রোজার ঈদ মানে কাজ কম, আর কোরবানির ঈদ মানেই ঝামেলার দিন। বাড়ির চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পচা নাড়িভুঁড়ির একটা বিদঘুটে ভাপ সর্বত্র ভেসে বেড়ায়, যেন পেট উগরে বমি আসবে। আমার ধারণা; এমন পরিস্থিতির জন্য সমাজের কিছু গুটিকয়েক অসভ্য মানুষ দায়ী। পরিবেশ বিষয়ক ব্যবস্থাপকদের অল্প একটু সচেতনতায় কোরবানির ঈদের অনেক পরিস্থিতিই বদলে যেতে পারতো, ঈদের দিনটি আরও অনেক সুন্দর হতে পারতো।

বিশেষত গ্রাম গঞ্জের মানুষ তো অনেক বেশি অসভ্য, কারন তাদের ব্রেইন শহুরে মানুষদের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করে। তারা নিজেদের ভালো কম বুঝে, খারাপ বুঝ বেশি। মানে তাদের মাথায় চিকণ বুদ্ধিয়ে ঠাঁসা, কিন্তু কাজে লাগছে ভুল পথে। যারা বলে গ্রামের মানুষ সহজ-সরল, বোকাসোকা, কিচ্ছু বুঝে না। আমি বলবো; যারা এই ধারণা রাখে তারাই মূলত আসল বেকুব, বোদাই মার্কা আবাল প্রকৃতির।

কোরবানির ঈদে মানুষ আধ্যাত্মিক নৈকট্য লাভের জন্য শরীয়ত নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে এক ধরনের ভণ্ডামি করছে। পশু জবাই করে সন্তুষ্টি লাভের প্রক্রিয়ায় বুঝে না বুঝে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। কোরবানি সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষদের আচার-ব্যবহারে অনেক শুধরানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কোরবানির ঈদ আরও বেশি মার্জিত ও পরিকল্পিত হতে পারে যদি আমাদের সামাজিক অবস্থান ও পরিবেশ বিষয়ে একটু সচেতন হই।

ছোট ঈদ বলেন আর রোজার ঈদ বলে, এবারের ঈদের দিনটি আমার কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। দিনটির পবিত্রতা নিয়ে গভীর এক খেলায় মেতে ছিলাম। ঈদের দিন মানুষদের প্রতি আমার বিশেষ চৌকস দৃষ্টি ছিল। গভীর স্বচ্ছ অনুভূতি দিয়ে প্রত্যেককে বুঝতে চেয়েছি, প্রকৃত অর্থে তাঁরা কেমন? এতগুলো মানুষ প্রতিটি দিন কি নিয়ে বেঁচে বেঁচে মরে যাচ্ছে? এতোসব গভীর ভাবনায় তলিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম যতসব অর্থ সম্বলিত মতবাদের গ্যাঁড়াকলে।

ভোর সকালে নানান যুদ্ধ বিনিময় পর্ব শেষ করে গোসল করলাম। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে আব্বুর সেলামি নিলাম। ছোট বোনরে সেলামি নেওয়ার শর্টকাট টেকনিক শিখিয়ে দিলাম। সেও আব্বুর থেকে বিরাট অঙ্কের সেলামি পেলো। কিভাবে কিভাবে যেনো আম্মারে আমি সেলামি দিলাম। কোন এক টেকনিক্যাল কারণে আম্মারে সেলামি দিতে হল। এই গল্পটি অনেক বেশি পারিবারিক, তাই তুলে রাখলাম ব্যক্তিগত স্মৃতিগারে। (স্মৃতিগার একটি নতুন শব্দ)...

ঈদের দিন আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বিশ্রী একটা অবস্থা। আমি দুইটা জায়নামাজের সাথে একটা ছাতা নিলাম। এক এক করে বাড়ির সবাই জড়ো হল। আব্বু খেয়াল করল শুধু আমার হাতে ছাতা, আর কারো হাতে ছাতা নেই। তিনি কি মনে করে সবার দ্বারা চটকরে প্রভাবিত হলেন। আমাকে বললেন; ছাতা বাসায় রেখে আসতে। আমি বললাম; যাদের দেখছেন তাদের কারো বাসায় ছাতা নেই। আমার ছাতা আছে তাই নিচ্ছি, ছাতা রেখে আসার তো কোন প্রশ্নই আসে না।

এইসব মানুষদের ধারনা; ছাতা নিয়ে গেলে বৃষ্টি আসবে দ্রুত, আর ছাতা না নিলে তুমি বিশ্বাসী। তাদের এইসব জটিল হিসাব-কিতাব আপনাদের কারো কারো মাথার উপর দিয়ে যাবে।

প্রচলিত কথায় আছে মক্কার মানুষ হজ্ব পায় না। আমাদের হয়েছে ঠিক এই অবস্থা। ঈদগাহের ময়দানে প্রায় আট গ্রামের মানুষ একসাথে ঈদ করে। সেই হিসেবে আমরাই ছিলাম সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। এবারের ঈদের নামাজে বিপুল সংখ্যক মানুষ হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত দুই বছর মানুষজন শান্তিতে ঈদ করতে পারেনি। বহু মানুষ আটকে ছিল নানান ঝামেলায়। অনেকে ছিল গৃহবন্দি, আবার অনেকে চাকরিবাকরি সহ নানান জটিলতায় বিগত দুই ঈদ ছুটে গেছে আনন্দহীনভাবে। তাই এইবার প্রচুর মানুষ গ্রামে ঈদের জন্য ছুটে আসছে।

আমাদের গুষ্টির সবাই একসাথে এক কাতারে নামাজ পড়ি। বংশের সবাই মিলে ঈদের নামাজ আদায়ে অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু এইবার সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে একেক কাতারে নামাজ পড়তে হয়েছে, কারণ দেরি করে ফেলছি। যদিও নামাজ শেষে কেউই বেশিক্ষণ দূরে দূরে বসে থাকতে পারেনি, দ্রুত সবাই আবার এক হয়ে গেলাম, আমাদের কেউ কেউ খুৎবা শুনছিল আর দেদারে ফোটো সেশন করছিল। সবাই সবার ছবি তুলা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল।

বাড়ি ফেরার পথে ভেবেছিলাম কারো সাথে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোলাকোলি করবো না। বললেই কি আর হয়। যে যেভাবে পারছে উল্টাইয়া পাল্টাইয়া খালি কোলাকোলি আর কোলাকোলি করছে। আমি শুধু অনুভব করে গেলাম কে নেগেটিভ আর কে পজিটিভ ভাইবের মানুষ। অধিকাংশ মানুষই জানে না, চেহারায় অনেক কিছু লেখা থাকে, আচার ব্যবহারে মানুষের ভেতরের অল্পস্বল্প জটিলতা খুব সহজে পড়ে নেওয়া যায়। যারা পড়তে জানে তাদের জন্য এটি খুবই সহজ বিষয়। আমার ঈদের দিনে এমন কি দুষমনদের সাথেও গলায় গলা মিলিয়ে হাসিমুখে ঈদ মোবারক করেছি।

পাড়ার সবাই মিলে দীর্ঘ কবর যিয়ারত শেষে বাসায় ফিরে মায়ের হাতের জমপেশ খাওয়াদাওয়া করলাম। লম্বা ভাত-ঘুম শেষে ছোটবেলার স্কুল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলাম। পুরো সন্ধ্যা এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করে এটা-ওটা খেয়েছি। যদিও বন্ধুদের আড্ডাগুলোতে আমার চারপাশের সবকিছুতে মনোযোগ থাকে। চেষ্টা করি প্রত্যেকের কথা মন দিয়ে বুঝতে। এতো এতো মানুষের ভিড়ে মাঝেমাঝে মনে হয়, আমিও তো একজন আবেগ অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ। যে তার সমগ্র জীবন জুড়ে স্বচ্ছ ও শুদ্ধতার বীজ বুনে চলছে। যে একজন আত্মজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হতে চেয়ে ছিল। যাকে পৃথিবীর কোন ক্ষুদ্রতাই স্পর্শ করবে না।

-সাফায়েতুল ইসলাম।

0 Shares

২টি মন্তব্য

  • সাবিনা ইয়াসমিন

    ঈদ নিয়ে ব্যতিক্রমী একটা পোস্ট পড়লাম। ভালো লেগেছে লেখাটি।
    ❝যারা বলে গ্রামের মানুষ সহজ-সরল, বোকাসোকা, কিচ্ছু বুঝে না। আমি বলবো; যারা এই ধারণা রাখে তারাই মূলত আসল বেকুব, বোদাই মার্কা আবাল প্রকৃতির❞
    এটা নিয়ে মানুষের মাঝে একটা মিশ্র ধারণা কাজ করে। শহুরে মানুষদের নিয়েও কিন্তু এমন ধারণা প্রচলিত আছে। শহরের মানুষ অহংকারী, প্রতারক, নাস্তিক, ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে চারিপাশ (পরিবেশ/মানুষের মন) সুন্দর তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হয় প্রত্যেককেই, নিজ নিজ ঘর/পরিবার থেকে। পরিবেশ সুন্দর করে বানিয়ে দিতে পারলে সবকিছুই সুষ্ঠু স্বাভাবিক মনে হবে, হোক শহুরে অথবা গ্রামীণ।

    মানুষের ভীড়ে থেকে মানুষকে পড়তে পারা জটিল ব্যাপার। মগ্ন হয়ে পড়তে হয়, নয়তো ব্যখ্যাগুলো নিমিষেই পালটে যায়।

    ভালো থাকুন, নিয়মিত লিখুন। শুভ কামনা 🌹🌹

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ