বন্ধু

রেজওয়ান ২৬ নভেম্বর ২০১৮, সোমবার, ০২:১৬:৫৪অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি, গল্প ৮ মন্তব্য


হয়তো ক্লাশ থ্রিতে উঠবো কিন্তু আবার স্কুল চেইঞ্জ করতে হবে বাবার চাকুরীর সুবাদে! আগেরবার অনেক বলেছি নতুন স্কুলে পুরোনো ইউনিফর্ম পড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। আমার কথা কানেই তুলে না!! তো এইবার বলেই দিয়েছি নতুন ড্রেস না দিলে আমি স্কুলেই যাবো না। মাত্র ৩য় শেণীতে উঠবি আবার নতুন ড্রেস?? কে শুনে কার কথা আমি তো অনর! এর দু'দিন পর বাবা একটু রাত করে বাসায় ফিরলেন হাতে এক প্যাকেট নিয়ে। দেখেই বুঝেছিলাম ওটা আমার জন্য! "আমার ইউনিফর্ম!!" নতুন ড্রেস এখন ই পড়তে হবে বলে আবার বায়না, বকা হলো দু'টো থাপ্পড় ও পরলো গালে আমারমার এই জিদের কারনে!!

কান্নাকাটি করে না খেয়েই ঘুমোতে গেলাম! সবাই ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি উঠে আমি ইউনিফর্ম খুব সুন্দর করে ইন করে পড়লাম, আর ওটা পড়েই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে মা'য়ের ডাকে ঘুম ভাংলে টের পেলাম রাতে যে ইউনিফর্ম পড়ে ঘুমিয়েছিলাম সেটা সহ বিছানা ভাসিয়ে দিয়েছি!!

আশ্চর্য কেউ কিছু বললোই না! না বকা না মারা...কথায় আছেনা ভাগ্যের লিখন, না যায় খন্ডন!! কি আর করা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে সেই পুরোনো ইউনিফর্মটা পড়েই নতুন স্কুলের দিকে রওনা হয়েছিলাম!!

অনেকদিন পর স্মৃতী আউরে উপরের কথাগুলো শেয়ার করছিলাম মেঘের সাথে। সে শুনে হেঁসেই কুটিকুটি। বললো তুই একদিকে যেমন জ্ঞানগর্ভর কথা বলিস আরেক দিকে জোঁকার ও! স্পষ্ট করে বলে দিলাম i hate that character! you can call me anything but jokers!

মেঘ সম্পর্কে একটু বলি- পরিচয় টা কলেজের থেকেই তবে সখ্যতা বা চেনা জানা স্টুডেন্ট লাইফের পর। যাইহোক ফিরে আসি মেঘের কাছে! আগে ফিজিক্যালি তারপর অফিশিয়ালি বর্ননা।

ছেলেটা দেখতে ফর্সা তবে নাদুসনুদুস না, আমার ই মত চিকন-চাকন ও চশমা পড়ে! বুঝে সবই তবে ভাবে থাকে ভাজা মাছটা উল্টিয়ে খেতে জানে না! কিন্তু আমি দেখেই বুঝে ফেলেছি "হালায় একটা পিস!"

কাহিল হলেও খেয়াল করতাম ওকে কেউ ড্রাগ এডিক্টেড বলতো না যেমনটা আমাকে বলতো সিগারেট খেতাম বলে!সত্যি বলতে এ নিয়ে আমার হিংসা হতো কারণ আমি শুধুই সিগারেট খাই তাছাড়া মদ,গাঁজা বা অন্যকোনো ড্রাগস নেই না। শুধু কালো ও সিগারেট খাই বলেই কি আমি ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে গেলাম?? মেঘের কাছে ফিরে আসবো এখন একটু আমার কথা বলি।

একটা সময় আমি লোকের কথা ইগনোর করা শুরু করলাম, ভাবতে লাগলাম কেউ বললো তাই কি হয়ে গেলো? আমিতো জানি আমি কি! আমার ব্যাপার লোকে ঠিক করে দেওয়ার কে? আমার অস্তিত্ব আমার ব্যক্তিগত অনুভব সবই আমার, অন্যকেউ ডিসাইড করার কে? সম্পূর্ণ একা চলা শুরু করলাম! কলেজে যাই না, একা একাকা ঘুরে বেড়াই, দেখি নিম্নবিত্ত লোকেদের জীবনযাপন, কতটাই না কষ্ট করে ওরা! এক বেলা খাবার খায় তো দুই বেলা না খেয়ে থাকে!

কেউ রিক্সা চালায় তো কেউ প্লাস্টিক বোতল টোকায়! খুব খারাপ লাগতো তাদের জন্য কিন্তু আমি তো ছোট তেমন কিছুই করতে পারি না, সাহায্য বলতে বাবার দেওয়া হাত খরচের টাকা বা তথাকথিত রাজনৈতিক গ্রুপের উপরি ইনকামের অংশ!

এঁদের কষ্ট দেখে খুব খারাপ লাগতো সব চেয়ে বেশি খারাপ লাগলো একদিন যখন টংগী রেলস্টেশনে রাত কাটালাম! সময় টা ছিলো শীত কাল, প্রচন্ড শীতের মধ্যে কেউ খালি গায়, কেউবা শুধু ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে!

রাত প্রায় একটা। স্টেশন থেকে একটু দূরে ভাঙ্গা একটা ট্রেনের বগি! নিভু নিভু আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে গেলাম। কিছু ইয়ং ছেলে মেয়ে একসাথে কি যেনো করছে, সবাইকেই তো আমি চিনি! এরাই তো দিনে কেউ চানাচুর,ভেলপুরি, ফুচকা বিক্রি করে তো কেউ ট্রেন আসলে কুলির কাজ করে! পরিচিত দেখে আরেকটু এগিয়ে যেতেই আমাকে দেখে এক মেয়ে বললো- ভাল ভাই তুমি এইখানে আইসো না! (ওরা সবাই আমাকে ভাল ভাই বলে, কিন্তু কেন জানি না!) আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিরে নাসরিন কি করছিস তোরা? পাশে বসে থাকা একটা ছেলে বলে উঠলো ড্যান্ডি খাই, খাইবেন? নাসরিন উঠে গিয়ে ছেলেটাকে থাপ্পড় দিয়ে বসলো! ছেলেটা ছোট হওয়ায় কিছু বললো না, অন্যান্য সবাই এক এক করে উঠে চলে গেল শুধু নাসরিন গেলো না। সবাই চলে গেলে নাসরিন বললো-
-চলেন ভাল ভাই স্টেশনের দিকে যাই, ট্রেন আহনের টাইম হইছে।
-চল যাই, তবে এটা বল তরা নেশা করতেছিস কেন?
-কি করমু কন! ভাল্লাগেনা এই জীবন!
-চল আমিও একদিন গাঁজা ট্রাই করবো, দেখবো কেমন লাগে!
-না ভাই কি কন! আপনে নেশা করবেন ক্যা? আপনের কি কিছুর অভাব?
-আমার তো কিছুই নাই রে নাসরিন। আর নেশা করতে কোনো উছিলা লাগে নাকি? যা লাগে তা হলো ইচ্ছা!
-কি কন ভাই কিছুই তো বুঝতাছি না।
-বুঝবিনা তুই! একটা কথা বলতো গাঁজা কার কাছে পাওয়া যাবে?
-না ভাই কওয়া যাইবো না। পরে আপনে খাইবেন তাই না ভাই?
-যা ই করি তুই না বললেও খুজে নিতে পারবো সমস্যা নাই। চল যা সামনে হাট চুপচাপ।
-ভাই কি রাগ করলেন?
-না রাগ করার কিছু নাই। আমি জানি তুই চাস আমি নেশা না করি। তাই বলছিস না কিন্তু আমি নেশা করার জন্য না এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য ট্রাই করবো!
-আচ্ছা ভাই এক্সপেরমেট কি?
-হাহা এক্সপেরিমেন্ট! হলো গবেষণা।
-কি কন বুঝি না তয় আমি চাই আমার ভাল ভাই নেশা না করুক।
-ওই তুই যা তো এখন! আমি পরে আসতেছি!
-না ভাই আপনে গাঞ্জা খুজতে যাইবেন জানি,আপনে আহেন আমার লগে বলেই হাত ধরে স্টেশনে নিয়ে এলো!

আমার মাথায় তো গাঁজার ভুত চেয়ে বসে আসে। যাইহোক ব্যবস্থা করে ফেললাম কিন্তু খাচ্ছি না, সামনে নিয়ে বসে আছি। এক দিকে স্ট্রেস অন্য দিকে নিষঙ্গ সাহস করে সিগারেটের সাথে মিশিয়ে জ্বালিয়েই ফেললাম।

বাহ্ ব্রেন তো অনেক হাল্কা লাগে! এটা কোথায় ছিলো এতদিন? আসতে আসতে আমি বেশকিছু ড্রাগসের সাথে জড়িয়ে পরলাম। পড়াশুনা বাদ দিয়ে এগুলোই নিয়ে থাকি,প্রায় দুই বছর পর একদিন বাসায় জানতে পারলে আমাকে হৃহ্যাবে দেওয়া হলো, কে শুনে কার কথা ২ দিনের মাথায় পালিয়ে এলাম। ঘড় বাহির করে হঠাৎ একদিন মনে হলো কি করছি? একটা সময় আমি এইগুলার বিরুদ্ধতা করতাম, যদিও আমাকে সবাই নেশাখোর বলতো কিন্তু আমি নেশা করতাম না। আর এখন কেউ বলে না কিন্তু আমি নেশা করি এটা মস্তবড় ভুল হচ্ছে! ছাড়তে হবে যেভাবেই হোক, জানি কষ্ট হবে বাট ছাড়বোই!! প্রথম মাস অনেক কষ্ট হলো, সিগারেট ছাড়া কিছুই নিলাম না, দ্বিতীয় মাসে কষ্ট কমে গেল অনেকটাই! নিজেকে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক মানুষের মতই। পড়াশুনা আবার শুরু করলাম এখানেই পরিচয় মেঘের সাথে। প্রথমে ছেলেটাকে সাদা বিলাই বলতাম। পরে মেঘ বলেই ডাকি। আসলে মেঘ নামটা আমার ই দেওয়া যদিও আকিকা দেই নাই হা হা হা।

একদিন কলেজে একা বসে আছি, হঠাৎ পেছন থেকে এসে জিজ্ঞাসা করলো-
-কিরে রেজওয়ান কি করিস একা একা?
-মেঘের খেলা দেখি!
-মন খারাপ?
-হুম একটু বিচলিত!
-এতদিন কোথায় ছিলি?
-বাদ দে অন্যদিন শুনিস! এখন দেখ সূর্য থেকে আসা কাঠফাটা রৌদ্রকে আড়াল করার জন্য একফালি সাসাদা মেঘটা কত কশরত ই না করছে!
-কবি নাকি ফিলোসোফার হওয়ার চেষ্টায় আছিস? আসল কথা বল কি হয়েছে?
-আসলে বেশ কয়েকটা বিপদে আছি! অনেক টাকা দরকার, স্টেশনের বাচ্চা গুলা বিপদে আছে! ওদের স্কুলে দিতে চাই, সাপোর্ট দরকার অনেক! কিন্তু আমার তো এমন কেউ নেই যে সাপোর্ট করবে তাই মনটা খারাপ।
-মন খারাপ করিস না বলে সেই দিন ছেলেটা আমার হাত টা ধরে বলেছিলো দায়সারা সাহায্য করার চেয়ে এভাবে যে হাত ধরে সাথে যে চলতে পারে সে ই তো আসল বন্ধুরে পাগলা। আমি সেদিন কিছুই বলি নাই শুধু ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও আমাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ওর মেন্টালি সাপোর্টটার জন্যই হয়তো অনেক বড় বড় পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছি! ছেলেটা ঠিক সেই সাদা মেঘের মত। যদিও সে জানে কঠিন উত্তপ্ত সূর্যকে বেশিক্ষণ আড়ালে রাখা সম্ভব না তারপরেও পৃথিবীর সন্তান গুলোকে উত্তাপের হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও রক্ষা করে! নিজে গলে পৃথিবীকে জল দেয়। একজন বন্ধুর কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া টা নিজের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আর চাওয়া বা আশা করাটাকে বোকামি/মূর্খতা হিসেবেই দেখি!!

কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বাবার ইচ্ছায় দেশের বাহিরে এলাম। এর পরেই মেঘের সাথে আমার সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে! অনেক সময় অনেক কিছুর সাজেশনের জন্য, একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য ফেইসবুকে প্রায়ই কল দিতো। আমিও কথা বলতাম মন খুলে, অনেকেই সন্দেহ করতো আমি সমকামী নইতো? পাত্তা দিতাম না। কথা বলতাম অনেক বিষয়ে! কেমন যেন একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে! আমি জানি ও কখনোই আমার ক্ষতি করার চিন্তাও করে না। অনেক নতুন কিছু শিখেছি,শিখছি প্রতিনিয়ত।তবে ওদের কাজকর্ম, কথাবার্তা ই আমার বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছে, শিখিয়েছে - আনন্দে, বিরহে বা কষ্টের সময় হাতটি ধরে "পাশে আছি বলে আশ্বাস দেওয়ার নাম ই বন্ধুত্ব!"

🌹নোটঃ একজন বন্ধুর কথা বললেও আসলে এমন বন্ধু ছিলো তিন জন বর্তমানে আছে দুই জন। প্রথম বন্ধু আমাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেছে সেই ২০০৪ সালে! তোরা ভাল থাকিস সব সময়। এভাবেই পাশে থাকিস।

🍷চিয়ার্স

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ