অদ্ভুত আঁধার এক – ৪

রিমি রুম্মান ২২ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ০২:১৭:০২অপরাহ্ন সমসাময়িক ১৫ মন্তব্য

নিউইয়র্ক শহরে এবার ম্যাগনোলিয়ার পাপড়ি খুব নিরবে, নিঃশব্দে সকলের অদেখার মাঝে ঝরে গেছে। চেরিফুলে ছেয়ে আছে গোটা শহর। প্রস্তুতি নিচ্ছে টিউলিপ। এপ্রিলের শেষদিকে রং ছড়াবে শুনেছি। জ্যাকসন হাইটস, ডাইভারসিটি প্লাজায় শ্মশানের নিস্তব্দতা। সেভেন্টি ফোর স্ট্রিটে ভূতুরে নির্জনতা। জ্যাক্সন ডায়নারে মধ্যাহ্নভোজের দীর্ঘ লাইন নেই। ফুলের মিষ্টি সুবাস আর সৌন্দর্যের হাতছানি উপেক্ষা করে চারদেয়ালের মাঝে স্বেচ্ছা কারাবাস আমাদের। অচেনা আগন্তুকের মতোই মৃত্যুদূতের আনাগোনা চারপাশে। আমরা জানালায় উঁকি দিয়ে অচেনা বাতাসে ভেসে বেড়ানো আগন্তুক দেখি। আমরা বেঁচে থাকার আশায় ভালো থাকি রোজ !

বেঁচে থাকার আশায় আমাদের খাবার খেতে হয়। সঞ্চিত খাবার ফুরিয়ে এলে বাইরে বেরোতে হয়। বাচ্চাদের দুধ, ডিম, কলা, পাউরুটি ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এসব এখন আমাদের কাছে বিলাসী খাবার। কোনমতে খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। আর্থিক সংকটের বিষয় নয়, বরং বাইরে বেরুনোটাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। কেননা নগরীতে হুহু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। আমেরিকার নিউইয়র্কের কুইন্স, অর্থাৎ যে এলাকায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার, সেখানেই সপরিবারে আমাদের বাস। কখন, কেন, কীভাবে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে এ বিষয়ে নানান রকম মতামত বিশেষজ্ঞদের। যদিও এতদিন জেনেছি এটি মানুষের সংস্পর্শে, হাঁচি, কাশির সাথে সংক্রমিত হয়। এখন বলা হচ্ছে এটি বাতাসেও ছড়াচ্ছে। সঠিক তথ্য বিষয়ে সকলেই দ্বিধান্বিত। বলা হচ্ছে এবং বারবার করে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে সকলকে বাড়িতে অবস্থান করতে। তবুও প্রয়োজনীয় ওষুধ ফুরিয়ে গেলে নিরুপায় হয়ে বের হতে হচ্ছে। ফার্মেসীগুলো সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলছে। তারা ক্রেতাদের ক্যাশ কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ানোর জন্যে ছয় ফিট দূরত্বে মার্ক করে দিয়েছে। গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ান গ্রোসারিতে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। বিশাল বড় স্টোর, অথচ ভেতরে খুব কম সংখ্যক ক্রেতা। বাইরে সামাজিক দূরত্ব মেনে ক্রেতাদের বিশাল লাইন। কিছু ক্রেতা বেরিয়ে এলে তবেই কিছু সংখ্যক ক্রেতাকে ভেতরে যাবার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। কাজ সেরে গিয়েছিলাম অন্য আরেকটি সুপার শপে। একজন মাত্র ক্যাশিয়ার কাজ করছেন ক্যাশ কাউন্টারে। ক্রেতা এবং ক্যাশ রেজিস্টারের মাঝ বরাবর লম্বা কাঁচের পাটিশন দেয়া হয়েছে সতর্কতা স্বরূপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্যাশিয়ার সংকট। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কেউ কাজে যেতে চাচ্ছে না। কিছু জিনিষ ট্রলিতে নিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর জন্যে হাঁটছি বিশালাকৃতির স্টোরের প্রশস্ত আইলের ভেতর দিয়ে। লাইনটি দীর্ঘ হতে হতে এক আইল থেকে অন্য আইলে সাপের মত এঁকেবেঁকে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, সেই শেষপ্রান্তের দেখা পাইনি। অগত্যা জিনিষ রেখেই বেরিয়ে এসেছি।

দীর্ঘ শীত শেষে বসন্তকালীন ছুটির এই সময়টায় শিশুরা পার্কে ছুটোছুটি খেলার কথা। বন্ধ ঘরে দিনের পর দিন সময় কাটানো তাদের জন্যে কঠিন এক পরীক্ষা! এ সময়ে বাইরে ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া বিরাজ করে। সাথে মাতাল হাওয়া। বসন্ত খুব একাকি নৈঃশব্দ্যের মাঝে বিষণ্ণ মনে ফিরে গেছে। শহর জুড়ে হয়নি কোন বসন্ত উৎসব কিংবা বৈশাখ বরণের আয়োজন। হয়নি কোথাও শেকড় ছেড়ে স্থানান্তরিত হওয়া মানুষের সমাগম। থাকুক এবার সব আয়োজন। তবুও থামুক মৃত্যুর মিছিল। থামুক ঘরে ঘরে স্বজন, প্রিয়জন হারানোর শোক। থামুক একফোঁটা অক্সিজেন পাবার বিরামহীন যুদ্ধ। কোলাহলমুখর এই শহরটা সত্যিই আজ নৈঃশব্দ্যের শহর হয়ে উঠেছে। শুধু থেমে থেমে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে উঠে করুণভাবে। আমরা বেঁচে থাকা মানুষেরা আচমকা সেইসব শব্দে কেঁপে পেঁপে উঠি অজানা শংকায়। এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে একযোগে সারা বিশ্বে।

এতোসব সত্ত্বেও একটানা লম্বা সময় বাড়িতে থেকে মানুষগুলো হাঁপিয়ে উঠেছে যেন। পত্রিকায় দেখলাম, ২০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক পাহাড় আর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছেন সপরিবারে। ২৫শে মার্চ থেকে দেশটিতে লকডাউন চলছে যদিও। লকডাউন লঙ্ঘন করায় ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে নিজেই ‘ নির্বোধ’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগও করতে চেয়েছিলেন তিনি। সংকটকালীন সময়ের কথা বিবেচনায় সেটি গ্রহণ করা হয়নি।

এদিকে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির এক ভিডিওতে দেখলাম, ঢাকার রাস্তায় অকারণে ঘোরাঘুরি করা কিছু সংখ্যক মানুষকে মাইকিং করে তিরস্কার করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য। ধমকের স্বরে পথচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, কেনো বাসা থেকে বেরিয়েছেন ? জবাবে পথচারীর ভাবলেশহীন সরল স্বীকারোক্তি, ‘ বাসায় ভালা লাগে না’।

আমাদের এবারের বৈশাখী বিকেল আর সন্ধ্যাগুলো বড় বেশি বিবর্ণ, ম্লান। আমাদের চোখ মেলে দেখা হয় না ফুলের ভারে নিচু হয়ে আসা ম্যাগনোলিয়ার ডাল আর সবুজ ঘাসের মাঝে গড়ে উঠা নিবিড় সম্পর্ক। আমরা ভুলে যাই এখন ভোর না সন্ধ্যা। ভুলে যাই বুধবার না বিষ্যুদবার। প্রতিটি মধ্যাহ্ন কিংবা অপরাহ্ণকে মনে হয় অভিশপ্ত। জীবন এতদিন ছিল আদিগন্ত খোলা মাঠের ন্যায়। এখন তুমুল বৃষ্টিতে চুপচুপে ভেজা আশ্রয়হীন দাঁড়কাকের মতো। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসা, মৃত্যুকে জয় করে নতুন জীবনে আসা অগণন মানুষকে স্বাগত জানাতে ভুলে গেছি আমরা। কেননা, জীবনের নিষ্ঠুর এই সময়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা প্রিয়জনকে, চেনা-অচেনা মুখকে হারাবার আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে আছি। যে মানুষটির সঙ্গে ৩ সপ্তাহ আগে হাসি-গল্পে সময় কাটিয়েছি, আচমকা শুনি তিনি নেই। যার সাথে দুইমাস আগে দেখা হয়েছে কোন অনুষ্ঠানে, খুব প্রাণবন্তভাবে গানে গানে মাতিয়ে রেখেছিলেন সকলকে, হঠাৎ একদিন দেখি সকলে শোক পালন করছেন। মানুষটি নাকি জাগতিক সকল চাওয়া-পাওয়ার সাথে সমাপ্তিরেখা টেনে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। যাকে ক্যামেরা হাতে প্রায় সকল অনুষ্ঠানে বিরামহীন ছবি তুলতে দেখেছি হাসিমুখে, একদিন খুব ভোরে চোখ মেলে দেখি তাঁর ছবির নিচে কালো বড় বড় হরফে লিখে রাখা হয়েছে ‘ আমরা শোকাহত’। আমরা অন্ধকার হাতড়ে এক চিলতে আলোর মতো বিন্দু খুঁজছি। কেননা, অদ্ভুত আঁধার এক পৃথিবীতে এসেছে আজ।

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ