সময়টা তখন ১৯৯৩ ইংরেজি ১৪০০ বঙ্গাব্দ। সেসময় আমি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হয়নি। খামোখা দেড়বছর নিজের পরিবারবর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছিলাম। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছিল আমার বড়দি’র দেখা পেয়েছিলাম। দিদির বাড়ি খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার বড়দি’র বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া।

বীরপাড়া হলো কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে মিজোরাম যাওয়ার পথিমধ্যে। বীরপাড়া ভুটানের পাহাড় ঘেঁষা চা-বাগানের লীলাভূমি জনবহুল একটা জায়গার নাম। আর আমার বড়দি’র বাড়ি হলো, বীরপাড়া এলাকায় রাবিন্দ্র নগর কলোনি। কোলকাতা থেকে বড়দি’র বাড়ি বীরপাড়া গিয়েছিলাম খুবই বিপদে পড়ে। এমনই এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম যে, তখন আমার বড়দি’র বাড়িই ছিলো একমাত্র ভরসা। কিন্তু বড়দি’র বাড়ি ছিলো আমার অচেনা। তবে আমার মনে খুবই সাহস ছিলো এবং অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসও ছিলো। বিশ্বাস ছিলো, একভাবে-না-একভাবে আমি আমার বড়দি’র বাড়ি অবশ্যই খুঁজে বের করতে পারবো।

মনের সেই বিশ্বাস নিয়েই একদিন কোলকাতা ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গের রকেট বাসের টিকেট নিলাম। তারপর উত্তরবঙ্গের রকেট বাসে চড়ে প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর বীর পাড়ার মাটিতে পা রেখেছিলাম। যদিও কোলকাতা গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সাথে, কিন্তু কোলকাতা থেকে আমার বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম আমি একা। তবে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া জায়গাটি ছিলো আমার একেবারেই অপরিচিত অচেনা জায়গা।

তার উপর আবার আন্তর্জাতিক আইনের চোখে আমি ছিলাম পাসপোর্ট বিহীন এক অপরাধী। তবুও আমার মনের ভেতরে একটু ঢর-ভয় বলতে কিছুই ছিলো না। আমি বাস থেকে বীরপাড়া নেমেই বীরদর্পে একটা মিষ্টির চলে গেলাম। মিষ্টির দোকান থেকে ৪ কেজি মিষ্টি কিনলাম। এরপর একটা রিকশা চেপে সোজা বীরপাড়া রাবিন্দ্র নগর কলোনি বড়দি’র বাড়ি চলে গেলাম। প্রথমে আমার বড়দি আমাকে চিনতে পারছিলো না। বাবা’র নাম, মা’র নাম, বড়দা’র নাম বলার পরই বড়দি আমাকে চিনতে পেরেছিলো।

যাইহোক, যেদিন বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম, সেদিন আর ঘুরা-ঘুরি করার সময় হাতে ছিলো না। শুধু বড় ভাগিনার সাথে বীরপাড়া বাজার দেখতে গিয়েছিলাম। বড় ভাগিনা’র সাথে বীরপাড়া বাজারটি ঘুরে দেখার সময়ই ভুটান যাবার জীপ স্ট্যান্ড দেখলাম। যখন ভুটান যাবার জীপ গাড়িগুলোর হেলপাররা ভুটান ভুটান বলে বলে চিল্লা-চিল্লি করছিলো, তখন আমার মনটা আর মানাতে পারছিলাম না। কিন্তু তখন ভুটান যাবার সুযোগও ছিলো না। কারণ, তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই মনের আকাঙ্খা মনে চেপে ধরে বড় ভাগিনা’র সাথে বীড়পাড়া বাজারটির এদিক-সেদিক ঘুরে অনেক রাতে দিদি’র বাড়ি পৌঁছে ছিলাম। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমানোর জন্য শুয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সারারাত আর চোখে ঘুম আসেনি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতাম ভুটান যাওয়ার জীপ গাড়ির হেলপাররা যেন আমাকে ডাকছিল। এভাবে ছটফট করতে করতে একসময় ঠিকই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেই মনস্থির করলাম ভুটান যাওয়ার। কারণ বাংলাদেশ থেকে শুধু ভুটানের নামই শুনেছি। কিন্তু একসময় যে ভুটানের এতো সামনা-সামনি চলে আসবো, তা কোনদিন কল্পনাও করিনি।

তাই ভাবছিলাম, “যেভাবেই হোক, আর যেমন করেই হোক, আমি এখন ভুটানের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ভুটানের এতো সামনে যখন চলেই এসেছি, তাহলে হেলায় সুযোগ হারাতে আমি রাজি নই! যেভাবেই হোক, আর যে করেই হোক ভুটান আমাকে যেতেই হবে। যদি ভুটানের ভেতরে না যেতে পারি, তাহলে তো আমার ভারত আসাই একরকম মাটি হয়ে যাবে।''

এই ভেবেই সাতসকালে নাস্তা করেই কারোর কাছে কিছু না বলে ভুটানের উদ্দেশে বের হলাম।  তখন আমার সাথে ভারতীয় অল্পকিছু টাকা অবশিষ্ট ছিলো। এই অল্পকিছু  টাকা কিন্তু বাংলাদেশি টাকার মতো সস্তা দরের টাকা নয়! ওই টাকা ছিলো ভারতীয় মূল্যবান অনেক দামী টাকা। তা-ও আবার প্রায় একশো টাকার মতো! সব টাকা সাথে করে বড়দি’র বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম বীরপাড়া বাজারের শেষপ্রান্তে। যেখানে থেকে জীপ গাড়িগুলো ভুটানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সময় তখন সকাল ৯ টার মতো।

আমি বীরপাড়া বাজারে গিয়ে একটা চা’র দোকানে গিয়ে বসলাম। চা- দোকানটা হলো বাজারের শেষ মাথায়, বীরপাড়া ভুটান জিপস্ট্যান্ডের সাথেই। চা-দোকানদারকে এক কাপ চা দিতে বললাম। চা-দোকানদার আমাকে চা বানিয়ে দিলো। আমি দোকানের বাইরে থাকা টেবিলের উপরে বসে বসে চা-পান করছিলাম, আর ভুটান যাওয়ার জীপ গাড়িগুলো ফলো করছিলাম।

জীপ গাড়িগুলো আমাদের দেশের লেগুনা গাড়ির মতো। একটা জীপ গাড়িতে ১০ জন করে যাত্রী বহন করে। আমি চা পান করতে করতেই একটা জীপগাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে গুমটু গুমটু বলে ডাকা-ডাকি করতে লাগলো। জীপের ভেতরে যাত্রী ছিলো অর্ধেকের মতো। ওখানে টাইম-বাই-টাইম ঘড়ির কাটা ধরেই যেকোনো যাত্রীবাহী যানবাহনগুলো চলাচল করে। টাইম হবে তো গাড়ি স্ট্যান্ড ত্যাগ করবেই। এতে যাত্রী কম হলেও হায়-আফসোস করার সুযোগ নেই। কম যাত্রী নিয়েই গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। সেসময় বীর পাড়া বাজার থেকে গুমটু ভুটানের ভাড়া ছিলো মাত্র ৩ টাকা। বীরপাড়া থেকে ভুটান গুমটু ভুটানের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার মাত্র।

আমি তাড়া-তাড়ি করে চা’র দাম দিয়ে জীপ গাড়ির সামনে গেলাম। নিজের পকেটে হাত দিয়ে টাকার সংখ্যা দেখে নিলাম। দেখলাম, “আমার পকেটে অবশিষ্ট যা আছে, তা দিয়ে সুন্দর ঘুরা-ঘুরি হয়ে যাবে।”

এই ভেবেই মনে সাহস রেখে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা জীপের ভেতরে গিয়ে বসলাম। প্রত্যেক জিপে ১০ জন করে যাত্রী বহন করলেও, আমি যেই জিপে করে যাচ্ছিলাম সেই জিপে আমি সহ যাত্রী হলাম সাত জন। পাঁচজন ভুটানি মহিলা। আর একজন পুরুষ যাত্রী। পুরুষ যাত্রী বীরপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা। যাবে ভারত-ভুটান সীমান্ত গেইট ঘেঁষা মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে পুজো দিতে।

মাকড়া পাড়া হলো ভারত-ভুটান বর্ডার এলাকার জায়গার নাম। মাকড়া পাড়া ভারতের। আর ভুটানের ভেতরের জায়গাটার নাম হলো গুমটু। মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে প্রতিদিন বীরপাড়ার আশপাশ থেকে অনেক মানুষ পূজা দিতে যায়। আমার সাথে বসা যাত্রী ভদ্রলোকটিও মাকড়া পাড়া পূজা দিতেই সেখানে যাচ্ছিল।

চলন্ত জিপে বসেই লোকটি শুধু আমার দিকেই বেশি তাকাচ্ছিল। লোকটার হাতে কয়েক রকম ফল-ফুল, আর একটা ঝুড়ি। জীপের ভেতরে থাকতেই তিনি আমাকে কি যেন বলবে বলবে ভাব! কিন্তু কিছুই বলার সুযোগ পাচ্ছিল না।

জীপগাড়ি চলছে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দুই পাশে বন-জঙ্গল। মাঝেমধ্যে চা বাগান। এর ফাঁকে-ফাঁকে নেপালি শরণার্থীদের ঘরবাড়ি। নেপালিরা ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থী হয়েই থাকে। ওদের কোনও ভারতীয় নাগরিকত্ব নেই। যেই রাস্তা দিয়ে জিপ গাড়ি যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দু-পাশেই গহীন বন-জঙ্গল। সেই বনে বন্য হাতিও আছে। ওই হাতিগুলো সবসময় দল বেঁধে চলে। এক বন থেকে আরেক বনে যাবার সময় রাস্তা পার হয়ে যেতে হয়। তখন যানবাহনগুলো দূরে থামিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখে। যাতে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হাতির কানে না পৌঁছায়।

কারণ, সময় সময় গাড়ির শব্দে বন্য হাতিগুলো ভীষণ ক্ষেপে যায়। আর ক্ষেপে গেলেই ঘটে বিপদ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা পথচারীরা কখনো কখনো এসব বন্যহাতির কবলে পড়ে আহত নিহতও হয়। তাই বীরপাড়া টু গুমটু রোডে চলাচলকারী যানবাহনের ড্রাইভাররাও দেখে-শুনে গাড়ি চালায়। যাতে কোন প্রকার দুর্ঘটনা না ঘটে। বীরপাড়া থেকে ভুটান গুমটু যেতে সময় লাগে মাত্র ৩০ মিনিট। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম গুমটু।

জীপ থেকে নামার পর যাত্রী পুরুষ লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার বাড়ি কোথায়? কোথায় এসেছেন? কার বাড়ি? কোথায় যাবেন?’ লোকটির প্রশ্ন করা প্রতিটি কথারই ঠিক-ঠিক জবাব দিয়েছিলাম। তখন লোকটা আমার জামাইবাবু ও ভাগিনাদের চিনতে পেরেছিলো, আর আমি যে তাদেরই অতিথি সেটাও স্বীকার করে বললো, ‘আহারে দাদা, আমার হাতে সময় নেই। যদি সময় থাকতো, তাহলে আমি নিজের আমার সাথে করে গুমটু এলাকাটা আপনাকে নিয়ে ঘুরতাম।’ এই বলেই জীপের হেলপারকে ডেকে বললো, ‘এই লোকটাকে ভুটানের ভেতরে নিয়ে যাবে। তিনি আমাদের অতিথি। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। উনার ভুটান দেখার খুব শখ! তাই এখানে এসেছে। তোমরা লোকটাকে একটু সাহায্য করবে।’

ড্রাইভার-হেলপার দুইজনেই বললো, ‘ভুটানের ভেতরে যেতে কারোরই পারমিশন লাগে না, দাদা। উনিও যাবে। কোনও সমস্যা হবে না! আপনি নিশ্চিত থাকুন। তারপরও আমরাতো আছি-ই।’ এই বলেই জীপের ড্রাইভার হেলপার আমার সাথের যাত্রী ভদ্রলোকটিকে বিদায় করলো। বীরপাড়া থেকে আসা সব যাত্রীদের ভাড়া আদায় করা হলো। তারপর ড্রাইভার-হেলপার দুইজন আমাকে সাথে নিয়ে ভুটানের ভেতরে যাওয়ার সুবিশাল গেইটের দিকে যেতে লাগলো।

ভারত-ভুটান কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে সুবিশাল একটা গেইট। চেকপোস্ট ছিলো। সীমান্তরক্ষী বাহিনীও ছিলো। সীমান্ত গেইটে দুইজন করে ভুটানি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী থাকে। কে আসলো, কে গেলো তার দিকে তাদের কোনও নজর নেই। নজর থাকে তখন, যখন একটা গাড়ি ভেতরে বা বাইরে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গেইট জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে। রাতের বেলা বিশেষ কোনও জরুরি কাজে ভেতর-বাইরে যেতে পারমিশন প্রয়োজন হয়।

জিপ গাড়ির চালকের সাথে যখন সীমান্ত গেইট পাড় হচ্ছিলাম, ভয়ে তখন আমার শরীর কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ের কারণ ছিলো, “যদি সীমান্তরক্ষী আমাকে ডাক দেয়, আর যদি পাসপোর্ট চায়, যদি আমাকে আটকে রাখে?” কিন্তু না, ওরা আমাদের দিকে একটু ফিরেও তাকায়নি। আরামে চলে গেলাম ভুটান গুমটুর ভেতরে। কী সুন্দর জায়গা! মন চায় রাস্তার মাঝখানে শুয়ে থাকি। খুবই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা! শীতের দেশ ভুটান।

ভুটানিরা বারো মাস একরকম গরম জামা-কাপড় ব্যবহার করে। বারো মাসই ভুটানের আবহাওয়া একইরকম থাকে। তবে বৃষ্টির কোনও মৌসুম না থাকলেও মাঝেমধ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিতে ওরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ, পাহাড়ি জমিগুলো পানির জন্য সবসময় খাঁ খাঁ করে তাই। ওরা বছরে দুই-একবার গোসল করে। ভুটানের বেশিরভাগ মানুষেই মদ্যপায়ী। মানে সবসময়ই মদপান করে থাকে। শুনেছি মদপান নাকি ওদের শরীর গরম রাখার একটা পন্থা।

ভুটানের গুমটুতে একটা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। সেটা ভারত-ভুটানের যৌথভাবে নির্মাণ করা। বিশাল জায়গা নিয়ে ওই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। গুমটুতে পাথরের অভাব নেই। গুমটুর আশে-পাশে যতোগুলো পাহাড় আছে, সব পাহাড়ই পাথরের পাহাড়। পাথর নাকি এসব পাহাড়ে জন্ম হয়। সামান্য বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধ্বসে অনেক পাথর বের হয়। ঐ পাথরগুলোই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কাজে লাগায়। গুমটুতে সপ্তাহে একদিন হাট বসে। এটা গুমটু এলাকাবাসীর স্থানীয় সাপ্তাহিক হাট।

ওই হাটে বীর পাড়ার অনেক ব্যবসায়ীও অনেকরকম পণ্যসামগ্রী নিয়ে বিক্রি করতে আসে। একটা সিনেমা হলও আছে। সিনেমা হলটির নাম, ঔঁ (ওম) সিনেমা। ওই সিনেমাহলে ভারতীয় ছায়াছবি বেশি প্রদর্শিত হয়। ভুটানের নিজস্ব চলচ্চিত্রও আছে। তবে ওরা ভারতীয় চলচ্চিত্রই বেশি পছন্দ করে থাকে। গুমটুতে একটা বৌদ্ধমন্দির আছে। মন্দিরটি একটা পাহাড়ের চূড়ায়। অনেক উঁচু পাহাড়। তবে মন্দিরে ট্যাক্সি বা অন্য গাড়ি চড়েও যাওয়া যায়।

পুরো পাহাড়টা তিনটে প্যাঁচ দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। যাতে প্রাইভেট ছোট আকারের গাড়িগুলো মন্দিরের উপরে অনায়াসে উঠতে পারে, আর মানুষও আরামে পায়ে হেঁটে উঠতে পারে। বৌদ্ধমন্দিরটাও খুবই সুন্দর। মনোরম পরিবেশ। হেঁটে-হেঁটে পুরো মন্দিরের চারপাশ দেখলাম। বৌদ্ধমন্দিরের উপর থেকে এদিক-ওদিক তাকালেই চোখে পড়ে উঁচু-নিচু অসংখ্য পাহাড়। কোনও সড়ক মহাসড়ক দেখলাম না, নেইও। তবে একটা রেলস্টেশন আছে, যা দেখার মতো সুন্দর! এখানকার অধিবাসীরা দূর-দূরান্তের দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয় গাধার সাহায্য নিয়ে। ওইসব পাহাড়ি এলাকায় মালামাল বহন করা হয় একমাত্র গাধা দিয়েই। গাধাই ওদের মালামাল বহনের একমাত্র বাহন।

বৌদ্ধমন্দির থেকে যখন দূরে দৃষ্টি গেলো, তখন মনটা চাচ্ছিল, চলে যাই অজানার দেশে। কিন্তু যাওয়া আর হলো না। নিজের সন্তানাদির কথা ভেবে। নিজের ছেলে-মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পার করে দিলাম বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে বসেই। একসময় দুপুরের সময় পেরিয়ে গেলো। দিদি’র বাড়ি ফিরে যাবার সময় হলো। তবুও গুমটু ছেড়ে বীর পাড়া যেতে মন চাচ্ছিল না। মন চাচ্ছিল ওখানেই থেকে যেতে।

বলে রাখা ভালো যে, ভুটান গুমটু এলাকায় আমি কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ঘোরাফেরা করেছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে কিছুই বলেনি, কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। এমনকি বৌদ্ধ মন্দিরে থাকা লোকজনও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বৌদ্ধ মন্দিরে অনেকক্ষণ ঘুরা-ফেরা করার পর বৌদ্ধমন্দির থেকে পায়ে হেঁটে নিচে নামলাম। আবার গেলাম গুমটু টাউনে।

আসলে আমার চোখে ভুটানের গুমটু এলাকা টাউন নয়। কিন্তু ভুটানিদের কাছে এটা তাদের খুব পছন্দের একটা মিনি টাউন। অনেক ভুটানি গুমটুকে গুমটু টাউনও বলে। ওম সিনেমা হলের সামনে একটা হোটেল ছিলো। হোটেলটি ছিলো খুবই পরিপাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেসময় সেই হোটেলে ভাত-মাছ-সহ চা বিস্কুটও পাওয়া যেতো।

গুমটু জনশূন্য এলাকা হলেও, রাত ৮টা পর্যন্ত ওই হোটেলটি খোলা থাকতো। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা ওই হোটেলেই বেশি সময় কাটাতো। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা চা পান করা-সহ দুপুরবেলার খাওয়া-দাওয়াও ওই হোটেই করতো। কেউ কেউ রাতের খাওয়াও সেরে নিতো। হোটেলে তিন-চারজন কর্মচারী ছিলো। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছিলাম সব কর্মচারীই ছিলো ভুটানি মেয়ে।

হোটেলের সামনে সারিবদ্ধভাবে চেয়ার-টেবিল বসানো ছিলো। আমি সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে আকার-ইঙ্গিতে চা-বিস্কুটের কথা ববলেছিলাম। পাঁচ মিনিট পরই মেয়েটা একটা প্লেটে করে দুটো বিস্কুট এনে দিলো, সাথে এক গ্লাস পানি। একটু পরে চা-ও এনে দিলো। চা পান করে হাতের আঙুল ঘেঁসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত?’ বললো, ‘দে দো ৬০ নয়া।’

চা বিস্কুটের দাম দিয়ে চলে এলাম ভারত-ভুটান সীমান্ত গেইটের সামনে। সময় তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। সীমান্ত গেইটের বাইরে দেখলাম একটা জিপগাড়ি। ড্রাইভার হেলপার গুমটুর ভেতরেই ছিলো মনে হয়। হয়তো দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলো। ড্রাইভার হেলপার কখন আসবে, আর কখন গাড়ি ছাড়বে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। জিপ গাড়ির সামনে-পেছনে কোনও মানুষও ছিলো না। এমনিতে জনশূন্য এলাকা। আবার দুপুরবেলা। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা করতে করতে ড্রাইভার হেলপার হেলে-দুলে গাড়ির সামনে আসলো।

সীমান্ত ঘেঁষা ভারতের ভেতরে কোনও দোকানপাট ছিলো না। ছিলো বনজঙ্গল আর চা বাগান। কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হলে দাঁড়িয়ে থেকেই অপেক্ষা করতে হবে। না হয় মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরে গিয়ে সময় কাটাতে হবে। ড্রাইভার হেলপার জীপের সামনে এসে যাত্রীর খোঁজে যাচ্ছিল, মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরের দিকে। ওদের যাওয়া দেখে আমিও পেছন-পেছন হাঁটতে ছিলাম।

মাকড়া পাড়া কালী মন্দিরটিও একটা পাহাড়ের চূড়ায়। খুবই সুন্দর! অনেক বড় জায়গা নিয়ে মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছে। কে-বা কারা এই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় মন্দিরটি তৈরি করেছিল, তা জানা হয়নি। এ-বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি। ড্রাইভার হেলপারের পেছনে পেছনে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখে চলে এলাম জীপের সামনে। বীর পাড়ার যাত্রী নেই। সেদিন সেসময় হয়তো ওদের বীরপাড়ায় জরুরি কাজ ছিলো। তাই ওরা আমাকে নিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিলো। চলে গেলাম বীরপাড়া। বীরপাড়া নেমে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি। এর কয়েকদিন পর আবার ভুটানের আরেকটা জায়গায় দিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম ফুলসিলিং। ফুলসিলিং জায়গাটিও দেখার মতো। সে বিষয়ে নাহয় আরেকবার লিখবো। আজকে এখানেই শেষ করছি, গুমটু ভুটান ভ্রমণের গল্প।

 

বি:দ্র: আমি যখন বড়দি'র বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন বর্তমান যুগের মতো এতো এতো মোবাইল ছিলো না। যদি থাকতো, তাহলে অবশ্যই অবশ্যই সেখানকার অনেক অনেক সুন্দর ছবি আমার এই পোস্টে মাঝে আপলোড করা থাকতো। তবে এই পোস্টের ছবিগুলো ইন্টারনেট নেকে সংগ্রহ করা।

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ