তিন মুসাফির

তার ছেঁড়া ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, শুক্রবার, ০৯:৫৭:০৫অপরাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক ৭ মন্তব্য

ভোরবেলা ! তিনজন মানুষ কথা বলছে ,

১মঃ আমি কিছুই বুঝি নাই ভাই । বিশ্বাস করেন । চোখের সামনে অনেক মানুষ । হঠাৎ মাথাটা ঝাকি দিয়ে উঠল । বুঝলাম না কেমনে কি ! এরপর আর কিছু মনে করতে পারি নাহ ।

২য়ঃ আমারো একি অবস্থা ভাই । কিন্তু আমি উপুর হয়েছিলাম । ঘারের কাছে উষ্ণ একটা স্পর্শ এরপর অন্ধকার !

৩য়ঃ আমি কিন্তু বুঝেছিলাম ভাই । বামহাতে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছিল । শরীরটা একটু একটু করে দূর্বল আর অবশ হয়ে যাচ্ছিল । এরপর একটু ঘুমের আবেশ চলে আসছিল আর চারপাশটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল । আমি এক ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিলাম । এরপর আর কিছু মনে করতে পারি নাহ ।

১মঃ হুমম ভাই । আপনি অনেক ভাগ্যবান ছিলেন তাই ওই অসাধারণ অনুভূতিটা পেয়েছেন । কিন্তু আমি আর কই পেলাম । জানেন ভাই , আমার শখের Ruger Single Six RSS4 pistol টা পুলিশ বায়েজাপ্ত করেছে । আফসোস লাগে , ভার্সিটিতে থাকতে কত শখ করে কিনেছিলাম । কিন্তু শুধু একবার ব্যাবহার করেই পুলিশ তা নিয়ে গেল ।

২য়ঃ আহারে ! মজার জিনিস কি জানেন ভাই , এই পুলিশ কিন্তু একটা ভালো কাজ করতেছে । ওই জায়গাটায় মানে যেখানে আমি থাকি ওখানে তারা খুব কড়া ডিউটি দেয় । কোন মানুষকে আসতেই দেয় না । হা হা হা ।

৩য়ঃ সেদিন বাসায় গিয়েছিলাম । সবাই ভালোই আছে । হাসিখুশী আছে । শুধু মা কেমনজানি আনমনা হয়ে থাকেন । আর ছুরি দেখলেই ফেইন্ট হয়ে যান ।

১মঃ বাড়ীর কথা মনে করে দিলেন ভাই । কতদিন যে যাইনা । গেলেই কষ্ট বাড়ে । আমার কথা আর কেউ মনে রাখে নাই । আমার সাদাকালো দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিটায় ধুলো জমে গেছে । মোছার কেউ নাই । মা মুছুত মাঝে মাঝে । কিন্তু মা এখন অসুস্থ , তাই আমার কথা ভাবার আর কেউ নাই ।

২য়ঃ না ভাই । আমি সুখী মানুষ । আমি প্রতিদিনই যাই আমার বাড়ীতে । আমার স্ত্রী আর দুই কন্যা । মেয়েরা বাপ ভক্ত হয় জানেনই তো । যদিও বুঝ হওয়ার পর থেকে তার আমায় দেখে নাই । কিন্তু আমায় যতেষ্ঠ ভালোবাসে । ভালো কাজে যাওয়ার আগে আমার কাছে দোয়া চায় । আমিও তাদের প্রাণ ভরে দোয়া করি ।

৩য়ঃ হ্যা ভাই , আপনি আসলেই সুখি মানুষ । ভাই , আপনারা কি করতেন ?

১মঃ ভাই , আমি ছাত্ররাজনীতি করতাম । ভার্সিটির বড় মাপের নেতা ছিলাম । সবার অনেক সাপোর্ট পেয়েছিলাম । আসলে সত্যি বলতে , সৎ থাকার চেষ্টা করেছি আরকি ।

২য়ঃ আমি ভাই কলেজের শিক্ষক ছিলাম । ছারদের পড়াতাম । সবসময় ভালো থাকার , সৎ থাকার , অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলতাম । আর আপনি ভাই ?

৩য়ঃ আমি ভাই সাধারণ একজন সাংবাদিক ছিলাম । কিন্তু ভাই সাধারণ হলেও কখনও অন্যান্যকে ভয় পাইনি । কলম চালিয়ে গেছি সবসময় । খারাপকে কম্প্রোমাইজ আমার ধাতে ছিল না । যাই হোক ভাই , আপনারা এখানে এলেন কিভাবে ?

১মঃ সেদিন ক্যাম্পাস থেকে মিছিলে গিয়েছিলাম । রফিক ভাই , বরকত ভাইয়ের সাথে । ঢাকা মেডিকেলের সামনে আসতেই পুলিশ মিছিল গুলি করে । আঃ জব্বার ভাই ওখানেই মারা যান । এরপর ছত্রভঙ্গ হয়ে আমরা ছুটতে থাকি । হয়ত আমাকেও গুলি করেছিল । তাই আজ আমি এখানে ।

২য়ঃ আরেহ ভাই , এই কথা । আমি মিছিলে যাইনি । কিন্তু এর পরদিন এই হত্যার বিরুদ্ধে কলেজে প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছিলাম । সেদিন রাতেই মিলিটারীরা আসে । আমাকে ধরে নিয়ে যায় । হাত পা বেধে ফেলে রাখে রেইললাইনে । সবকিছু মুছে যাওয়ার আগে আমি ট্রেইনের হুইশেল শুনতে পেয়েছিলাম । তারমানে আমি ট্রেইনেই..… যাইহোক , ভাই আপনি ?

৩য়ঃ আমি সাংবাদিক ছিলাম । ২৩ ফেব্রুয়ারী কিছু মুখোশধারী মানুষ আসে । উর্দুতে বলে , আমি ভাষা নিয়ে যা মাতামাতি করছি এর পুরষ্কার আমার প্রাপ্য । আমি বাহাতি ছিলাম । তারা আমার বাহতটা কব্জি থেকে কেটেদিল আমার মায়ের সামনেই । রক্তক্ষরণের ফলে আমি মারা যাই ভাই ।

১মঃ বুঝলাম ভাই । কিন্তু জানেন , মৃত্যুর সময় আমি একটুও কষ্ট পাইনি । মনে হয়েছিল , মা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে ।

২য়ঃ হয়ত ভাই আমরা শহীদ হয়েছী তাই মৃত্যুকষ্ট ভোগ করি নাই ।

৩য়ঃ কিন্তু ভাই , আমাদের কথা কেই বা মনে রেখেছে । নিজের পরিবারই মনে রাখে নাই , আর তো দেশের মানুষ । কই ? রক্তদিয়ে ভাষাকে আনলাম , কিন্তু আমাদের সবাই ভুলে গেল !

( ঠিক তখনই তারা তিনজন শুনতে পেলেন অনেক মানুষের সম্মিলিত কন্ঠস্বরে গান,

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গান একুশে ফেব্রুয়ারী ,
আমি কি ভুলিতে পারি !!! )

[ কাল্পনিক ]

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ