শুভ পরিণয়!

নিতাই বাবু ৩১ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ০৭:০০:৪১অপরাহ্ন গল্প ১৩ মন্তব্য

মা-বাবার অভাবের সংসারে, রমেশদের সবসময়ই নুন আনতে পান্তা ফুরাত । রমেশ ছিল চারবোন আর দু'ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট । লেখাপড়ার প্রতি অনেক আগ্রহ ছিল রমেশের । কিন্তু অভাবের কারণে তার সেই আগ্রহ ভেস্তে যায় । লেখাপড়া বেশি একটা করতে না পারলেও; কর্মটা শিখেছে মনের মতন । কর্মটা হলো তাঁতশিল্প টেক্সটাইল মিলে । রমেশ ১২/১৩ বছর বয়স থেকেই ছিল কর্মঠ । রমেশ ১৮ বছর বয়স থেকেই টেক্সটাইল মিলের কাজ শিখে । মিলের শিক্ষাগুরু ছিল তার বড়দাদা । প্রথমে তাঁতের কাজ, তারপরে শিখলো একই ডিপার্টমেন্টের ভিন্ন কাজ । রমেশ যেই কাজটা শিখেছিল, তা তাঁতের কাজ থেকে একটু পরিশ্রম কম; সম্মান বেশি । তবে হেল্পার ছাড়া কাজটা করা যায় না । কাজ করতে হলে হেল্পার লাগবেই ।

১৯৮৫ সালের কথা । তখন রমেশ কাজ করে নারায়ণগঞ্জ কিল্লাপুল, ফাইন টেক্সটাইল মিলে । মাকে নিয়ে থাকত মিলের পাশে । তখনকার সময় বাসা ভাড়া ছিল মাত্র ৩০০ টাকা । চারবোনের বিবাহ হয়েছে বহু আগে, বড়দাদা থাকে আলাদাভাবে । মিলে কাজ করার জন্য হেল্পার ছিল একই মহল্লার এক ছেলে । নাম ছিল, 'কানাই' লাল সাহা । কানাইকে রমেশ নিজ হাতে টাক্সটাইল মিলের কাজ শিখিয়েছে । কানাই রমেশের সাথে যখন কাজ করতো, তখন কা-না-ই ছিল রমেশের সঙ্গী । যেখানেই যেত, যাই করতো ওকে ছাড়া রমেশের চলতো না ।

তাই এলাকার মানুষে বলতো, ওরা দুজন জোরা কবুতর । অবিবাহিত জীবনে 'কানাই' আর রমেশ, রাতে একসাথেই ঘুমাতো । রমেশের মা ওকে নিয়ে কোনও সময় রাগ করতো না । রমেশের মা বলতো, "ও-তোর ছোটভাই, ওকে ভালমতো কাজটা শিখিয়ে দিবি ।"
রমেশের মা সময় সময় বলতো, "উমেশ, রমেশ আর কানাই, আমার তিন ছেলে ।"
মায়ের কথা শুনে রমেশ হাসতো; বলতো, মা আমার ঠিকই বলেছে । রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও মানুষ একে অপরের আপনজন হতে পারে । 'কানাই' ছিল রমেশের আপনের চেয়েও আপন । রক্তের সম্পর্কের চেয়েও ছিল অনেক বেশি । সেই স্মৃতিকথা আজও রমেশের মনে পড়ে জীবন চলার প্রতিটি মূহুর্তে । মনে পড়ে রমেশের শুভবিবাহের দিনের কথা ।

কিল্লারপুল 'ফাইন টেক্সটাইল' মিলস্, তাঁত ছিল মাত্র ২০ টি । তখন এই বঙ্গদেশে পলেস্টার সূতার নতুন আগমন । শহরের আনাচেকানাচে টেক্সটাইল মিলের ছড়াছড়ি । ওইসব মিলে দেশি বিদেশি পাওয়ার লোম (তাঁত) এর অভাব ছিল না । বাঙালিদের অনেকেই বলে, "হুজুগে বাঙালি ।"
আসলেও তাই, কেননা, এই বাঙ্গালী একএক সময় একএক রকম হুজুগে পড়ে যায় । তখনকার সময়ে এই পলেস্টার সূতার কাপড়ের ছিল অনেক চাহিদা । সূতা ছিল শক্ত ও মজবুত, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ছিল খুবই প্রিয় । একগজ কাপড় তৈরি করতে খরচ হতো ১০/১২ টাকা । আর সেই কাপড় প্রসেস করে বাজারে বিক্রি হতো ২৫/৩০ টাকা । এইরূপ মুনাফার লোভে পড়ে যায় কিছু বিত্তশালী মানুষে । তারা একজনের দেখাদেখি আরেকজন টেক্সটাইল মিল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । এভাবেই কোনো একসময় দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরেই ছিল টেক্সটাইল মিল ।

এখন যেমন নীট গার্মেন্টস, তখন ছিল কাপড় তৈরির টেক্সটাইল মিল । চাহিদা ছিল তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকদের । রমেশ ছিল নারায়ণগঞ্জ শহরের তাঁতশিল্পের একজন ড্রয়ারম্যান । আর 'কানাই' ছিল তার সাগরেদ । কাজের সুবাদে রমেশের আদরযত্নেরও কমতি ছিল না । রমেশকে মিলের সবাই ওস্তাদ বলেই সম্মোধন করতো । 'কানাই'র মতো এমন অনেক সাগরেদ রমেশের এখনো আছে ।

'ফাইন টেক্সটাইল' মিলে 'কানাই'র মতো একজন সাগরেদ ছিল । ওর বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের কোনো এক গ্রামে । নাম কালাম, রমেশকে ওস্তাদ ওস্তাদ বলে সম্মোধন করে । কোনো ঈদ বা ধর্মীয় উৎসব আসলেই, ওদের বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করে । কিন্তু রমেশের আর ওদের বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠে না । ১৯৮৫ সালের শেষদিকের কথা; সামনে পবিত্র ঈদ । ঈদের ১৫ দিন বাকি থাকতেই কালাম বলে ওদের বাড়িতে যেতে । তা-মানে যে-তে-ই হবে! না গেলে নয় । রমেশ ঠিক করলো, ঈদের বন্ধে কানাই সহ ওদের বাড়িতে যাবে । কালামকে জানিয়ে দিল, ঈদের আগেরদিন কানাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবে ।

কালাম, শুনে খুব খুশি হয়ে ওদের বাড়িতে চিঠি পাঠায় । কালামের মা-বাবা চিঠি পেয়ে কী কী করবে তা আগেই ঠিক করে রাখে । রমেশ ঈদের বন্ধ পেলো ৫ দিন । ঈদের আগেরদিন সকালবেলা মায়ের কাছ বলে রওনা হলো দুইজনে । মাকে বলল, "একজন সাগরেদের নিমন্ত্রণে বিক্রমপুর যাচ্ছি । সাথে যাচ্ছে কানাই, ফিরবো দুইদিন পরে ।" তখন রমেশ বিয়ে করিনি, রমেশের বয়স তখন আনুমানিক ২২/২৩ বছর হবে । দুইজন সমবয়সী, তবে 'কানাই' রমেশ থেকে ৩/৪ বছরের ছোট । এক সমানে চললে কেউ বলতে পারবে না, কে বড় আর কে ছোট । বিক্রমপুর যাবে নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা থেকে লঞ্চে চড়ে । যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মতো ।

লঞ্চ কখন ঘাটে আসবে? লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটে ভিড়তে একটু সময় লাগবে । লঞ্চ আসার খবরটা জেনে, দু'জনে গেল মিষ্টির দোকানে । রমেশ নতুন অতিথি, খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না । তাই ফতুল্লা থেকেই দুই কেজি মিষ্টি কিনে নিল । লঞ্চ থেকে কোথায় নামবো? কী করবো? সেখানে আবার মিষ্টি পেবে কি না? তাই ঝটপট ফতুল্লা থেকেই মিষ্টি আর কিছু ফলফলারি নিয়ে নিল । এমনভাবে যাচ্ছে, কেউ দেখলে মনেমনে ভাববে শশুরবাড়ী যাচ্ছে । লঞ্চ ঘাটে ভিড়ল, যাত্রী নামল, রমেশ আর কানাই ওঠল । লঞ্চ চলছেতো চলছে, কাঠপট্রি, বেতকা, আব্দুল্লাহপুর, তালতলা । এরপর সুবচনী, সে ঘাটেই হবে রমেশের নামার পালা ।

বর্ষা মৌসুম, চারিদিক পানি থৈথৈ করছে । নদীর জোয়ারের পানিতে কোনোকোনো জায়গায় ঘরবাড়িও ডুবে গেছে । মুন্সিগঞ্জ, বিক্রমপুর এমনিতেই নিচু জায়গা । বর্ষা মৌসুমে ওই অঞ্চলের মানুষের নৌকা ছাড়া গতি নাই । এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে হলে চাই নৌকা । চলাফেরা, হাটবাজার সবই নৌকার ওপরে নির্ভর । এদিকে রমেশের আগমনের অপেক্ষায় নৌকা নিয়ে পহর গুনছে কালাম । কখন রমেশ ওস্তাদ ঘাটে পৌছাবো, সেইদিকেই ওর নজর । তালতলা ছেড়ে যখন যাচ্ছিল, লঞ্চ সুবচনীর  ঘাটে ভিড়তেই দেখে কালামকে । কী কাণ্ড! কালাম, মনে হয় সকাল থেকেই ঘাটে রমেশ ওস্তাদের অপেক্ষায় বসে আছে । রমেশ আর কানাই লঞ্চ থেকে নামতেই কালাম, সামনে হাজির ।
বলল, "এতো দেরি কেন ওস্তাদ?"
রমেশ বলল, "বাসা থেকে দেরি করে রওনা দিয়েছি, তাই দেরি হয়েছে । তা তুমি আমাদের জন্য এখানে কখন থেকে শুনি?"
প্রত্যুত্তরে কালাম বলল, "ওস্তাদ, আমি সেই সকাল থেকেই এখানে বসে আছি ।"
কানাই বলল, "এখানে আর কোনো কথা নয়, চল একটা চা'দোকানে যাই ।"
রমেশ কালামকে বলল, "তোমাদের বাজারে ভালো চা'দোকান আছে নাকি?"
কালাম বলল, ওস্তাদ, চা'তো এখম বাংলার কবিরাজি মহৌষধ । এটা কী আর না থাকে? আসেন আমার সাথে ।"
যেতে যেতে রমেশ জিজ্ঞেস করল, তোমার মা-বাবা পান খায় না কি?"
কালাম বলল, "গ্রামের মানুষ আমরা, পান আমাদের সামাজিক প্রথা । পান আমাদের গোষ্ঠীর সবাই খায়, কেবল আমিই খাই না ।"
রমেশ কানাইকে বলল, "একবিড়া পান নিয়ে নে, সাথে জর্দা সুপারিও ।"
কানাই বলল, "আচ্ছা ঠিক আছে, আগে চা পান করে নেই, তারপর নিয়ে নেবো ।"

চা'দোকানে বসা থাকতে থাকতেই কালামের বড়ভাই দোকানে এসে উপস্থিত । কালাম, তার বড়ভাইয়ের সাথে ওস্তাদকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, "আমার বড়ভাই 'ছালাম মিয়া' ।"
রমেশ, ছালাম ভাইয়ের সাথে করমর্দন করল, জানলো পারিবারিক অবস্থা । কানাই কে পাঠিয়ে দিল বাজারের ভেতরে, পানসুপারির জন্য । তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছে । বাজারের কেনাকাটা শেষ করে গিয়ে ওঠল, ওদের নিজেদের কোষা নৌকায় । নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম, সামনে ওর বড়ভাই । নৌকা চলছে হেলেদুলে ।

নদীর মতো সুবচনীর খালটা যখন পাড়ি দিচ্ছিল, রমেশের তখন ভয়ে প্রাণ যায় । রমেশের ভয়টা টের পেয়েছে বন্ধু 'কানাই'। কানাই রমেশকে শক্ত করে ধরে বসলো, তবু রমেশের ভয় যাচ্ছিল না । খাল পাড় হয়ে ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো নৌকা । ভয়টা তখনই সরেছে রমেশের ভেতর থেকে । বর্ষার স্বচ্ছ পানিতে ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে । পানির নিচে কতরকমে উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলেদুলে নাচছে । নৌকা চলছে, কথাও হচ্ছে, কালামের বড়ভাইয়ের সাথে কানাইর সাথে । রমেশ নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে খেলছে । কখনো আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছে । এভাবে নৌকা চলতে চলতে একসময় কালামদের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ল ।

কালাম বলছে, "নামেন ওস্তাদ, এটা আমাদের বাড়ি।"
কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে রমেশ দেখে, এ কী কাণ্ড! এতো মানুষ এখানে কেন? রমেশ কালামকে জিজ্ঞেস করল, "কালাম, বাড়ির ঘাটে এতো মানুষ কেন?"
কালাম বলল, "ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ, আবার আমার ওস্তাদ তাই!"
নিজের কাছে একটু শরম শরম লাগছিল রমেশের । তবু নির্লজ্জের মতোই নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠল রমেশ; সাথে কানাইও । রমেশ আর কানাই, দুইজনের পঢ়নে ছিল একই পোশাক । জিন্সের প্যান্ট আর সাধা জামা, কোমরে কালো বেল্ট ।  রমেশ আর কানাই, সবসময় একসাথেই জামাপ্যান্ট বানাতো । রমেশের পছন্দই কানাইর পছন্দ, তা যেই রঙেরই হোক । নৌকা থেকে ওঠার সময় মিষ্টি, ফলফলারিগুলো কালাম নিয়ে নিল । যাচ্ছে সবাই মিলেমিশে কালামদের বাড়ি । কালামদের ঘরখানা আগে থেকেই পরিপাটি করে রাখা হয়েছিল । ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস চিনিযুক্ত লেবুর সরবত । সাথে কিছু মিষ্টি ও পানসুপারি । রমেশ আর কানাই সবই খেল, খায়নি শুধু পানসুপারি । তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যারানী উঁকি মারার সময় । কালামদের ঘর থেকে বাইর হয়ে আসলো, রমেশ আর কানাই ।

কালামরা যেই গ্রামে বসবাস করে, সেই গ্রামটির নাম নয়াবাড়ি । গ্রামটি সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো দেখতে । আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয় । পুরো গ্রামটির মাঝখানে একটা পুকুর । পুকুরটি দেখতে একটা দিঘির মতো । পুকুরটি ছিল এক হিন্দু গোসাইর, তার নাম ছিল সত্যগুরু । সত্যগুরুর পরিবারবর্গ তখন এই গ্রামে নেই । তারা সংঘটিত হিন্দু মুসলিম রায়টের সময়ই ভারতে চলে যায় । ফেলে রেখে যায়, তাদের বিশাল বাড়ি ও স্ব-সম্পত্তি । পড়ে থাকা সত্যগুরুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকে, এক হিন্দু পরিবার । বিরাটকার পুকুরটিতে একটিমাত্র পাকা ঘাটলা । ঘাটলাটিও অনেক বড়, দেখতেও খুব সুন্দর । দুপাশে মানুষ বসার জন্য চেয়ারের মতো করে বানানো আছে ।

প্রতিদিন এই ঘাটলাটিতে বসে নয়াবাড়ি গ্রামের ছোটবড়দের আড্ডা । কালামদের বাড়ি থেকে বাইর হয়ে, কানাই আর রমেশ গেল সেই পুকুর ঘাটে । তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের মানুষের আড্ডা, তাস খেলা । রমেশ আর কানাইকে দেখেই সবাই ওঠে দাঁড়াল । যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের রমেশ হাতজোড় করে নমস্কার জানাল । উপস্থিত সবাই তখন খুব খুশি হয়ে কালামের বড়ভাইকে জিজ্ঞেস করল, "ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?"
আরও অনেক কিছুই জানতে চাইল, কালামের বড়ভাইয়ের কাছ থেকে । কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, "এরা একজন আমার ছোটভাইয়ের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু । কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ । তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে, আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে ।"
কালামের বড়ভাইয়ের কথা শুনে সবাই করমর্দন করলেন । সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে দিলেন, রমেশ ও কানাই বসলো ।

রমেশ ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছে । কারণ; বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর তাই । আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর । সাথে পাকা সিঁড়ি ঘাটলা সহ ঠাকুরঘর । রমেশ ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো । ওদের দেখে রমেশের ধারণা হয়েছিল ওরা দুই বোন । ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বলল, "কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই কালামের কাছ থেকে একটু জেনে নে ।"
কালাম তখন সিঁড়ি ঘাটলায় নেই, ও-গেছে বাজারে । রমেশের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া ।

কানাই, সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে । জিজ্ঞেস করল, "দাদা, একটু আগে যেই মেয়ে দুইটি ঘাটে আসলো, ওরা কারা?"
এটুকু বলার সাথেই সালাম ভাই বলল, "ওহ! ওরা? ওরা এই বাড়িতেই থাকে । ওরা চার বোন, দুই ভাই । এক বোনের বিয়ে হয়েছে, বাকি আছে আরও তিন বোন । কেন জিজ্ঞেস করলেন দাদা? পাত্র আছে নাকি? পাত্র থাকলে বলবেন, ওরা খুব ভালো মেয়ে । তবে দাদা গরিব, বিয়ে সাদির ব্যাপারে কিছুই দিতে পারবে না । কেউ যদি দয়া করে আসে, আমরা পাড়াপড়শি ওদের সাহায্য করব ।"

সালাম ভাই কথাগুলো বললেন, কানাই শুনলেন । সালাম ভাই কানাইকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, "কালামের ওস্তাদ কি বিয়ে করেছে? যদি না করে থাকে, তবে আমরাই ওস্তাদকে বিয়ে করাবো ।"
কানাই, সালাম ভাইয়ের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রমেশের কাছে এলো । রমেশ কানাইকে জিজ্ঞেস করল, "কি-রে কানাই, সালাম ভাই কী বলল?"
রমেশের কথার উত্তরে কানাই বলল, " সালাম দাদা বলল, তোকে এই গ্রামের বিয়ে করাবে, বুজলি ।"
রমেশ বলল, "বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল, যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি!"
কানাই রমেশের কথার জবাবে বলল, "কেন রে, মেয়ে তো কয়েকবার দেখেছিস । এবার বল, পছন্দ হয়েছে কি না?"
রমেশ কানাইর কথায় অবাক হয়নি, কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছে । কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারল না, লোকে যদি মন্দ বলে তাই । রমেশ ভাবছিল একা একা,আর আশায় থাকল, আবার দেখার জন্য । এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল । কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছিল, ব্যস্ত শুধু ওস্তাদ আর কানাইর খাবারের জন্য । "সে কখন ওস্তাদ এসেছে, বিকাল শেষ হয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল । অথচ এখনো ওস্তাদকে খাবার দিতে পারছি না ।" এটা ছিল কালামের মনের কথা । কালাম বাজার থেকে এসেই মায়ের সাথে এ ব্যাপারে রাগারাগিও করেছে । বোনদের সাথে রাগারাগি করে শেষতক এসেছে সিঁড়ি ঘাটলায় ।

ঘাটলায় এসেই কালাম রমেশের হাত ধরে বলল, "ওস্তাদ, এখানে আর দেরি নয়, বাড়ি চলেন, খাবেন।"
রমেশ কালামকে বলল, "হ্যাঁ যাবো ।"
আবার জিজ্ঞেস করল, "তোমাকে এত ব্যস্ত দেখাচ্ছে কেন? তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?"
কালাম বলল, "ওস্তাদ, আজ সুবচনী সাপ্তাহিক বাজার, গিয়েছি বাজারে । বাড়ি এসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমার ওস্তাদ খেয়েছে কিনা ।?" মা বললেন, "তোর ওস্তাদ ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িঘাটে গিয়ে বসে আছে, সেই কখন থেকে । না আসলে কি খাবার দিতে পারি?" মায়ের কথায় আমার ভীষণ রাগ হয়েছে ওস্তাদ । বাড়িতে কী একটা মানুষও ছিল না, ওস্তাদকে ডেকে আনার জন্য? এখন চলেন বাড়িতে ।"

কালামের সাথে রমেশ আর কানাই চলে এলো খাবার খেতে । খাবার খেতে বসলো, অনেক রকম খাবার । কানাই কালামকেও টেনে বসাল, কালামও বসলো । গ্রামের বাহারি রকমের খাবার, সাথে গরুর খাঁটি দুধও আছে । একটু তাড়াতাড়ি করেই খেলো, উদ্দেশ্য সিঁড়িঘাটে আসার জন্য । ভাত খেতে বসেই ঠাকুরবাড়ির গল্প শোনালেন কালামের মা, ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য আর সত্যগুরুর ক্ষমতা নিয়ে ।
"সত্যগুরু জীবিত থাকতে ওই বাড়িতে কোনো চোর চুরি করতে পারে নাই । চুরি করতে গেলেই সারারাত আটকা পড়ে থাকতে হতো । সকালবেলা সত্যগুরু ঘুম থেকে ওঠে চোরকে শাসিয়ে ছাড়ত । আর পুকুরে ছিল এক অলৌকিক কাণ্ড! কারোর বিয়ে সাদি হলে পুকুরপাড়ে আসে থালাবাসনের কথা বললেই হতো । পরদিন ভোরবেলায় সিঁড়িঘাটে থালাবাসন ওঠে থাকত । বিয়ে বা অন্যকোন ধর্মীয় কাজ ছিল মুখ্য বিষয় । কাজ শেষে থালাবাসনগুলো ভালো করে ধুইয়ে আবার পানিতে ছড়ে দিতো । একদিন ঘটলো এক অন্যরকম ঘটনা । বিয়ের কাজ শেষে পুকুরের থালাবাসন থেকে একটা থালা রেখে দেয় । একটি বাদে বাদবাকি থালাবাসন যখন পুকুরে দিচ্ছিল, তখন থালাবাসনগুলো পানিতে ডুবছিলো না । তিনদিন যাবত থালাবাসনগুলো ওইভাবেই ছিল । তিনদিন পর থালাবাসনগুলো পানিতে ডুবেছে ঠিক, কিন্তু আর কখনো কেউ চেয়ে পায়নি ।" বলছিলেন কালামের মা ।

গল্প শুনতে শুনতে বেজে গেল রাত আটটা । তখনো রমেশের মনটা ছটফট করছে ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িঘাটে আসার জন্য । কালামকে বলল, "চল ঘাটে যাই ।"
কালাম বলল, "হ্যাঁ ওস্তাদ, চলেন ।"
এই বলে কালাম হাতে একটা হারিকেন নিয়ে নিল,অন্ধকারে পথ দেখার জন্য । কালামদের বাড়ি থেকে সিঁড়ি ঘাটলা অল্প একটু দূরে । রাত্রিতে ওদের চলতে আলোর প্রয়োজন হয় না, সমস্যা শুধু রমেশ আর কানাইর । হারিকেন নিয়ে কালাম আগে, দুইজন কালামের পিছনে । আসলো ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িঘাটে, বসলো তিনজনে । তখনো সেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা । বর্ষার দিন, চারিদিকে পানি আর পানি, লোকে যাবে কোথায়? তাই গ্রামের অনেকেই ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িঘাটকে বেছে নিয়েছে সময় কাটানোর জন্য । অনেক মানুষের মধ্যে ঠাকুরবাড়িতে থাকা মুরুব্বিও আছে । মুরুব্বির সাথে আছে ওনার অবিবাহিত তিন মেয়ে ।

যারা সিঁড়িঘাটে আছে, তারা মনে হয় আগে থেকেই রমেশ আর কানাইর কথাই বলছিল । রমেশ আর কানাই যাওয়ার সাথেই একজন বলে ওঠল, "ঐযে এসে গেছে ।"
কালামকে ঠাকুরবাড়ির লোকটি জিজ্ঞেস করলো, "কিরে কালাম, তোর ওস্তাদ নাকি হিন্দু? বিয়ে সাদি করেছে নাকি রে? তোর ওস্তাদ জাতে কী? খাওয়াদাওয়া করেছে নাকি?"
আরও অনেক কথাই জিজ্ঞেস করেছিলেন হিন্দু মুরুব্বি । মুরুব্বি নাম নারায়ণ সরকার, তাই গ্রামের সবাই তাকে সরকার বলেই সম্মোধন করে । মুরুব্বির কথা শুনে কালাম রমেশকে জিজ্ঞেস করল, "ওস্তাদ, আপনারা জাতে কী?"
রমেশ বলল, "পাল ।"
কালাম ঠাকুরবাড়ির মুরুব্বিকে বলল, "শুনেছেন সরকার কাকা, আমার ওস্তাদরা জাতে পাল ।"
এবার কালাম ঠাকুরবাড়িতে থাকা মুরুব্বিকে বলল, "সরকার কাকা, আপনার জাতে কী?"
মুরুব্বি কালামকে বলল, "এতদিন একসাথে থাকি, অথচ আমার টাটেল জান না? আমি হলাম (কাপালিক) টাইটেল সরকার ।"
কালাম বলল, "দূর! এতো কি আর আমি জানি? আপনি হিন্দু, আমি মুসলমান । আপনার জাত বেজাত সমন্ধে আমার কোনো ধারণা নাই । তবে এখন বুঝলাম, আমরা আপনাকে সরকার কেন বলি।"
এই বলেই কালাম হাতের হারিকেনটা মেয়ে তিনটার সামনে নিয়ে বলল, "ওস্তাদ এই যে, এই বাড়িতেই থাকে । ওনার মেয়ে চারজনের মধ্যে তিনজন ।"
কানাই বলে ওঠল, "আরেকজন কোথায়?"
কালাম বলল, "কানাই ভাই, ওদের বড়বোনের বিয়ে হয়েছে । ও-এখন স্বামীর বাড়িতে, এখানে মাঝেমধ্যে আসে । এই তিনজনের মধ্যে বড়টার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, বিয়ে হবে সামনের মাসে ।"
কালামের হাতে হারিকেনটার বেশি আলো ছিল না, তাই রমেশের ভালো করে দেখা হয়নি । তবু অবিবাহিত দুইজনের মধ্যে ছোট মেয়েকে রমেশের পছন্দ হয়েছে । কিন্তু তা কী করে সম্ভব? রমেশের মা-তো রাজি হবেই । কিন্তু বড়ভাই, বোন, ভগ্নিপতিকে ম্যানেজ করবে কে? রমেশ ভাবছে মনে মনে ।

আবার ভাবছে, দূর ছাই! এখনো ওর বড়বোনের বিয়ে হয়নি । বড়টাকে রেখে কী ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবে? এখন রমেশের মনে কেবল ভাবনা আর ভাবনা । রমেশের ভাবনার মধ্যেই একসময় কানাইকে কাছে ডাকে নারায়ণ সরকার । হয়ত রমেশের ব্যাপারেই কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য । কানাইও একেবারে মঘা নারায়ণ নয়, কানাই খুবই চালাকচতুর টাইপের মানুষ । আর যদিও রমেশের কথা কানাইকে কিছু জিজ্ঞেস করে, উত্তর পাবে সঠিক । আর রমেশের মা এবং কানাইও চাইছে, রমেশ বিয়ে করে সাংসারিক হোক । রমেশের মা বৃদ্ধ, ঘরের সব কাজ করতে পারে না । তাই রমেশকে বিয়ে করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে । বিক্রমপুর আসার সময়ও রমেশের মা কানাইকে বলেছে, একটা মেয়ে দেখে আসবি । রমেশের মায়ের ইচ্ছার কথাটা কানাই বলেছে, বিক্রমপুর যাবার সময় । তখন দুইজনে লঞ্চে বসে বাদাম খাচ্ছিল ।

নারায়ণ সরকারের সাথে কথা বলে কানাই রমেশের সামনে এসে বসলো । রমেশ কানাকে জিজ্ঞেস করল, "হ্যাঁ রে, কোথায় গিয়েছিলি?"
কানাই বলল, "ঠাকুরবাড়ির ভেতরে ।"
রমেশ জিজ্ঞেস করল, "কেন? কী দরকার ছিল?"
কানাই বলল, "আ-রে ভাই, কালাম ভাই আমাকে ডেকে নিয়েছে, তাই গেলাম ।"
রমেশ ওকে জিজ্ঞেস করল, "তা কী জিজ্ঞেস করলো?"
কানাই রমেশকে সরাসরি বলল, "তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে । তোরা জাতে কী? তোর কত টাকা বেতন? নিজেদের বাড়ি আছে কিনা? ক'ভাই, ক'বোন? বাবা আছে কিনা? বাসা ভাড়া কত? আরও অনেক কথা ।"
রমেশ জিজ্ঞেস করল, "তো-হ্যাঁ, তুই কি বললি?"
কানাই বলল, "তোর যাযা আছে, তাই ঠিকঠিক বলে দিয়েছি ।"
রমেশ বলল, "আচ্ছা আমি বুঝতে পারছি না, আমার ব্যাপারে এত গবেষণা কেন? আমি কী এই বাড়িতে মেয়ে দেখতে আসেছি?"
রমেশের কথা শুনে কানাই বলল, "মেয়ে দুটেই বেশ সুন্দর, মাসিমার পছন্দ হবে । এখন তোর সিদ্ধান্তের উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে ।"
রমেশ কানাইর কথা শুনে বলল, "আরে রাখ তোর সুন্দর! এই সেন্টমার্টিনের দ্বীপে বিয়ে করবে কে? তুই কানাই একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেল । মাসিমাকে আমি ম্যানেজ করবো ।"
রমেশের কথা শুনে কানাই বলে ওঠল, "দেখতো পাগলের কথা! আরে ভাই মাসিমার শরীরের অবস্থা বেশি ভালো নেই । কখন যে-কী-হয়ে যায়, কে জানে! মাসিমার খুব শখ তোর বউ দেখার জন্য ।"

কানাইর কথা শুনে রমেশ কেবল ভাবছে সেই মেয়েটির কথা । গেল ছয়মাস আগে একটা মেয়ে রমেশের জন্য পাগল হয়ে ওঠে । মেয়েটাকে রমেশের পছন্দ থাকা স্বত্বেও বিয়ে করেনি । করেনি শুধু আর্থিক দুরাবস্থার জন্য । তখন মিলে বেতন ছিল কম, বাজারে দ্রব্যমূল্য ছিল অনেক বেশি । তাই আর বিয়ে করতে সাহস পায়নি । শেষতক রমেশ মেয়েটাকে উঠিয়ে দিলো পরের হাতে । রমেশের মা'ও একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত ছিল যে, রমেশ মেয়েটা বিয়ে করবে । কিন্তু না, তা আর হলো না, হয়েছে উল্টো । বরঞ্চ রমেশ নিজের ঘরে না নিয়ে, পাঠিয়েছে অন্যের ঘরে । আজ হঠাৎ এই বিক্রমপুর এসে ওকে ভীষণভাবে মনে পরছে রমেশের ।

রমেশের চোখে যেন দেখছে, সেই মেয়েটিকে । যেই মেয়েটি এখনো কাঁদে, চোখের জলে বুখ ভাসায় । রমেশ একবার ওয়াদা করতে চেয়েছিল, এই দারিদ্র্য জীবনে আর বিয়েই করবে না । 'দেবদাস' হয়ে জীবন পার করবে । কিন্তু রমেশের মায়ের কথা ভেবে আর এই কঠিন ওয়াদাটি করতে পারেনি । রমেশ ছাড়া মায়ের আর তেমন কেহ নাই যে, মাকে দেখবে । রমেশের বউ দেখবে এটা যেন মায়ের অন্তরে জমানো আশা । মায়ের সেই আশা, সেই শখ থেকে মাকে কীভাবে বঞ্চিত করে? তা কি সম্ভব? রমেশের কাছে এই মেয়েটিও পছন্দের । কপালে যদি লেখা থাকে তবে এবার বিয়ে হবেই হবে । প্রথম ভালো লাগা মেয়েটাকে নিয়ে রমেশ ভাবছিল একা একা ।

এমন ভাবতে ভাবতে একসময় সিঁড়ি ঘাটলায় বেজে গেল রাত ১০ টা । কানাই একপাশে আর কালাম আরেক পাশে বসা । কালাম বলছে, "ওস্তাদ, এবার ওঠেন, রাত অনেক হয়েছে! ভাত খাবেন চলুন ।"
কানাইও বলে ওঠল, "হে রে! এবার চল, বড্ড ঘুমে পাচ্ছে ।"
সিঁড়িঘাট থেকে ওঠার সময়ও এদিকওদিক থাকাচ্ছিল, মেয়েটাকে দেখা যায় কিনা । না দেখা আর হলো না, আক্ষেপ নিয়েই চলে গেল কালামদের বাড়ি । খাবারের ভাত তরকারি রেডি করে বসে আছে কালামের মা । সবাই তখন ঘুমে বেভার, যেন রাতদুপুর হয়ে গেছে । গ্রামাঞ্চল, সন্ধ্যে হতেই তাদের চোখে ঘুম নেমে আসে । সেখানে রাত ১০ টা তো অনেক রাত । কালামের মা কালামকে বলছে, "কি রে, আজ কি তোরা ঘুমাবি না? রাত তো অনেক হয়েছে! নে_তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নে, আর মেহমানদের নিয়ে এই খাটেই ঘুমিয়ে থাকিস । আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি গেলাম ।"
কালামের মা চলে গেলেন, কালাম সহ তিনজনে মিলেমিশে ভাত খাচ্ছে । খাওয়ার মাঝেই শুরু হলো রমেশকে নিয়ে গপ্প ।

কানাই কালামকে বলল, "কালাম, আমি ওকে বললাম ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়েটাকে বিয়ে করতে । মেয়েটা খুব সুন্দর! টানাটানা চোখ, গায়ের রঙও ফর্সা আর বয়সও কম । ওর সাথে মানাবে বেশ! আপনি কী বলেন, কালাম ভাই?"
কালাম কানাইর কথা শুনে হাসি দিয়ে বলল, "হ্যাঁ, আমিও মনে মনে তাই ভাবছি কানাই ভাই! এখন ওস্তাদের ওপর সিদ্ধান্ত, ওস্তাদ যা ভালো মনে করে তা হবে । তবে মেয়ে শতগুণে ভালো, আমাদের গ্রামের মেয়ে । সবেমাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ছে, গরিব মানুষ ওরা, এর বেশি লেখাপড়ার দরকার কী? আপনারা আসার আগে ওর বাবা আমাকে একবার বলেছিল, একটা ছেলে দেখতে । কিন্তু ছেলে কী গাছের গোটা? যে, চাইলেই পাওয়া যায়? এখন আপনারা এসেছেন আমাদের বাড়িতে, ওদেরও দেখেছেন, যদি ভালো লাগে...।"
কালামের কথা শুনে রমেশ বলল, "মেয়ে পক্ষের গার্ডিয়ান কী রাজি হবে? যদি রাজি হয় তো পরে দেখা যাবে । তুমি কালাম এই রেজাল্টটা নিয়ে আমাকে জানাবে ।"
কালাম খুশি হয়ে বলল, "আচ্ছা ওস্তাদ, আমি অবশ্যই আপনাকে জানাবো । এখন ঘুমান, রাত অনেক হয়েছে ।"
রমেশ আবার কালামকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল, "আর শোন, কাল সকালে ঘুম থেকে ওঠেই আমরা চলে যাবো । আমাদের জন্য খালাম্মা যেন কিছু না করে, বুঝলে?"
কালাম হেসে বলল, "তাকি হয়! আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবেন, অথচ কিছু খেয়ে যাবেন না, তা হয় না ।"
রমেশ প্রত্যুত্তরে বলল, "আচ্ছা তা দেখা যাবে সকালে । এখন আর কোনো কথা নয় ।"

বেশি রাত করে ঘুমানোর কারণে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা হলো না । বেজে গেল সকাল ৮টা, খাবারও রেডি করতে লেগেছে খালাম্মায় । খালাম্মার সামনে বসা আছে মেয়েটি, যেই মেয়েটির কথা বলছে কানাই । কিন্তু এতো সকালে এখানে কেন? কেন-ই-বা এসেছে? এখানে ওকে কে পাঠালো? মেয়েটিকে দেখামাত্র রমেশ চমকিত, বিষ্মিত । কানাই রমেশকে চিমটি দিয়ে মেয়েটিকে দেখাচ্ছে, কিন্তু রমেশতো আগেই দেখেছে ওকে! শোবার ঘরের সাথেই রান্নাঘর, খালাম্মা রমেশকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলছে মেয়েটাকে । একটু দূর হওয়ার কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । কিন্তু রমেশকে যে দেখাচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে । রমেশ উৎসাহিত হয়ে খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করল, "খালাম্মা, কী করছেন? আমরা এক্ষুণি রওনা দিবো ।"
খালাম্মা বলল, "সে কী! আজই চলে যাবে? না না বাবা সকল, তা হয় না । অন্তত আজকের দিনটা তোমাদের থাকতেই হবে, তা যে করেই হোক ।"
রমেশের বলার আগেই কানাই বলে ওঠল, "না-খালাম্মা-না, আজ আমরা থাকতে পারছি না । আবার আরেক ঈদে আপনাদের বাড়ি বেড়াতে আসবো । আজ আমাদের যেতেই হবে ।"
রমেশ খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করল, "খালাম্মা, কালাম কোথায়? ওকে দেখছি না যে?"
খালাম্ম বললেন, "ও-তো বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠে কোথায় যেন গেছে । হয়ত এখনই চলে আসবে । তোমরা বাবা, হাত মুখ ধুয়ে আস, খাবার তৈরি হয়ে গেছে ।"

মেয়েটি তখনো খালাম্মার সাথে বসা । রমেশ কথা বলছিল, আর মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে এদিকওদিক চাচ্ছিল । রমেশের মনে ইচ্ছা জাগল মেয়েটির সাথে একটু কথা বলতে । তাই ভেবে খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করল, "খালাম্মা, আপনার সাথে বসা মেয়েটি কে? কালামের কী হয়?"
জবাবে খালাম্মা বললেন, "ও-তো বাবা তোমাদের স্বজাতি । ঠাকুরবাড়ির সারকারের মেয়ে, নাম 'বনিতা' সরকার ।"
কানাই জিজ্ঞেস করলো, "ওরা ভাইবোন কতজন?"
খালাম্মা মেয়েটিকে রমেশের সামনে যেতে বললেন, মেয়েটি ধীরগতিতে রমেশের সামনে এসে দাঁড়াল । গতরাতে হারিকেনের আলোতে ভালো করে দেখা হয়নি । তাই দেখার ইচ্ছাটা আজ পূরণ হয়েছে মনে হয় । যতই দেখছে, ততই যেন আপন হয়ে যাচ্ছে । চুম্বক যেমন একটুকরা লোহাকে কাছে টানে, তেমনি রমেশকে যেন কাছে টানছে । সুযোগ পেয়ে কানাই বলল, "আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যে? এখানে এসে বসুন ।"
বনিতা বললেন, "না থাক, বসবো না । আমার এখনই যেতে হবে, মা রাগ করবে ।"
কানাই রমেশকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, "আমার ওস্তাদ, কালাম ভাইয়েত ওস্তাদ । আমরা থাকি নারায়ণগঞ্জ । খালাম্মাকে সাথে নিয়ে একদিন আমাদের ওখানে যাবেন, খুশি হবো ।"

এমন সময় কালামের মা (খালাম্মা) সামনে এসে বললেন, "একদিনের জন্য কেন? চিরদিনের জন্যই নিয়ে যাও । দেখেশুনে বিয়ে দিয়ে দাও, ওর বাবা খুবই গরিব মানুষ । ওরা অবিবাহিত দু'বোনও খুব ভালো । পাত্র থাকলে একটু দেখো ।"

খালাম্মার কথা শুনে মেয়াটি মুচকি মুচকি হাসছে । এই ফাঁকে কানাই চট করে বলে ফেলল, "খালাম্মা, আমার ওস্তাদই তো এখনো বিয়ে করেনি । দেখি মাসিমাকে বলে ওস্তাদের ঘরে নেওয়া যায় কি-না ।"
কানাইর কথা শুনে মেয়েটি আর এক সেকেন্ডও দেরি করল না, সোজা দৌঁড় । কথায় আছে, "লজা নারীর ভূষণ ।" হয়ত লজ্জা পেয়েছে মেয়েটি । মেয়েটি চলে যাবার পর কালামের মা (খালাম্মা) বলল, "খুব ভালো মেয়ে বাবা, যার ঘরে যাবে, তার ঘর উজ্জ্বল করে তুলবে ।"
খালাম্মার কথা শুনে কানাই বলল, "খালাম্মা, সরকার বাবু বড় মেয়ে রেখে কি ছোট মেয়ে দিবে?"
খালাম্মা বলল, "গরিবের মেয়ে, দিতে পারলেই বাঁচে! না দিয়ে যাবে কই?"
খালাম্মার কথা শেষ হতে হতেই কালাম বাড়ি আসলো । বাড়ি এসেই মাকে জিজ্ঞেস করল, "মা, আমার ওস্তাদ আর কানাইদাকে নাস্তা দিয়েছ?"
ছেলের কথার উত্তরে খালাম্মা বলল, "না-রে, ওরা তো এখনো হাত মুখই ধোয়নি, নাস্তা দিবো কী করে?"
কালাম মায়ের কথা শুনে ওস্তাদের কাছে এসে বলল, "কী ব্যাপার ওস্তাদ, পেটের ক্ষুধা কী নাই হয়ে গেল? তাড়াতাড়ি আসেন । হাত মুখ ধুয়ে সবাই নাস্তা করি ।"

কালামের কথামত তাই হলো, হাত মুখ ধুয়ে সবায় নাস্তা খেলো । এবার রমেশ আর কানাই চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল । কালাম বিষয়টি টের পেয়ে ওস্তাদের কাছে এসে বলল, "ওস্তাদ, আজকের দিনটা থেকে গেলে হয় না? আজ থেকে যান, কাল সকালে যাবেন ।"
রমেশের আগেই কানাই বলে ওঠল, "কিছুতেই না, আজ আমাদের যাতেই হবে । কালাম ভাই, রাগ করবেন না, সময় নিয়ে আবার একদিন আসবো । আজকে আমাদের বাধা দিবেন না ।"
কানাইর কথা শুনে কালাম শুধু বলল, ঠিক আছে ভাই, তাহলে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরেই যান?"
রমেশ কোনো কথাই বলছে না, মনটা খারাপ করে জামাপ্যান্ট পঢ়ে নিচ্ছে । বাড়ি ভর্তি মানুষ, সবাই কী যেন হাঁকাহাঁকি করছে । কেউ আবার বলছে, "কাল বিকালে এসে সকালে চলে যাওয়া, এটা কী একটা বেড়ানি হলো?"
হঠাৎ করে রমেশদের চলে যাওয়ার খবরটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল । ঠাকুরবাড়ি থেকে ওরা আসল কালামদের বাড়ি । ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়েটা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে । রমেশ শুধু মেয়েটাকেই দেখছে আর ভাবছে । ছুটিতো আরও দুইদিন হাতে আছে, আজকের দিনটা থেকে গেলেই-তো পাড়তাম । রমেশের থাকার ইচ্ছা ছিল ঠিক, কিন্তু কানাইর জন্য কিছু বলছে না । খবর পেয়ে একে একে গ্রামের সবাই কালামদের বাড়ি এলো; এলো সালাম ভাইও । সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো রমেশ ও কানাই । কালামদের বাড়ি থেকে বাইর হয়ে এলো ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িঘাটে । আগের দিন রাতে সিঁড়িঘাটে যারা যারা ছিল, তাঁরা আজও এখানে আছে । উপস্থিত থাকা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে । রমেশের উদ্দেশ্য হলো পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখা ।

ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যেতেই বাড়ির ছোট মেয়েটা বলল, "আসেন আসেন, বসেন ।"
এই বলেই দুইটা চেয়ার এনে দিল রমেশ আর কানাইর সামনে । কানাই চেয়ারে বসলো ঠিক, কিন্তু রমেশ বসেনি । রমাশ ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখলো । ততক্ষণ মেয়েটা কানাইর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে । হয়ত রমেশের কথা কিছু জিজ্ঞেস করেছে কানাইকে । রমেশ পুরো বাড়িটা দেখার পর পায়ের জুতা খুলে ঠাকুরঘরে প্রবেশ করল । ঠাকুরঘরটাও অনেক বড়, দেখতেও সুন্দর । ঠাকুরঘরে প্রণাম করে বাইর হয়েই, কানাইকে বলল, "চল এবার রওনা দেই । কালাম কোথায়?" সাথে সাথে কালাম সামনে এসে বলল, "হ্যাঁ ওস্তাদ, এইযে আমি! চলেন নৌকা রেডি আছে ।"
রমেশ আর কানাই নৌকায় উঠলো । খালের পাড়ে তখন অনেক লোকের সমাগম । মনে হয় গ্রামের কে যান বিদেশ যাচ্ছে । নৌকা ছড়ে দিল কালাম, নোকার সামনে কালামের বড়ভাই । কিছুক্ষণ চলার পর আসলো সুবচনী লঞ্চঘাটে । নৌকা থেকে সবাই নেমে লঞ্চের অপেক্ষা, লঞ্চ কখন আসবে? অল্পক্ষণের মধ্যেই লঞ্চ ঘাটে ভিড়ল । রমেশ আর কানাই লঞ্চে উঠলো, লঞ্চ না-ছাড়া পর্যন্ত কালাম ও সালাম দাঁড়িয়েই থাকে । বাসায় এসে কানাই মাসিমাকে সব খুলে বলল, মাসিমা রাজি হয়ে গেল । এর তিন চারমাস পর কানাইকে নিয়ে বড়ভাই উমেশ, বিক্রমপুর যায় । মেয়ে দেখে রমেশের বড়ভাই বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে ফেলে । কোনো যৌতূক ছাড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে বনিতার সাথে হয়ে যায়, শুভ পরিণয় ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ