পাশের এক ইউনিয়নের এক গ্রামে এক শালিসে গেছিলাম। পারিবারিক কেস।
ঘটনাঃ(ময়নার জবানীতে) ময়না আর লিটনের বিয়ে হয়েছিল ৯ বছর আগে। বিয়ের ৬ মাস পর লিটন বিদেশ চলে যায়। এরপর ৯ বছরে তিন কিস্তিতে লিটন দেশে থাকে মোট এক বছর। অর্থাৎ ৯ বছরে ময়না স্বামীকে কাছে পায় মাত্র দের বছর। লিটন বিদেশ থাকাকালীন নিয়মিত ফোন দিত না ময়নাকে। আর টাকা পয়সা বউয়ের কাছে পাঠাতো না। ২/৪ হাজার টাকা হাত খরচ দিত অনিয়মিতভাবে। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই লিটনকে ময়নার ভাল লাগেনি। আর দুজনের ভাল একটা বন্ডিং হওয়ার আগেই লিটন বিদেশ চলে যায়। এর মধ্যে এক কন্যা সন্তান জন্ম দেয় ময়না। ৫ বছর আগে ময়না বাবার বাড়ি চলে আসে। লিটন তখন দেশে এসে মুরুব্বিদের নিয়ে মাফসাপ চেয়ে ময়নাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তারপর ময়নার উপর মানসিক নির্যাতন বাড়তে থাকে। যৌথ পরিবার হওয়ার পরেও ননদ শাশুড়ির সাপোর্ট তো পায়নি বরং তারা নানাভাবে জ্বালিয়েছে ময়নাকে। এরই ফাকে ময়নার ননদ আর ময়নার ভাই প্রেম করে ফেলে। কিন্তু ময়না ও ওর বাবার বাড়ির ফ্যামিলির আপত্তির মুখে সেই সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। এতে ময়নার উপর মানসিক নির্যাতন আরো বেড়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির সবাই প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায়। ফোনে লিটনকে এসব বললে সে কিছু করতে অপারগতা জানায় এবং এডজাস্ট করতে না পারলে বাপের বাড়ি চলে যেতে বলে। ফলে দুই বছর আগে ময়না তার মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। মাদ্রাসা পাশ ময়না স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি নেয়। দুই বছর পর লিটন দেশে ফিরে আসে। দেশে আসার দশদিন পর ময়নাদের বাড়ি আসে। ময়না তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। মিনমিনে স্বভাবের লিটন বউকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আনার চেস্টাও করে না। ময়না এই সম্পর্কের আইনি ইতি টানতে চায়। সে আর লিটনের ভাত খাবে না।
প্রায় শ খানেক লোকের উপস্থিতিতে বিচারকার্য শুরু হয়। স্থানীয় চেয়ারম্যান মূল বিচারকের ভূমিকা পালন করেন। বিচার হয় ময়নাদের গ্রামেই উভয় পক্ষের মিচুয়াল এক আত্মিয়ের উঠানে। সেই আত্মিয় প্যান্ডেল টানিয়ে ডেকোরেটর ভাড়া করে খানাপিনার আয়োজন করে বিচারের আগে। সাদাভাত, ইলিশ ভাজা, বড় চিংড়ি ভুনা, দেশি মুরগী, বিলের কই মাছ আর ডাল!!! ভাল আয়োজন। তবে এই আত্মিয় লিটনের বেশি আপন। বোন জামাই। ময়নারা প্রতিবেশী!!!
যাই হোক, চেয়ারম্যান সাব ময়নার জবানবন্দী নিলেন। লিটন অভিযোগ অস্বিকার করলো। অনেক তর্ক বিতর্কের পর ময়না জানায় যে সে লিটনের ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছুক না। লিটন বউ আর মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে চায়।
বিচারকরা জানায় যে, ময়নার অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন এবং তা ডিভোর্স দেয়ার জন্য যথোপযুক্ত না। তবুও চেয়ারম্যান ময়নাকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে দায়িত্ব নেয় যে এখন থেকে ময়নাকে লিটন ঠিকঠাক ভালোবাসবে, ফোন দিবে। জামা কাপড় দিবে। না দিলে চেয়ারম্যান নিজে দিবে।
ময়নার আর কোন অভিযোগ আছে কি না সবাই জানতে চায়। ময়না জানায় যে লিটন শারিরিকভাবে অক্ষম।
তখন সবাই জানায় যে, এই অভিযোগের পর আর কিছু বলার নাই। ডিভোর্সই হোক। তারপরেও চেয়ারম্যান ময়নার কাছে তিন মাস সময় চান লিটনের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ময়না তাতে রাজী না। ফলে চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন যে, ময়নার এই অভিযোগ অসত্য। লিটন ফিজিকালি ফিট (এটা তার কৌশল। যাতে এলাকায় লিটন অপমানিত অসম্মানিত না হয় এই কথা নিয়ে)
এরপর লিটন আর ময়নাকে একান্তে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয় শেষ চেষ্টা হিসেবে। কেউই চান না সংসারটা ভেংগে যাক। কিন্তু তারা একমত হতে পারেনি। সো, ডিভোর্সই ফাইনাল!!!
ময়নার বিয়ের সময় ৯৫ হাজার টাকার ফার্নিচার দিয়েছিল ময়নার বাপ। সেটার মূল্য ৪৫ হাজার, লিটন এক ভরির চেইন দিয়েছিল ময়নাকে যা বাচ্চার চিকিৎসার জন্য ময়নার বাপ ৩১ হাজার টাকায় বেচে দিয়েছিল। মোহরানা ছিল দের লক্ষ টাকা। জুড়িবোর্ড গোপন মিটিং করে হিসাব কিতাব করে রায় দিয়েছে আগামী শুক্রবার ডিভোর্স সাইন হবে। আর লিটন এক লক্ষ পনেরো হাজার টাকা দিবে ময়নাকে। বাচ্চা থাকবে ময়নার কাছে। বাচ্চা বড় হলে সে যার কাছে ইচ্ছা থাকতে পারবে।
মামলা ডিশমিশ!!!
এসবই দৃশ্যমান ঘটনা। এবার বলি ঘটনার পেছনের ঘটনাঃ
লিটন সত্যিই স্ত্রীকে প্রাপ্য সম্মান এবং খোরপোশ দেয়নি। খাচ্চর হালায়।
লিটনও চায়না এই বউ রাখতে। কিন্তু প্রকাশ্যে বলেছে সে সংসার করতে চায়। যাতে তার উপর দোষ না চাপে।
আর এই দুই বছরে ময়নাও এক নতুন পাখি জুটিয়ে নিয়েছে!!!
শালিসটা ছিল মূলত কত টাকায় রফা হবে তাই নিয়ে। উভয় পক্ষ সেই নিয়্যত করেই আসছে। বাকি সব আলাপ আলোচনা বাকোয়াজ!!!
শালিসে ময়নার দুই পাশে বসেছিল ময়নার দুই ভাবি। চেয়ারম্যান সাব অই দুইজনকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয় কারণ তারা নাকি ময়নাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে সংসার ভাংতেছে!!! 🤣
শালিসে সবাই সন্তুষ্ট!!!
আমার যে কত কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু আব্বু ধমক দিয়ে আমারে কিছুই বলতে দেয় নাই। এসব শালিসে গেস্টদের কথাবলাটা অশোভন!!!
২০টি মন্তব্য
কামাল উদ্দিন
গ্রাম্য এই সালিশগুলোতে কত্তো যে রাজনীতি থাকে তা সব সময় বুঝা বড় মুশকিল, এই যেমন আপনি গোমর ফাঁস করে শেষে সবই বলে দিলেন।
শিপু ভাই
আমি এসব শালিস খুব মন দিয়ে দেখি
কামাল উদ্দিন
আগে দেখতে যেতাম, এখন সময় আর ইচ্ছে কোনটাই নেই।
সঞ্জয় মালাকার
সত্যি কথা,এখন তো এসব ঘটনা সচরাচর চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে ।
চমৎকার লিখেছেন, তবে জানা ছিলনা শালিস সবায় খানার আয়োজন কথাটা সাদাভাত, ইলিশ ভাজা, বড় চিংড়ি ভুনা, দেশি মুরগী, বিলের কই মাছ আর ডাল!!! ভাল আয়োজন। তবে এই আত্মিয় লিটনের বেশি আপন। বোন জামাই। ময়নারা প্রতিবেশী!!!
শিপু ভাই
আপনি আপনার পক্ষের আত্মিয়দের দাওয়াত করলেন শালিস উপলক্ষ্যে আপনার বাড়িতে। আপনি তাদের আপ্যায়ন করবেন না!???
সঞ্জয় মালাকার
তা তো বেটে
ইসিয়াক
বাস্তব চিত্র ।
ভালো লাগলো।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ ভাই
সাবিনা ইয়াসমিন
শালিশে গেস্টদের কথা বলা অশোভন! তাহলে তাদের ইনভাইট করে কেন? শুধুমাত্র সাক্ষী রাখার জন্যে?
শিপু ভাই
তারা পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকে। বিচারে অনিয়ম হইলে তখন তারা কথা বলে
সুরাইয়া পারভীন
এই দুই বছরে ময়না যদি নতুন পাখি জুটিয়ে নেয় তবে তা অন্যায় কিছু করেনি। যে মানুষটা তার স্ত্রীকে যোগ্য সন্মান দিতে পারে না তার জন্যই অপেক্ষা করে বসে থাকার কী মানে? ডিভোর্সটা করাই উচিত ছিলো।
শিপু ভাই
আমি গেছিলাম লিটনের পক্ষ থেকে। কিন্তু কথা বলেছি মেয়ের পক্ষে। তাই অনেকে অসন্তুষ্ট 🤣
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গ্রাম্য শালিসে এমন খানাপিনা হয় জানা ছিলো না। বাকীটা খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন। শেষাংশ টুকু ভালো লেগেছে। শুভ কামনা রইলো
শিপু ভাই
আপনি আপনার পক্ষের আত্মিয়দের দাওয়াত করলেন শালিস উপলক্ষ্যে আপনার বাড়িতে। আপনি তাদের আপ্যায়ন করবেন না!???
আর দাওয়াত করা হয় তুলনামূলক ভি আই পি শ্রেনীর আত্মিয়দের। সো তাদের আপ্যায়নও ভাল হয়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বুঝলাম শালিস ও একটা উপলক্ষ্য হয় আত্নীয় দের খানাপিনার জন্য। বিষয়টি ক্লিয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে
শিপু ভাই
এই পোস্টের প্রেক্ষিতে বলি-
বিচার বসেছে লিটনের বোন জামাইয়ের বাড়িতে। লিটন এই গ্রামেই বিয়ে করেছে। ফলে লিটনের সাথে যারা যারা এসেছেন তারা কিন্তু অই বোন জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
আরজু মুক্তা
গ্রাম্য পলিটিক্স।
শিপু ভাই
খুব ক্রিটিকাল
এস.জেড বাবু
ঘটনা
আর ঘটনার পিছনের ঘটনা এক না
বাস্তবতা তুলে ধরেছেন চমৎকার ভাবে।
যা বুঝলাম, ডিভোর্স হওয়াটাই ভালো উভয়ের পক্ষে।
চমৎকার প্রকাশ ভঙ্গি।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ বাবু ভাই