মুখোশের আড়ালে মুখোশ (রহস্য গল্প) – পর্ব – ৪

আর্বনীল ২০ মার্চ ২০১৫, শুক্রবার, ০৯:৩৯:৪৫পূর্বাহ্ন গল্প ২ মন্তব্য

দুপুর ১টা ৫৩ মিনিট।
আবীর বাড়ির মুল ফটকের পাশেই মেঝেতে বসে আছে। এখানটায় রোদ আসে না। সামনে নানা জাতের ফুলের গাছ। বাতাসের ঝাপ্টায় এক একটা ফুলের ঘ্রাণ এসে নাকের ডগা ছুয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বই পরার জন্য জায়গা এবং সময় দুটাই একেবারেই পার্ফেক্ট। আবীর তার হাতে রবি ঠাকুরের কবিতার বইটা মেলে ধরল। কবিতার নাম ‘রাহুর প্রেম’। মাঝে মাঝেই এই রাহু এসে তার মাথা এলোমেলো করে দিয়ে যায়। এখনও দিচ্ছে –

“কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে,
কখনো সমুখে কখনো পশ্চাতে,
আমার আধার কায়া।
গভীর নিশীতে একাকী যখন
বসিয়া মলিন প্রানে,
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে আমিও
রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখ পানে।”

একজন বয়স্ক লোক টিফিন ক্যারিয়ার হাতে করে আবীরের সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটার চুল দাঁড়ি দেখে মনে হচ্ছে মাত্র দু-একদিন আগে রঙ করিয়েছে। এই বয়সের বুড়োরা এটা করে যে কি আনন্দ পায় কে জানে! কে আপনি?
বুড়ো লোকটা বলল, আমি বাশার। তাথৈ মা আপনাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। আবীর বলল, ও আচ্ছা! আপনি বাশার চাচা। ওকে এটা দিন আমাকে। লোকটা টিফিন ক্যারিয়ার আবীরের হাতে দিল। সাহেব! একটা কথা ছিল বলব?
কি কথা বলুন। লোকটা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। বলল, না থাক! পরে এক সময় বলব। আমি এখন যাই। আবীর বলল, শুনুন! এখনতো খাবার চলে এল। কিন্তু রাতের জন্যতো একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। নাকি? লোকটা বলল, সে ব্যাবস্থা হয়ে যাবে সাহেব। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আসি।

রোবেন পুরো বাড়ির ভেতরটা আবারও ঘুরে দেখতে শুরু করল। কারণ ঘর সংখ্যা এখনো ৩২টা। কিন্তু বাবা ডায়রীতে লিখে গেছে ৩৫টা। তাহলে বাকী তিনটা ঘর কোথায়? তাছাড়া বাবা এই বিষয়টা ডায়রীতে পরিস্কার করে লিখে যায়নি কেন? উনি লিখেছেন এভাবে – ‘৩২টা+(৩টা) = ৩৫টা ঘর’। এভাবে লেখার কারণ কি? রোবেন ভাবতে লাগল। যে করেই হোক এই লেখার মানে খুঁজে বের করতেই হবে। তাছাড়া মাত্র তিনটা ঘরের ব্যাবধানে বাড়ির মোট দরজা সংখ্যা ৬৭ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ এ! তারমানে বাকী তিনটা ঘরেই আছে ২৪টা দরজা! কিন্তু কেন? মাত্র তিনটা ঘরে এতগুলো দরজা থাকবে কেন?

সকাল ৭টা ২০মিনিট।
বাড়ির সেন্টার রুম। এই রুমটা অনেক বড়। যে কারণে এটাকে এখন ড্রয়িং রুম হিসেবে ব্যাবহার করা হচ্ছে। বাড়ির মুল ফটক দিয়ে ঢুকলেই এই রুমটা আগে পরে। এবং অন্যান্য ঘরে যেতে হয়ে এই ঘরটা থেকেই। রোবেন তার ঘর থেকে বের হয়ে এই সেন্টার রুমে এসে দাঁড়াল। কেননা, কাল রাতে সে তার বাবার ডায়রীটা নিয়ে আবারও বসেছিল। এই ডায়রীটা যতবার পড়া হচ্ছে ততবারই কোন না কোন নতুন তথ্য বের হচ্ছে। যেমন গত রাতে বের হয়েছে সিংহাসনের অবস্থান। বাড়িটার মুল ফটক দিয়ে ঢুকে সোজা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাত সামনের জায়গাটা একটু উচু করে বানানো হয়েছে। এই জায়গাটার উপরই একটা রাজকীয় সিংহাসন বসানো। তার মানে এই ঘরটাই আগে বিচার/রাজ সভা হিসেবে ব্যাবহার করা হত। এবং বাবার স্বপ্নের শুরুটা হয়েছে এখান থেকেই। কিন্তু এটা ঠিক কতদিন আগের ঘটনা হতে পারে? ১০০ বছর, ২০০ বছর, নাকি তারও বেশী? ভাবে রোবেন। সে ধীরে ধীরে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনে কেউ একজন অচেতন অবস্থায় পরে আছে। রোবেন মানুষটার কাছে যেতেই দেখল এটা আর কেউনা। আবীর! কিন্তু ও এখানে আসল কেমন করে? তাছাড়া ওর এই অবস্থাই বা হল কি করে? তাহলে কি ওর সাথে...... ওহ গড!

আবীরকে তার রুমে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়েছে। তাথৈ দেখে বলল, আমি কিছু মেডিসিন দিয়ে যাচ্ছি। আশাকরি ঠিক হয়ে যাবে। আর আপনি আমার সাথে একটু বাইরে আসুন তো। রোবেন তাথৈয়ের সাথে সাথে ঘর থেকে বের হয়ে এল। তাথৈ! আবীরের তেমন কিছু হয়নিতো?
তাথৈ বলল, না না তেমন কিছু হয়নি। তবে আমার ধারনা কোন কারনে উনি প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন। এবং এখানে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এটা আমি আপনি সবাই জানি। বাই দ্যা ওয়ে, উনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। আপনার কাছে একটা রিকুয়েস্ট! এখানে থেকে অযথা বিপদ ডেকে এনে লাভ কি বলুন? তার চেয়ে আপনার বাড়ি কেনার টাকাটা নিয়ে চলে যান। রোবেন বলল, এখান থেকে এভাবে আমি চলে যেতে পারিনা। আমাকে এই রহস্য সমাধান করতেই হবে। তাছাড়া লাইফের ফার্ষ্ট মিশনেই আমি ফেইল করতে চাইনা।
তাথৈ বলল, জানতাম আপনি রাজী হবেন না। কারন আপনি এসেছেনই এসব নিয়ে ঘাটাতে। আমার আর কিচ্ছু বলার নেই। কিচ্ছুনা। আমি আসছি। আপনারা সাবধানে থাকবেন।

রোবেন এসে আবীরে পাশে বসল। তোর এই অবস্থা দেখে আমার সত্যি খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা! তোর সাথে Exactly কি এমন হয়েছিল আমাকে একটু খুলে বলবি? মানে তুই আসলে ঐ সিংহাসনের পেছনে কেন গিয়েছিলি? আবীরের চোখে-মুখে আবারও ভয়ের চাপ ফুটে উঠেছে। সে শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করল। রোবেন ধরে উঠিয়ে দিল। আবীরের শরীর কাঁপছে। এ থেকে রোবেনের বুঝতে বাকী রইলনা যে, আবীর কি পরিমানে ভয় পেয়েছে।
আবীর বলতে শুরু করল, আসলে কাল রাতে বশির চাচা আমাকে দু-বোতল হুইস্কি দিয়ে গিয়েছিল। আমি বোতল দুইটা আগ্রহ নিয়ে রাখলাম। যেহেতু এর আগে এসব আমি খাইনি। রাত তখন দুইটা কি আড়াইটা হবে। আমার ঘুম আসছিলনা। ভাবলাম ড্রয়িং রুমে ঐ সিংহাসনের মত চেয়ারটায় বসে বোতলটা খুলব। আমি ধীরে ধীরে সিংহাসনটার উপর গিয়ে বসলাম। নিজেকে তখন রাজা রাজা মনে হচ্ছিল। মানে তখনকার ফিলিংসটা আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এই বাড়িটা অন্যসব বাড়ির মত নিরাপদ নয়। এখানে যেকোন সময় যেকোন কিছু হতে পারে। আর আমার...আমার সাথেই.... এতটুক বলেই আবীর হাপিয়ে উঠল। পা... পানি! পানি খাব।
রোবেন পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। আবীর এক চুমুক পানি খেয়ে আবার বলতে শুরু করল – আমি বোতলের মুখটা খুলেছি মাত্র। হঠাৎ করে চেয়ারটা হালকা একটু কেঁপে উঠল। আমি মনের ভুল ভেবে পাত্তা দেইনি। তারপর আমি যখন বোতলটা মুখে দিতে যাব ঠিক তখনই কিছু বুঝে উঠার আগে আমি পেছনে উল্টে পরলাম। সাথে সাথে আমার হাতের বোতলটা পরে ভেঙ্গে গেছে। আমি ভাবলাম চেয়ারটা অনেক পুরনো তাই হয়তো কোথাও ভেঙ্গে-টেঙ্গে গেছে বলে পরে গেছি। নিজেকে সামলাতে আমার প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ সেকেন্ড সময় লেগেছিল। তারপর উঠে দেখি চেয়ারটা জায়গামতই আছে। অথচ আমার পুরোপুরি মনে আছে আমি চেয়ারটা সহ উল্টে পরেছিলাম।
তারপর কি ভেবে আমি চেয়ারটায় আবারো বসতে এগিয়ে গেলাম। ঘর অন্ধকার থাকায় পুরোপুরি কিছু দেখা না গেলেও বুঝা যাচ্ছিল চেয়ারটায় কেউ একজন বসে আছে। আমি মানুষটার মুখ দেখার চেষ্টা করলাম। ঠিক তখনই কোথায় যেন দপ করে আগুন জলে উঠল। আর আমি নিজের চোখে দেখলাম জগতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। একটা মানুষের মুখ এতটা কুৎসিত! এতটা বীভৎস হতে পারে আমি জানতাম না। আমি জীবনে কল্পনাও করিনি কখনও এমন কিছু। আস্তে আস্তে আগুনটা বাড়তে লাগল। আর আমি দেখলাম মানুষটার মুখ থেকে লালা ঝরার মত করে রক্ত ঝরে পরছে। উফ! কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য!
আবীর উত্তেজিত হয়ে গেছে। তার শরীরের কাঁপুনিটাও বেড়ে গেছে। রোবেন বলল, ওকে আবীর শান্ত হ’। আর বলতে হবে না। যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। তুই শান্ত হয়ে বোস।
পা...পানি খাব। রোবেন পানির গ্লাসটা আবারও এগিয়ে দিল। তুই এবার বিশ্রাম কর। আমি একটু আসছি। কেমন?

রোবেন ড্রয়িং রুমে এসে দেখল। কোথাও কিছু নেই। না সিংহাসনের কিছু ভাঙ্গা আছে। না আছে কোন রক্তের ছিটে ফোঁটা। তাহলে কি এটা সত্যি কোন ভৌতিক কিছু ছিল? উহু! কেন জানি মন মানতে চাইছেনা। নিশ্চয় এখানে অন্য কোন ঘটনা আছে। এবং সেটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। রোবেন আরো কিছু সময় খুজা-খুজি করল। যদি কোন ক্লু পাওয়া যায়। যেটা দিয়ে অন্তত মনকে বুঝানো যাবে এটা ভৌতিক কিছু নয়। কিন্তু না! তেমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। রোবেন এখানে আর সময় নষ্ট না করার সিদ্ধান্ত নিল। এখন বরং অন্য কিছু ভাবতে হবে। আচ্ছা! এখানের কোন কিছু আমার চোখ থেকে এড়িয়ে যায়নিতো?

চলবে...

৩য় পর্ব - http://www.sonelablog.com/archives/29966

0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ