প্রাচীন মিসরীয় সমাজের গঠন প্রণালি

 

প্রাচীন মিশরে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতো গড বা দেবতা   তাদের জন্য যা দরকার সবই সে দিয়েছে। এখন এগুলো উপভোগ করার জন্য একজন গড বা দেবতা  দরকার যে কিনা সব কিছু দেখভাল করবে এবং হারমনির  সাথে  ব্যাল্যান্স বজায় রাখবে। আর তাদের দেবতা ম্যাট ( Ma’at) এই দায়িত্ব পালন করবে।

 

বিভিন্ন গবেষক তাদের দেয়াল চিত্র আর লেখা পড়ে এই সিদ্ধান্তে  আসে যে সমাজে যদিও অনেক শ্রেণি বিন্যাস ছিল  এবং তাদের কাজের ধরনও  ছিল আলাদা কিন্তু উঁচু শ্রেণির মানুষের কাজ ছিল সবার সাথে সওহার্দ  মূলক ব্যাবহার করা এবং সব কাজ কে সন্মান দেয়া ।

 

যতদিন পর্যন্ত এই ব্যাল্যান্স ঠিক ঠাক ছিল ততদিন এই সভ্যতা  উপরের দিকে উঠেছিল। ব্যাল্যান্স যখন ভেঙ্গে পড়ে সমাজও তখন ভেঙ্গে পড়তে থাকে । মানুষকে দেখভাল ঠিক মতো না করলে মানুষ বিগড়ে যায় সভ্যতারও শেষ হয়। প্রাচীন মিশরেও তাই হয়েছিল ।

কার কেমন ক্ষমতা ছিল ঃ 

রাজা বা ফ্যারোঃ

দেয়াল চিত্রের লেখনি আর  চিত্র দেখে স্কলাররা বুঝতে পেরেছেন প্রাচীন মিশরে রাজা ছিল সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর মনুমেন্ট বা পিরামিডের আকৃতি দিয়েই তার প্রমাণ। 

হাই অফিসিয়াল আর দরিদ্র কৃষকের টুম্ব বা কবরের আকৃতি এবং নির্মানের বহর দেখেই বোঝা যায় সমাজে কে কতটা ক্ষমতা ধারী । 

তবে একজন কৃষক বা সাধারণ লেবার  যে তার  কবরে পিরামিড বানাতে পারবে না তা কিন্তু নয়। এবং তাতে বাধাও ছিলনা। অফিসিয়াল দের কবরে মাস্তাবা দেখা যায় । 

পিরামিড যুগ শেষ হয় নুতুন কিংডমের আমলে। তখন ফ্যারোরা লাক্সরের পশ্চিমে,  পাহাড়ের নিচে আন্ডার গ্রাউনডে একের পর ঘর বানায় তাদের মৃত দেহ রাখার জন্য। প্রত্যেক ঘর ভর্তি করে দেয়া হতো ধন রত্ন আর নিত্য ব্যাবহারের জিনিস দিয়ে। দেয়াল থাকতো কালারফুল লেখা আর ছবি। এই অঞ্চল টিকে বলা হয় ভ্যালি অফ দি কিং। সেই ছবি গুলোতে দেখা যায় রাজার মাথায় মুকুট বা ক্রাউন । যা দিয়ে বোঝানো  হয় সে একজন রাজা । 

নারীঃ 

রাজাদের কবরের মধ্যে বা আলাদা পিরামিড বানিয়ে তাদের স্ত্রী বা রানী এবং রাজকন্যা দের কবর দেয়া হতো ।নারীকে সন্মান দেয়া হতো পুরুষের মতোই। মাতৃত্বকে গুরুত্ব দেয়া হতো এবং এই কাজ যে একজন নারী কাঁধে নিয়েছে এই জন্য তাকে মূল্য দেয়া হতো। একজন পুরুষ ইচ্ছা মতো ডিভোর্স দিতে পারতোনা ডিভোর্স দিলে অনেক জরিমানা দিতে হতো সম্পত্তি দিয়ে দিতে হতো যাতে সন্তান নিয়ে তাকে রাস্তায় পড়তে না হয়। স্বামীর অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নারী স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারতো । নারী  সম্পত্তি কিনতে বা ব্যাবসা করতে পারতো। বাবার সম্পত্তির মালিক হতো ভাইয়ের মতো সমান ভাবে। 

 

রুলিং ক্লাস বা শাসক শ্রেণীঃ

 

প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজার পরিবারের সদস্যরাই এই সব পদ পেতো , রাজার উপদেষ্টা বা রাজার পরের পদ কে বলা হয় ‘ভাইজার’ এবং এই পদ গুলো রাজার পরিবার থেকেই নেয়া হতো । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ভাইজার ‘ নেদারম্যাট’ রাজা ‘ সেনেফেরুর’ পুত্র ছিল।

র‍্যামেসেস ll এর একশত পুত্র ছিল এবং তারাকে বিভিন্ন গুরুত্ব পুর্ন পদে নিয়োগ  দিয়ে ছিল রামেসিস ll , যাতে দেশ পরিচালনায় বিশ্বাস  যোগ্যতা বজায় থাকে।  কবরের দেয়ালের আর্ট দেখে বোঝা যায় সোশ্যাল স্ট্যাটাস । যেমন সন্মানিত ব্যাক্তি কে লম্বা করে আঁকা হয়  আর ছোট করে এঁকে বোঝানো হয় ক্ষমতার দিক থেকে একটু কম। 

ওয়ার্কার ভিলেজ এবং এখানে বসবাস রত লেবার শ্রেণীঃ 

প্রাচীন  মিশরে সমস্ত বিরাট বিরাট স্থাপনার পাশে ওয়ার্কার ভিলেজ পাওয়া গেছে। সেই সমস্ত ভিলেজে খনন করে আর্কেওলজিসট রা তাদের কবর এবং বাড়িঘর আর মাটির বাসন পেয়েছেন।যা থেকে তাদের জীবন যাত্রার অনেক কিছু জানা গেছে। ‘ডায়ার - এল -মেদিনা’ হল একটা ওয়ার্কার ভিলেজ । যা পাওয়া গেছে লাক্সরের পশ্চিম পাড়ে ভ্যালি অফ দি কিং এর নিকটে । 

তাদের কবরের দেয়াল চিত্রে দেখা যায় তারা কি ভাবে কাজ করতো ,কৃষকের ধান কাটা, মাছ ধরা , আটা বানানো, নৌকা চালানো বা গরু চরানোর কাজ। কি ভাবে কবরের ঘরের  কাজ করে তারা যেমন পাথর কাটা, ছবি আঁকা, প্লাস্টার করা ইত্যাদি। সেখানে পাওয়া প্যাপিরাসে লেখা কাগজে দেখা যায় তাদের ঠিক মতো মজুরী দেয়া হয়নি বা দেরি করে দেয়া হয়েছে, যার ফলে তারা স্ট্রাইকে যেতে হয়েছে। সুপার ভাইজারের ম্যানেজমেন্টের এবং লেবার  দেকভালের ব্যাপার টির লেখা একটা মাটির ফলকে পাওয়া গেছে। একজনের কবরে বক্স ভর্তি বিল্ডিং করা টুলসও পাওয়া গেছে। যা দিয়ে বোঝা যায় কি ব্যাবহার করতো তারা কবর করার জন্য এবং কতখানি এডভান্স ছিল তারা। 

কৃষকঃ 

কৃষক শ্রেণী ছিল মোট জনসংখ্যার ৮০% । দেয়াল চিত্রে দেখা যায় কৃষক লাঙল দিয়ে জমি চাষ করছে। 

স্লেভঃ 

সব চেয়ে নিচের শ্রেণী ছিল স্লেভ এবং বাইরের দেশ থেকে ধরে আনা মানুষ। তবে স্লেভ শ্রেণী অন্য সভ্যতার সমাজের স্লেভ থেকে ডিফারেন্ট ভাবে আচরণ পেতো । তারা ইচ্ছা করলে পেসা  বদলের মাধ্যমে উপরে উঠতে পারতো বিয়ে করে সংসার করতে পারতো। 

এই ছিল মোটামুটি প্রাচীন মিশরের সমাজ ব্যাবস্থার শ্রেণী বিভাগ। 

তবে এই শ্রেণী বিভাগে  পরিবর্তন হয় মিডেল কিংডমে এবং নিউ কিংডমে। রাজ্যের আয়তন এবং উন্নতি  বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী বিভাগে পরিবর্তন আসে । পরিবর্তন আসে রাজা যখন সাধারণ শ্রেণী এবং নিজেদের মধ্যে ব্যাল্যান্স ধরে রাখতে পারেনি তখন।

এখন আমরা দেখবো কি সেই কারন গুলো। 

শিক্ষাঃ 

যখন সাম্র্যাজ্য বড়ো হতে লাগলো তখন সেটিকে ঠিকঠাক মতো চালনার জন্য শিক্ষিত মানুষের দরকার  আরম্ভ হলো । তখন শিক্ষিত যুবক  শ্রেণী  শিক্ষা গ্রহণের পর  ‘সসিয়াল ল্যাডারে’ উঠতে সক্ষম হয়।

সৈন্য বাহিনীঃ  

আবার দেশ রক্ষা বা দেশের সীমা বৃদ্ধি করার জন্য শক্তিশালী সৈন্য বাহিনীর দরকার তখন এই শ্রেণীকে ভালো বেতন দিয়ে তাদের সুবিধা বাড়ানো হয় এবং তাদের সন্মান বৃদ্ধি হতে থাকে। 

প্রিষ্ট বা ধর্মীও গুরুঃ 

টেম্মপেলের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রিসট বা ধর্মিও গুরুর সংখ্যা যেমন বেড়ে যায় তাদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়    প্রাচীন মিশরীয়রা ধর্ম ভীরু ছিল আবার দেশ পরিচালনার জন্য এই ধর্ম গুরুদের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের গুরুত্বও বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ  সমাজে তাদের সন্মানও  বেড়ে যায়।  

রাজমিস্ত্রি বা বিল্ডিং ওয়ার্কারঃ 

রাজ্যে ম্যাগ্নেফিসেনট গ্লোরিয়াস স্থাপনা , যেমন বড়ো বড়ো পিরামিড,  টেম্পেল , টুম্ব বা পাহাড়  কেটে সমাধি বানানো, ফসল রাখা আধার বানানো এবং তাদের প্যালেস তৈরির  জন্য অনেক রাজমিস্ত্রির দরকার পড়তে থাকে। ফলস্বরূপ রাজমিস্ত্রির মর্যাদা আর  চাহিদা দুইটাই বৃদ্ধি পায়। কারন সে সময়য় মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর আবার তারা জেগে উঠবে এবং তাদের ঘরবাড়ি,  চাকর বাকর আসবাব পত্র সবই লাগবে সেই জীবনের জন্য। কবরটাকেও তারা বানাতো সেই রকম ভাবে। এই জন্য টাকা পয়সা খরচ করতে তারা কার্পণ্য করেনি রাজমিস্ত্রির কাজের জন্য। এই শ্রেণীর মর্যাদাও বৃদ্ধি পায় সে সময়য়ে । 

যখনি কোনো রাজা,  তাদের সুবিধা দেখতো না তারা বিদ্রোহ করতো বা স্ট্রাইক করতো। 

যে শ্রেণীতে যারা পড়তোঃ 

মিডিল কিংডমে দেখা যায় সমাজে তিনটি স্তর। আপার ক্লাশে রয়াল ফ্যামিলি, অনেক জমির  মালিক, উচ্চ সরকারী কর্ম চারী, ধর্মীও গুরু এবং ডাক্তার। 

মাঝের শ্রেণীতে পড়ে ব্যাবসায়ি, ম্যানুফ্যাকচারার এবং চিত্রকর বা পাথর কেটে স্ট্যাচু বানানোর কর্মকার। 

লোয়ার ক্লাশে আনস্কিলড লেবার এবং কৃষক। তবে ৮০% মানুষ ছিল এই কৃষক শ্রেণী এবং তাদের দ্বারায় এই সভ্যাতা গড়ে উঠেছিল এবং ফ্লরিস হয়েছিল তিন হাজার বছর ধরে। আর যখন কিনা পৃথিবীর প্রায় সব স্থানে মানুষ গুহায় বা প্রাথমিক অবস্থায়  বাস করতো। 

উল্লেখ যোগ্য ব্যাপারঃ 

তাদের সমাজ ব্যাবস্থায় ধরা বাঁধা কিছু নিয়ম ছিলনা যে নিচের শ্রেণী উপরে উঠতে পারবেনা । লোয়ার বা মিডিল ক্লাস উপরের পজিসানে নিজেদের যোগ্যাতা দিয়ে সহজেই উপরে উঠে যেতে পারতো। উচ্চতর চাকুরী কিংবা বিবাহের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা ভোগ করতে পারতো। 

এমনকি অন্য সভ্যতার তুলনায় তাদের স্লেভের অনেক অধিকার ছিল, বিবাহ করা , সম্পত্তি কিনা  এবং সম্পত্তি ইনহ্যারিট করা এবং  এমনকি তারাকে স্বাধীন করেও দেয়া হতো । 

কি ভাবে তাদের সমাজে শ্রেণীর উৎভব হয়ঃ 

সাহারা মরুভূমির এই এলাকাটিতে ৮০০০ B C তে  মানুষের বসবাস আরম্ভ হয়। নীল নদের ধারে এই জায়গাটিকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘ফায়ুম’ । আর ফারমিং কমুইনিটি বা কৃষক সমাজ এই স্থানে স্থিতি হয় ৫২০০ BC তে। প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ কৃষি কাজ তখনি আরম্ভ করেনি। 

আরকেওলজিরা এখানে একটি পটারি পান যার বয়স ৫৫০০ বছর। 

ডাইনেসটি আরম্ভ হওয়ার পুর্ব অবস্থা ( Pre- dynastic Period) 

ফাইয়ুম এলাকায়  নীল নদের ধারে যে শহর  বা বসতি গড়ে উঠে তাকে Pre - dynastic Period বা মিশরের ফ্যারো ডাইনেশটির আগের সময় বলা হয়। 

সে  সময় মানুষ একেকটা গোত্রে বসবাস করতো।গোত্র অর্থাৎ একই রকম মানুষ নিয়ে একত্রে বসবাস ।  এই গোত্র নিয়ে বসবাসের পেছনের কারন হল বিপদ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া । এই নিরাপত্তা জীবজন্তুর আক্রমণ বা পরিবেশ গত দুর্গতি বা অন্য ট্রাইবের আক্রমণ হতে পারে । একলা থাকার চেয়ে কোনো গোত্রের মধ্যে থাকলে নিজেদেরকে সুরক্ষা দেয়া সহজ হয়। 

Margaret Bunson একজন ইজিপটোলজিসিট তার গবেষণায় উল্লেখ করেন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একেকটি গোত্র একেকটি গড বা দেবতার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। তাদের বিশ্বাস ছিল এই গডেই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে। তার মতে সে সময় মানুষ ভাবতো বিপদ বা অসুখ থেকে রক্ষা করতে তাদের গডের একটা শক্তিশালী প্রভাব আছে।

 

তাদের এই অতি প্রাকৃত  শক্তির বিশ্বাসের তিনটি রূপ আছেঃ 

১) অ্যানি মিজমঃ 

অর্থাৎ গাছপালা, প্রাণী, নির্জিব বস্তু এবং পৃথিবীর আত্মা আছে । 

২) Fetishismঃ 

প্রত্যেক বস্তুর চেতনা এবং অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে। 

৩) টোটেমিজম ঃ 

তাদের বিশ্বাস ছিল প্রত্যেক মানুষ বা গোষ্ঠীর সাথে একটা নিদৃসট প্রাণী বা গাছের সাথে একটা আধ্যাত্মিক সম্পর্ক থাকে।   

তাদের ধর্মের সৃষ্টি এই নানা রকম দেবতার উপরে বিশ্বাস  থেকেই। 

তাদের ধারনা দেবতা দের কাজ হল প্রত্যেক মানুষকে দেখভাল করা ।

অ্যানিমিজমই  হলো মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের প্রাথমিক উপলব্ধি । বুন্সনের মতে ‘ অ্যানিমিজমের মাধ্যমেই  মানবজাতি সর্ব প্রথম প্রাকিতিক শক্তি এবং পৃথিবীতে জীবনের একটা প্যাটার্ন নিয়ে প্রাথমিক ধারনা সৃষ্টি করতে পেরেছিল ।এটা বলতে হবে এই ভাবেই মানব জাতি চিন্তা  করতে সক্ষম হয়েছে বা চিন্তা করতে পেরেছিল যে ‘একটা কিছু আছে যা প্রাকিতিক,  যা আমরা চোখে দেখতে পাইনা কিন্তু তা  আমাদের জীবনকে পরিচালিত করে এবং এটা তাদের বোধগম্যেও  এসেছিল ।  

তারপরেই তারা তাদের চিন্তাকে ‘ফেটিসিজমের’ দিকে নিয়ে যায়। আর তা হলো “ অতি প্রাকিত ক্ষমতা” । তারপর এই ফেটিসিজম,  টোটেমিজমের শাখায় উপনীত হয় । 

আর সেটায় হল সেই ‘ অতি প্রাকৃত আধ্যাত্মিক শক্তি’ যা  প্রত্যেক মানুষ বা গোষ্ঠী কে পর্জবেক্ষন করে। 

বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টির পেছনে এই টোটেমিজম কাজ করে। তাই একেক বিষয়ের জন্য একেক রকম  দেবতা  তারা চিন্তায় আনে এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় । 

এই দেবদেবী প্রত্যেক মানুষ বা গোষ্ঠীকে পর্জবেক্ষণ করে এবং এই মহাবিশ্বে সব সৃষ্টির ভারস্যাম্য রক্ষা করে। এই উপলব্ধিই একটা সভ্যতার সামাজিক কাঠামোর জন্ম দায় ।  এই প্রাচীন মিশরীও   সভ্যতার পেছনেও এই উপলব্ধি কাজ করেছিলো   

পৃথিবীর অন্য সভ্যতা গুলো পর্জবেক্ষন  করলে দেখা যায় সেখানে নিন্ম শ্রেণীর জনগন উপরের শ্রেণীকে আরাম দায়ক জীবন দেয়ার  জন্য ব্যাবস্থা করে চলেছে। 

কিন্তু মিশরীয় সভ্যাতায় দেখা যায় উপরের শ্রেণীর কাজ হলো নিচের শ্রেণীর মানুষদের দেখভাল করা এবং তাদের সেবা প্রদান করা। যা বর্তমান পৃথিবীতে  সভ্য সমাজে দেখা যায়। 

বিভিন্ন দেয়াল চিত্রে দেখা যায় উপরের শ্রেণী নিচের শ্রেণীকে খাবার বিতরন, চাকুরী প্রদান এবং তাদের কাজ দেয়ার কাজ টি করছে।

 তারা রাজাকে ক্ষমতায় বসায় দেবতা মনে করে  যে কিনা বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলো  এবং তার কাজ এবং দায়িত্ব মানুষের বা প্রজার দেখভাল করা এবং আশপাশের শত্রু থেকে নিরাপদে রাখা। তিনি জনগণের কাছ থেকে যা খুশি নিতেন না । ট্যাক্স ধার্য করতেন এবং তা দিয়ে মানুষের কল্যাণ সাধন করতেন। খাবারের জন্য কাজ দরকার এবং মিশরে কাজের অভাব ছিলনা এবং যেকোনো শ্রম কেই সন্মান দেয়া হতো। শ্রমের জন্য ন্যায্য মজুরী ছিল। 

সে সময় মুদ্রার প্রচলন ছিলনা । জিনিসের বদলে জিনিস প্রদান করা হতো। বিয়ার ছিল স্বাস্থ্যকর পানীয় । মজুরী হিসেবে বিয়ার ,পোশাক, রুটি এমনকি সোনা দানাও তাদের কে দেয়া  হতো। 

এতদিন মনে করা হতো স্লেভ দের শ্রম দিয়ে বিশাল বিশাল পিরামিডের পাথর টানা  হয়েছে । এখন প্রমাণ পাওয়া গেছে সাধারণ মানুষ সতস্ফুর্ত হোয়ে নিজের ইচ্ছায়   অফ সিজনে তাদের দেবতার জন্য এই কাজ করতো এবং তাদের দেখাশুনার জন্য ভালো ব্যাবস্থা করা হয়ে  ছিল। ভালো খাবার দেয়া হতো । 

যতো দিন উপরের শ্রেণী নিজেদেরকে প্রজাদের দেখভালের সেবক মনে করতো এবং তাদের শ্রমের মূল্য দিয়েছিল ততো দিন এই সভ্যতা উপরের দিকে উঠেছিল । কিন্তু র‍্যামেসিস II এর  পর থেকেই এই সভ্যতার পতন হতে থাকে। পেছনের অনেক কারনের  মধ্যে একটি কারন  ছিল প্রজাদের দেখভাল না করা, ঠিক মতো মজুরী না দেয়া , তাদের মূল্যায়ন না করা এবং নিজেদের বিলাসিতায় বেশি নজর দেয়া। 

টুম্ব বিলডার অর্থাৎ যারা রাজাদের জন্য সমাধি বানায় তাদের অনেক মর্যাদা দেয়া হতো কারন মৃত্যুর পর পরকাল ছিল মিশরীয়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । একেকটা সমাধি স্থল  একেকটা প্যালেসের মতো। সেখানে কেউ করতো ঘর আর তার ডিজাইন ,কেউ রং এবং প্লাস্টার, কেউ মৃত্যুর পর পুনরায় উত্থানের পাথর কেটে ছবি আঁকার কাজ করতো এবং কেউ তাদের স্ট্যাচু বানিয়ে সেখানে স্থাপন করতো । এই কাজ গুলো ভালো ভাবে করার জন্য তাদের অনেক দেখভাল করা হতো। 

কিন্তু দেখা যায়  ১১৫৯ BC সালে , র‍্যামেসিস III এর এক ফেসটিভ্যালে তাদের মজুরী দিতে অনেক দেরী হয় যার ফলে তারা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে থাকে। 

বুরেক্রেসি এবং  দুর্নিতির  বৃদ্ধি হতে থাকে । ফ্যারো দের প্রতি সন্মান প্রদান কমতে থাকে। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ওয়ার্কার ভিলেজে পাওয়া  লিখিত প্যাপিরাসে । মজুরী ঠিক সময়ে প্রদান না করায় তাদের স্ট্রাইকে যাওয়া এবং ফ্যারো দের সমাধি হওয়ার পর পরেই তাদের রেখে যাওয়া ধনদৌলত চুরি হয়ে যাওয়া প্রমাণ করে তাদের প্রতি তারা লয়াল ছিলনা। 

শীর্ষ স্থানীয়রা নিন্ম শ্রেণীকে অবহেলা করতে থাকে, ফলস্বরূপ তাদের প্রতি মানুষে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। যে ভারসাম্যর মাধম্যে এই সমাজ গড়ে উঠেছিল সেই ভারস্যাম্য নষ্ট হয়ে যায়। নিউ কিংডমের শেষের দিক থেকে এই সভ্যতা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তা ছাড়া অন্যতম কারন ছিল পাশের দেশ গুলোর লোলুপ দৃষ্টি । 

যখন ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে পার্সিয়ানরা মিশর দখল করে । তখন তারা মিশরের যে চিত্র দেখেছিল তা ছিল মিশরের সম্পুর্ন ভাবে ভিন্ন এক চিত্র । এক সময় যে মিশর উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল সে ক্ষমতা তাদের আর ছিলনা। ভাঙ্গন ধরে ছিল সব জায়গায়। যার ফলে মিশর দখল করতে সময় লাগেনি। 

এই ভাবেই মিশর সভ্যতায় ভাঙন আসে আর ক্ষমতা চলে যায়। 

একজন স্কলারের মতে ‘ টুম্ব ওয়ার্কারের স্ট্রাইক’  এর ঘটনা প্রমাণ করে,  তাদের যে  প্রচলিত ধর্মিয় বিশ্বাস ছিল, ক্রমাগত ভাবে সেই সিস্টেমের ভাঙ্গন শুরু  দিয়ে তা শেষ হতে থাকে। এই শ্রেণীই তাদের এই হাইরেকিকে এতদিন ধরে সাপোর্ট করে ছিল বলেই তারা ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। 

র‍্যামেসিস X I, ছিল সব শেষ ফ্যারো যার কবর হয় এই ‘ ভ্যালি অফ দি কিং’  এ । তারপর আর কোনো রাজার কবর এখানে হয় নি। এবং সেখানে স্থাপিত ওয়ার্কার ভিলেজ পরিত্যাক্ত হয়ে যায় ১১১০- ১০৮০ BC এর মধ্যে। 

এই ছিল প্রাচীন মিশরীয় দের  সমাজের চিত্র ।  এবং এই ভাবেই তাদের প্রচলিত  সমাজ ব্যাবস্থায় ক্রমাগত ভাবে পরিবর্তন আসে।  যে ধারনা নিয়ে একদিন এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা আর থাকেনি শেষের দিকে। 

তথ্য সূত্রঃ 

Ancient Egyptian Civilisation ,Khan Academy

Social Classes and Social Structure in ancient Egypt 

World History Encyclopedia

Egyptian Society And Family Life 

Narmer Palette verso Narmar wick 

Photo : Wikipedia 

লেখক ও গবেষকঃ

হুসনুন নাহার নার্গিস,লন্ডন

প্রবন্ধঃ ইতিহাস ও ঐতিহ্য

    

0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ