“সুনামগঞ্জ জেলায় চলতি জুলাই মাসের প্রথম ২২ দিনে পানিতে ডুবে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদের সবার বয়স আট বছরের নিচে। তবে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। সুনামগঞ্জেও তা-ই। কিন্তু গত ২২ দিনে এই জেলায় নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর তেমন তথ্য নেই”। (সূত্রঃ প্রথম আলো’ ২৫ জুলাই’২১)। পাশাপাশি “চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও রাউজানে পানিতে ডুবে ৬ জনের মৃত্যু”। (সূত্রঃ দৈনিক আজাদী ২৫ জুলাই’২১)। জানা যায়, গত ২১ জুলাই’২১ ঈদের দিন ভূজপুর থানার সুয়াবিলে পুকুরে ডুবে মুহাম্মদ এবং আহাম্মদ নামের তিন বছর বয়সী দুই জমজ ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। গত ২২ জুলাই’২১ সকাল সাড়ে ১১টায় ফটিকছড়ির হালদা খালের রাবার ড্যামে গোসল করতে গিয়ে ২৫ বছর বয়সী এক কলেজ ছাত্রের করুন মৃত্যু হয়েছে। ওমরগণি এম ই এস কলেজের এ ছাত্র বন্ধুদের সাথে রাবার ড্যামে ঘুরতে গিয়ে অসাবধানতায় পা পিছলে নদীতে ডুবে যায়। এবং ২২ জুলাই’২১ সকাল ১১ টায় দাঁতমারা এলাকায় পানিতে ডুবে প্রতিজ্ঞা নামের দেড় বছরের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। পাশাপাশি রাউজান উপজেলার রাউজান সদর ইউনিয়নে পুকুরে গোসল করতে গিয়ে ৭ বছর বয়সের সাকিবা এবং ৬ বয়সের আনিসা দুই চাচাতো-জেঠাতো বোনের করুন মৃত্যু হয়। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু মারা যায়। এদের বয়স ১ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। “শিশু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (বিএমডিসি) অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডায়রিয়ায় মৃত্যু রোধে এবং এর ব্যবস্থাপনায় আমরা বিশ্বে এক নম্বর। গণটিকা দেওয়ার কারণে ডিফথেরিয়া বলতে গেলে নেই। ধনুষ্টঙ্কার একদম নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারছি না আমরা। এ নিয়ে দেড় যুগ ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুদৃষ্টির অভাব আছে”। (সূত্রঃ প্র / আলো, ২৫ জুলাই’২১)।

এদিকে গত ২৫ এপ্রিল’২১ রোববার পালিত হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দিবস। এবারই প্রথম এই দিবস পালিত হচ্ছে। চলতি বছরের গত ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২৫ জুলাই এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা যায়।  আরও জানা যায়, জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। গবেষকদের মতে রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে আমাদের দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, “পানিতে ডুবে বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে এশিয়াতেই, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। সেখানে আবার পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বলে জানাচ্ছে এক জরিপ। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে গড়ে দিনে ৪০টি শিশু মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে। অথচ অনেকের ধারণা, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি মারা যায়। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। তবে এসবের রিপোর্ট হয়না। পুলিশের খাতায়ও এবিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। এক সূত্র থেকে জানা যায়, “জানুয়ারি থেকে ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সারাদেশে ৩৯৭ ঘটনায় ৭০৩ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা গেছে। এদের মধ্যে ৪৬১ জনের (৬৫.৫৭%) এর বয়স ৯ বছরের কম। মৃতদের মধ্যে ২০৭ জন নারী বা কন্যাশিশু রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা পরিবারের অন্য সদস্যদের অগোচরে বাড়ির আশেপাশের পুকুর বা জলাশয়ে চলে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়।  এসব তথ্য ও উপাথ্য থেকে বুঝা যায় আমাদের দেশে পানিতে ডুবে অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত ও  দুঃখজনক মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।  অত্যন্ত দুঃখের এবং শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকে বৈশ্বিক ভাবে এসডিজির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুকে অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ফলে অসুস্থতাজনিত কারণে শিশু মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হলেও, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার প্রতিরোধে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হলে সার্বিকভাবে মৃত্যুর উচ্চহার থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশের একটি জাতীয় নীতিমালা প্রয়োজন, যেন সারা দেশে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। সেই সঙ্গে শিশুদের জন্য নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনকে সম্পৃক্ত করে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন একটি কার্যকর উপায়(সূত্রঃ দৈ/ ইত্তেফাক, ২৯ ডিসেম্বর’২০)।

আমাদের দেশে চারদিকে প্রচুর উন্মুক্ত জলাশয়, দীঘি, পুকুর, নদী, ডোবা, খাল, বিল রয়েছে তৎমধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে বাড়িঘরের সন্নিকটে অবস্থিত পুকুর যেখানে ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বলে জানা যায়। তাছাড়া শিশুদের দেখ-ভাল করার মন মানসিকতার অভাব, অযত্ন অবহেলাও কম দায়ী নয়। কেননা এসব মৃত্যুর ৬০শতাংশ ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে। কারণ এ সময় মায়েরা পারিবারিক, সাংসারিক, গৃহস্থলী, কৃষিসহ বিবিভন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাবারা কাজে ঘরের বাইরে এবং বড় ভাই-বোন থাকলে তারা হয়তো স্কুলে থাকেন। পাশাপাশি  দরিদ্র গরীব পরিবারে শিশু মৃত্যু বেশি ঘটে কেননা অনেকক্ষেত্রে মা ও বোনরা অন্যের ঘরে এসময়ে কাজে ব্যস্ত থাকে। কিশোর তরুণ যুবকদের ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে সাঁতার না জানা। তাছাড়া দুর্ঘটনাস্থলে তাৎক্ষনিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার মতো জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ অনেকেরই নেই। ফলে পানিতে ডুবলে সেখান থেকে উঠিয়ে কী করা হবে সেটাই অনেকে জানেনা । বিশেষ করে হার্ট ও শ্বাস-প্রশ্বাস চালুর প্রাথমিক প্রচেষ্টা বা শিক্ষা কারো নেই। পাশাপাশি নানা কুসংস্কার- যেমন মাকে ধরতে না দেওয়া বা অনেক সময় শিশুকে মাথায় তুলে চারদিকে ঘোরানো। তার ওপর রয়েছে হাসপাতাল বা কমিউনিটি ক্লিনিকে অ-ব্যবস্থাপনাও। অনেক ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়া শিশুকে কী করা হবে বা ফার্স্ট রেসপন্স সম্পর্কে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির অভাব রয়েছে সর্বত্র। পাশাপাশি সারাদেশে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন নগরায়ন পুকুর দীঘি জলাশয় খালবিল নদী দখল ভরাটের কারণে সাঁতার শেখার ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠ, পুকুর ছাড়া স্কুল মাদ্রাসা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে অথচ এককালে খেলার মাঠ আর পুকুর ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্টা চিন্তাই করা যেতো না। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল অথচ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থাই নেয়। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাং কালচারসহ বিভিন্ন অনৈতিক ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আসক্ত হচ্ছে উন্মুক্ত অপ এবং আগ্রাসী আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে। শিক্ষাঙ্গনে বিভিন্ন যৌন হয়রানী ও নিপীড়ন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই সাঁতার শেখানো উচিৎ। পাশাপাশি জেলা, থানা, উপজেলা, ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে সাঁতার শেখার জন্য সুইমিংপুল নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর সুব্যবস্থা করাটাও জরুরি। পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে নদীতে এবং পুকুরে শিশু কিশোর তরুণ এবং যুবকদের মধ্যে পুকুর এবং নদীতে সাঁতার শেখানো এবং বিভিন্ন বয়সীদের মধ্যে সাঁতার প্রতিযোগীতারও বিকল্প নেই। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। আনন্দের বিষয় হল এর তিনটিই বাংলাদেশের সাফল্যের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। এগুলো হলো পুকুরপাড়ে বেড়া দেওয়া, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র ও সাঁতার শেখানো।

শিশুমৃত্যু রোধ, পুষ্টি ইত্যাদি খাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তৎপরতা একেবারেই কম। যা-ও হয়, তা কিছু পাইলট কর্মসূচি। যেমন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আছে দুটি কর্মসূচি। দুটোই শিশুদের সাঁতার শেখানোর। এর মধ্যে একটি কর্মসূচি গত জুন মাসে শেষ হয়েছে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল তিন লাখ শিশুকে সাঁতার শেখানোর। শেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার শিশুকে। এ তথ্য দিয়েছেন কর্মসূচি দুটোর পরিচালক পাপিয়া ঘোষ। আরেকটি কর্মসূচিতে দুই লাখ শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে। দুই প্রকল্পের জন্য বাজেট ৫ কোটি করে ১০ কোটি টাকা। দুটো কর্মসূচিরই বাস্তবায়ন এলাকা ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলা। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় এনজিওগুলো। কিন্তু দেশে সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় বরিশাল বিভাগে। জাতীয় পর্যায়ে যেখানে লাখে ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়, সেখানে বরিশাল বিভাগে এ সংখ্যা ৩৪। দুই কর্মসূচির একটিও বরিশাল বিভাগে নেওয়া হলো না কেন, জানতে চাইলে পাপিয়া ঘোষ বলেন, ‘যেসব এনজিও প্রস্তাব নিয়ে আসে, তাদেরই কাজ দেওয়া হয়। এখানে এনজিওগুলোই কাজ পাওয়ার ব্যাপারে সক্রিয়।’( সূত্রঃ প্র / আলো, ২৫ জুলাই’২১ )।  এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ রোবেদ আমিনের বরাতে জানা যায়, তিন বছর আগে ‘ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয় কৌশলপত্র’ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। কৌশলপত্রটি পরিমার্জন করে কাজে লাগাতে হবে। আমরাও চাই নদী মাতৃক বাংলাদেশে পানিতে ডুবে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধে জাতীয় কৌশলপত্র কার্যকর করা হবে। পাশাপাশি শিশুসহ কিশোর তরুণ যুবক তথা এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে সাঁতার শেখানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। যেকোনো অস্বভাবিক অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের মনকে দুঃখভারাক্রান্ত করে। করে বেদনাহত ও মর্মাহত। তাই পানিতে ডুবে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুরোধ করা সময়ের দাবী।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ