বোকা মানুষ

অভি ৩১ জুলাই ২০১৪, বৃহস্পতিবার, ০১:৩০:১৭অপরাহ্ন গল্প, বিবিধ, সাহিত্য ৭ মন্তব্য

(১)
ঘনকালো ঝাকরা চুল, ঢাকা ভার্সিটি থেকে সদ্য পাস করা গ্রাজুয়েটদের মত ঝকঝকে চোখ! শাহবাগ থেকে কেনা বর্ণমালা ছাপানো একটা ফতুয়া আর রংচটা জিন্স, রফিক রুম থেকে বের হয়ে বিরক্তি নিয়ে দুটো মোটা রংচটা তালা চাবি ঘুড়িয়ে লাগলো। কয়েকবার টেনে টুনে দেখল, লেগেছে শক্ত ভাবেই। পুরোনো ঢাকার এই এলাকাটা ভালো না, চোরের উপদ্রপ আছে! রুমে দামী কিছু নেই, কিন্তু রফিক বরাবরই এমন! রুমের ভিতরে ছোট ট্যাঙ্কের সুটকেসও তালা লাগানো আছে, যদিও ভিতরে কয়েকটা খাতা আর পুরোনো কিছু বই পত্র ছাড়া কিছুই নেই! তার রুমটা অদ্ভুত, পুরনো ঢাকার হাজার অবৈধ বিল্ডিং এর মাঝে রফিকের ঘরটা আলাদা, ৮ তালার উপরে এক রুমের ঘর। নিচে প্রতি তালায় ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাক্টরি। ৪ তালার পর মনে হয় আর রাজউকের পের্মিসনের তোয়াক্কা করে নাই মালিক। একটু একটু ছোট হতে হতে ৮ তালায় ১২ ফিট বাই ১২ ফিট ছোট ঘর! দুইদিকে জানালা, একদিকে বুড়িগঙ্গা - জানলা দিয়ে একটু বামে কাত হলে সদরঘাটের লঞ্চগুলো দেখা যায়। অন্য পাশের জানালা দিয়ে রাস্তার পাসের রহমত ভাইয়ের দোকান দেখা যায়, রহমত ভাই কসাই সে প্রতিদিন একটা গরুর ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে থাকে, মাঝে মাঝে দুই একটা ছাগল নিয়া আসে! তার ব্যবসা কেমন কে জানে।
রফিক একটা হাসি দিয়ে, রহমত ভাই কি খবর? ঈদতো চইল্লা আসলো, এইবার তো আপনি ফাটাই ফেলবেন ভাই!
রহমত ভাই বরাবরের মত একটা লাজুক হাসি দিয়া ধাম করে মাংসের একটা বড় টুকরা কে দুই টুকরা করে পাসে সরায়ে রাখে।

রহমত ভাইয়ের দোকান থেকে কয়েক পা সামনে জগলুর চায়ের দোকান।
জগলু খবর ভালো? একটা চা বানা দুধ চিনি ছাড়া, কড়া লিকার আর একটা গোল্ড লিফ দে।
- জি স্যার
রফিক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ভাবলো আজকে স্বপ্নার সাথে দেখা করবে। স্বপ্না মেয়েটা দেখতে ভালো। অনেকদিন ধরে ঘেঁন ঘেঁন করে যাচ্ছে রফিকের নতুন বাসা দেখবে। বুড়িগঙ্গার তীরে শুনে উত্সাহ যেন আরো বেড়ে গেছে।

(২)

রফিক একটা রিক্সা নিয়ে ঢাকা ভার্সিটি চলে আসলো। কার্জন হলের পুকুর পারে স্বপ্না বসে আছে! খুব সুন্দর করে সেজেছে মেয়েটা, ভালই লাগছে হলুদ শাড়ীতে খুব বড় একটা টিপ পরেছে। কোনো এক দিন রফিক নাকি বলেছিল বড় টিপে ওকে ভালো লাগে। রফিকের শুধু ভালো লাগে দুটি কাজ....অপেক্ষা আর দ্বিতীয়টি রফিক বাদে আর কেউ জানে না! মানুষের কতই না শখ থাকে।
- তুমি গতকাল ফোন দাও নি কেন? তোমার ফোনও বন্ধ ছিল!
আজ তো দেখা হচ্ছে, তাই ফোন টোন বন্ধ করে নাক ডেকে ঘুম দিয়েছি।
- তোমাকে আমার একদম পছন্দ না, কেন যে দেখা করি।
এত রাগ করে না, তোমাকে আজ আমার নতুন বাসায় নিয়ে যাব।
- সত্যি বলছ? যাক মাফ করে দিলাম।
দুপুর গড়াতেই ঝুম বৃষ্টি নেমে গেলো। রফিক আজ থাক, এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে বাসায় নিয়ে কাজ নেই।
- না আজই চলো, দুজনে মিলে বুড়িগঙ্গায় বৃষ্টি দেখতে খুব ভালো লাগবে।

রিক্সা নিয়ে পর্দা টেনে দিল রফিক, দুজনে চাপাচাপি করে বসে গেল, স্বপ্নার মুখে দুষ্ট হাসি। আজই কি সেই দিন!
রফিক টুক টুক করে বলে যাচ্ছে বাসা কিন্তু খুবই ময়লা, এটা নাই, ওটা নাই!
- স্বপ্না হেসেই যাচ্ছে, তুমি এতো ভাবছ কেন? আমি তো তোমাকে চিনি।

পুরোনো ঢাকার অলিগলি পের হয়ে রিক্সা যখন রং-চটা বিল্ডিংটার পাশে থামল, তখন ঝুম বৃষ্টি। রহমত ভাইও দোকান তারাহুরা করে বন্ধ করে চলে গেছে। রাস্তায় মানুষজন নেই বললেই চলে। রফিক রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্বপ্নাকে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিড়ি ঘরের দিকে চলে গেল। সিড়িঘরেও কেউ নেই। রফিক ভাবলো আজকেই কি সেই দিন! কতদিন অপেক্ষা করে বসে আছে রফিক এই দিন টার জন্য। রফিকের অপেক্ষা করতে বড় ভালো লাগে।

(৩)

রফিক বিছনায় বসে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে একটা বেনসন ধরালো। আজকের এই বিশেষ দিনে একটা বেনসন ধরানোই যায়। মানুষের মৃতদেহের মত বিরক্তিকর আর কি আছে দুনিয়াতে? ঘরের মাঝে টেবিলে হাত পা বাধা নিস্প্রান মৃতদেহ। মরা মাছের মত পঁচা বোটকা একটা গন্ধ আসছে। রক্ত শুকিয়ে বাদামী হয়ে গেছে, রক্ত থেকে পঁচা মাছের গন্ধ আসছে। ঘরের মাঝখানে বিশাল টেবিলটা দেখে কি অবাকই না হয়েছিল বোকা মেয়েটা। নিজের হাতে চা বানিয়ে দিয়েছিল রফিক, সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল কয়েকটা কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। ঘুমিয়ে পরবার সময়ও কিছু বোঝে নি বোকা মেয়টা। হাত পা বেধে ধীরে সুস্তে অপেক্ষা করেছে রফিক কখন ঘুম থেকে উঠবে। ঘুম থেকে উঠে গায়ে কোনো জামা কাপড় নেই দেখে খুব অবাক চোখে রফিককে দেখছিল মেয়েটা। মুখ বাধা ছিল বলে শুধু গোন্গানোর একটা শব্দ আসছিল। রফিক নিজের জামা কাপড় খুলে ওর দিকে এগিয়ে গেল। স্বপ্নার চোখে বিস্ময় নগ্ন রফিককে এভাবে দেখবে কোনো দিন ভাবে নাই! রফিক স্বপ্নার নারীদেহের আকর্ষনীয় অংশগুলোর দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো না! সে টেবিলে রাখা চাকু, সর্তা, আরো কিছু এটা সেটা থেকে সর্তাটা নিয়ে হাত পায়ের আঙ্গুলগুলো একটা একটা করে কেটে ফেলল। তারপর চোখের পাতা, নাক, কান! মানুষের দেহের বাহুল্যগুলো ছাড়া মানুষ দেখতে অদ্ভুত হয়। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে গেলে রফিক আবার একটা সিগারেট নিয়ে বসে গেছে। অপেক্ষা। জীবনে এই একটা কাজই ভালো লাগা তার, আর ভালো লাগে মানুষের যন্ত্রণাকাতর মুখ, রক্ত। ছোট ফল কাটার চাকুটা দিয়ে পায়ের কাছে ছোট একটা ফুটো করে রক্তটুকু বের হতে দিল! অল্প একটু অপেক্ষা। তার হাতে রাজ্যের সময়! তাড়াহুড়ার কিছু নাই। মুখ লাগিয়ে সেই ছোট ফুটোতে ফু দিয়ে অনেকটা বেলুনের মত ফুলাতে লাগলো। মেয়েটার শরীরে মেদ নেই একদম, খুব একটা কষ্ট ছাড়াই চামড়া থেকে মাংস আলাদা হয়ে বেলুনের মত ফুলে যেতে লাগলো। এর মধ্যে বোকা মেয়েটা মরে গেছে কোনো এক সময়। চামড়াটা আলাদা করে ওকে দেখানোর অনেক শখ ছিল। মরে গেছে। প্রচন্ড বিরক্ত রফিক! বিরক্তি নিয়েই চামড়াটা আলাদা করে ফেলল দক্ষ হাতে।
জানালার পাসে শুকাতে দিয়েছে চামড়া আর চোখের পাতা, অদ্ভুত দুটি বড় বড় চোখ প্রচন্ড এক হতাশা নিয়ে রফিকের দিকে তাকিয়ে আছে। রফিক শুধু পঁচা মাছের গন্ধ পাচ্ছে। সে মাছ ঘৃনা করে। প্রচন্ড ঘৃনা করে।
রফিকের নগ্ন দেহে রক্ত, রুম ভর্তি রক্ত, অনেক কাজ বাকি এখন! রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে সময় নিয়ে গোসল করে নিল রফিক। সূর্য উঠে গেছে অনেকক্ষণ, নিচে তাকিয়ে দেখে রহমত ভাই একটা ছাগল জবাই দিয়ে ঝুলিয়ে দিছে! ফোটা ফোটা রক্ত কি গড়িয়ে পরছে ড্রেনে?
চোখের পাতাগুলো শুকিয়ে গেছে, খুব বেশি শুকানোর দরকারও নাই। রফিক তার ট্যাঙ্কের সুটকেসটা টেনে বের করে আনলো। তালা খুলে একটা বাধানো খাতা বের করে আনলো। একটা বোটকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে, নতুন একটা নাম লিখতে হবে ১১২ নম্বর স্বপ্না সরকার, সামনের খালি জায়গায় যত্নের সাথে চোখের পাতাদুটো আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিল। পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে একশত বারো বোকা মানুষের নাম আর ১১২ জোড়া চোখের পাতা!

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ