২০১৩ সাল থেকে ভিন্নমত পোষণকারীদের নির্মমভাবে কুপিয়ে মারার ঘটনা এদেশে ব্যাপক আকারে শুরু হয়েছিলো। একেকটা হত্যাকাণ্ড ঘটনোর পরই ধর্মের নামে চারদিকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়া হতো হত্যাযজ্ঞটিকে জাস্টিফাই করার জন্য।

ব্লগাদের হত্যার পর তাকে 'নাস্তিক' ট্যাগ দেয়া হতো হত্যাটিকে জায়েজ করার জন্য। আর আপনারা সাধারণেরাও নিশ্চুপ থেকেছেন ধর্ম রক্ষার নামে। অথচ আপনাদের একবারও ভাবনায় আসেনি, মত প্রকাশের জন্য কাউকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারার অধিকার কারোরই নেই। যে অধিকার আছে, সেটা হলো সমষ্টিগতভাবে তা প্রতিরোধ করা। হতে পারে তা কলমের যুদ্ধ, রাজপথের যুদ্ধ কিংবা অনলাইন যুদ্ধ। তা না করে আপনারা মৌন সমর্থনের মাধ্যমে চাপাতিবাজদের সমর্থক হয়ে গেলেন।
আপনাদের ধর্মীয় দুর্বলতা তাদের ঢাল হলো আর আপনাদের নীরবতা তাদের সাপোর্ট হলো। অথচ আপনাদের ভাবা উচিত ছিলো, ধর্মের নামে উন্মুক্ত হত্যাযজ্ঞ গ্রহণযোগ্য নয়। দেশে আইন-কানুন, বিচারালয় আছে।
ধর্মপ্রাণ হিসেবে ধর্মীয় দুর্বলতা থাকবে কিন্তু চিন্তাশক্তিহীন হবেন কেনো? চিন্তাশক্তিহীন ধর্মীয় দুর্বলতাই তাদের ঢাল, সর্ববৃহৎ অস্ত্র।

এর পরের ধাপে তারা আরেককাঠি বেড়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু করলো। প্রথম কেসে সফল হয়ে এখানেও তারা আপনাদের ধর্মীয় দুর্বলতাকেই তাদের ঢাল হিসেবে গ্রহণ করলো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা চালাতে হিন্দু যসরাজকে ফাঁসাতে জাহাঙ্গীরকে ব্যবহার করা হয়েছিলো। ধর্মীয় দুর্বলতায় আপনারা কেউকেউ নীরব ছিলেন। মনেমনে নিরীহ যসরাজের প্রতি আপনারা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন। আর কেউকেউ পুলকিতও হয়েছিলেন। যদি সেদিন যসরাজকে জেলবন্দি করা না হতো তবে হয়তো নিরপরাধ সে ছেলেটিও সেদিন খুন হয়ে যেতো। কারণ আপনারা সেদিন 'চিলে কান নিয়েছে' শুনেই বেজায় জোশে ছিলেন ধর্ম বাঁচাতে। পরে যখন প্রমাণিত হলো, নিরীহ যসরাজকে ফাঁসাতে মুসলিম জাহাঙ্গীর কাজটি করেছিলো, আপনাদের মুখে তখন 'রা নেই! জোশও কমে গিয়েছিলো!!

শয়তান বিভ্রান্তি ছড়াতে সময়ের প্রয়োজনে ছলে পরিবর্তন আনে।
আসলো গুজবের ঘটনা। এখানে আর ধর্ম নয়, কুসংস্কারকে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেই আপনাদের ব্যবহার করে পরপর পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো কয়েকজনকে, উদ্দেশ্য সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা। না জেনে, না বুঝে আপনাদেরও জোশ উঠে যায়। অথচ এরকম জরুরী কেসে সরকার ৯৯৯ এর মতো তাৎক্ষনিক সেবা কার্যক্রম চালু করেছে, তাও আপনারা জোশে মাতোয়ারা হয়ে নিজেই শাস্তি দেয়ার দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিয়ে নেন। আপনাদের এই চিন্তাভাবনাহীন জোশকে কাজে লাগিয়ে দুষ্টচক্র একের পর এক কুকর্ম চালিয়েই যাচ্ছে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য।

নাস্তিকতার নামে মানুষ মেরে ফেলা! সাম্প্রদায়িকতার অজুহাতে মানুষ মেরে ফেলা! গুজব উড়িয়ে মানুষ মেরে ফেলা! মতামত পছন্দ না হলে মানুষ মেরে ফেলা!
কী আজব!
কিছুলোক এগুলো করছে, কিছু লোক একাজগুলোকে জাস্টিফাই করছে আর কিছুলোক অজানা আশায় (অই ইরাক, লিবিয়ানরা যেমন আশা করেছিলো আরকি) বুকবেঁধে পুলকিত মন নিয়ে তাদের মৌন সমর্থন করছে।
আর আপনারা সাধারণেরাও ধর্মীয় অনুভূতিপ্রবণ হয়ে নিজেরাও এটাসেটা মন্তব্য করেছেন। আজকের এ পরিস্থিতিটা তো আপনাদেরই তৈরি। আপনারাই বলতেন, লেখে কেনো এভাবে? অথচ বলতেন না, লেখাকে লেখা দিয়ে জবাব দিক, মেরে ফেলবে কেনো? খেয়াল করে দেখুন তো, ধর্মীয় দুর্বলতায় আপনাদের অভিব্যক্তিটা সেদিন কেমন ছিলো?

অথচ একটা সময় প্রতিবাদের কতো ন্যায়সঙ্গত ভাষা ছিলো। মিছিল ছিলো, মিটিং ছিলো, মানববন্ধন ছিলো, অনশন ছিলো, অসহযোগ ছিলো। এগুলো করেই আমরা বৃটিশ তাড়িয়েছি, পাকিস্তান তাড়িয়েছি। অথচ আজ আমরা তলোয়ার নিয়ে দৌড়াই, চাপাতি নিয়ে দৌড়াই। পিটিয়ে মেরে ফেলি।
ক্রমশ আমরা মানুষ থেকে বন্যমানুষই হয়ে উঠছি।

এভাবে বাড়তে বাড়তে আজকে কুরুক্ষেত্র হওয়ার পথে দেশটা।
অথচ প্রতিটা হত্যাকাণ্ডে যদি আওয়াজটা আজকের মতো সমস্বরে উঠতো তাহলে এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো একের পর এক দেখতে হতো না।

মনে রাখবেন, দুষ্টচক্র সময়ের প্রয়োজনে ছল পরিবর্তন করে।

*আবরারের হত্যাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন ৯জনকে আটক করা হয়েছে। যথাযথ প্রমাণসাপেক্ষে মূল অপরাধীর যথোপযুক্ত শাস্তি দাবী করছি। আবরারের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। কামনা করছি ছেলেহারা বাবামায়ের বুকের যন্ত্রণা কমে আসুক।

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ