকরণে এবং সঠিক বাক্যগঠন বা বানানেও দুর্বল; ছন্দ না জেনে এদের অনেকেই আবার কবিতা লেখে।

ছন্দ, মাত্রা, তাল-লয়,উপমা-উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি মিলে তৈরি হয় কবিতা-পদ্য-ছড়া-গান এর মনকাড়া ছন্দ। আর এটি হচ্ছে রীতিমতো একটি শিল্প । কবিতার ব্যাকরণ মেনে চললে যেমন ছন্দের সৃষ্টি হয় তেমন ভাষারও আছে একটি ব্যাকরণ, যা না মানলে কবিতা ও ভাষায় থাকেনা কোনো নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা এবং সৌন্দর্যবোধ-শ্রুতিমাধুর্যও।

 images (2)

তাই ছন্দছাড়া কবিতা হয়না-এটা ১০০% সঠিক। এটা হয়তো গদ্যকবিদের অনেকেই জানেনা যে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই মুক্তছন্দের প্রবক্তা হলেও তিনি কিন্তু গদ্যকবিতার নামে ছন্দহীন কবিতা নিজেই লেখেননি। এমনটি কেউ প্রমাণ করতে পারবেনা। তাই কবিতার মতো একটি কঠিন শিল্পের ছন্দ বা ব্যাকরণসম্পর্কে যারা উদাসীন থাকতে বলে–তারা ভালোকবি বা ভালোকবিতার ক্ষতি করছেন নিজেদের অজান্তেই। কারণ তাদের কথা মেনে হয়তো আজকাল অনেকেই কবিতার নামে স্রেফ পত্রিকার কলাম সাজাচ্ছেন মাত্র—। ধারছেন না কোনো ছন্দেরই ধার; ফলে কবিতার পাঠক কবিতা দেখলেই বা কবিতার নাম শুনলেই ভেগে যাচ্ছে কবিতাপাঠে কোনো ছন্দ ও আনন্দ না পেয়ে-এটাও দেখার বিষয়।

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ