ডাউন মেমোরি লেন -২

কমলিনী ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ০৪:৩৮:১৪অপরাহ্ন স্মৃতিকথা ১৮ মন্তব্য

#ডাউন মেমোরি লেন -২

 

আমার সবথেকে ছোট বয়সের যে স্মৃতি আবছা হয়ে মনে পড়ে, তা হলো দক্ষিনেশ্বরের ঘাটে আমায় ডুবিয়ে স্নান করানোর একটা সাদাকালো মুহূর্ত। মায়ের কাছে শুনেছি তখন আমার বয়স দু থেকে আড়াই হবে। সাদাকালো বললাম এই কারনে,  যে কোনো এক সিঁড়ির বাম প্রান্তে, দু হাতে ধরে আমাকে দু তিনবার ডুব দেওয়ানো ছাড়া আর কিছুই মনে নেই।

 

আমাদের শরীকী বাড়ির সদস্য সংখ্যা ছিলো অনেক। ঠাকুর্দার নিজের ভাই ছাড়াও জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইয়েরাও এই একই বাড়িতে থাকতেন। বিরাট বড়ো মাঠের মত উঠোন। ঠাকুর্দার এক জেঠতুতো দাদার স্ত্রী ছিলেন বাড়ির সবার বড়মা। তার একমাত্র সন্তান বংশী শিশু অবস্থায় মারা যায়। বাবা কাকাদের মত আমরা পরবর্তী প্রজন্মও তাকে বড়মা বলতাম। নাম ছিলো গুরুদাসী।নিতান্ত নির্বিরোধী মানুষ। কোনোদিন উঁচু গলায় কথা শুনিনি। দরবেশ মতে দীক্ষিত ছিলেন। বড়োমার স্বামী  বড়ো ঠাকুর্দা হরিপদর মৃত্যুর পর তাকে দাহ করা হয়নি, সমাধিস্থ করা হয়েছিল বাড়িতেই। আমার জন্মের বহু আগেই তিনি মারা গিয়েছেন। তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল ঐ সমাধিঘর। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পরবর্তীকালে ' গোরস্থান ' ' সমাধি' নিয়ে অনেক ভৌতিক কাহিনী পড়লে শুনলেও আমরা কোনোদিন বিন্দুমাত্র ভয় পাই নি। বরং আমাদের মানে ছোটদের শৈশবের অবাধ বিচরণভূমি ছিলো ঐ জায়গাটা।লুকোচুরি খেলার আদর্শ স্থান। সমাধি ঘরের বামপ্রান্তে একটা গোলাকৃতি উঁচু অংশ। সেটা বড়ো ঠাকুর্দার মাথা। খেয়াল রাখতাম যেন খেলতে গিয়ে সেখানে পা না লাগে।

 

বড়োমা সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন। তিনবেলা খাবার নিয়ে সমাধিতে নিবেদন করে তবে নিজে কিছু খেতেন। মৃদু গলায় উচ্চারণ করতেন...  ' গোঁসাই...  অবোধন... দরদী...

তার অর্থ আজও সঠিক জানিনা। আমি তখন  ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে থাকি।একদিন খবর এলো বড়োমা আর নেই। তাকেও দরবেশ মতে আসনপিঁড়ি করে বসিয়ে বস্তা বস্তা লবন দিয়ে বড়ো ঠাকুর্দার পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। আমি যখন আসি, তখন সব সমাধিস্থ করা হয়ে গেছে। কেবল দেখলাম আগের গোলাকৃতি অংশের পাশে আর একটি...

 

বড়োমা সংসারে থাকতেন প্রায় উহ্য হয়ে, লীন হয়ে...সমস্ত জগৎ সংসারের প্রতি এক অদ্ভুত নির্লিপ্তি। আছেন অথচ কী ভীষণ ভাবে নেই... এক অদ্ভুত সময়ে তার প্রয়োজন পড়তো। বাড়ির বড়োরা যখন কোনো অন্যায়, অপরাধ করতো, তখন ঘটা করে তার কাছে সকলে ক্ষমা চাইতে যেত। তিনি ক্ষমা করতেন কিনা জানিনা...  কিন্তু ওটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। আজ ভাবি তিনি কি সত্যিই ক্ষমা করতেন! নাকি সকলের অপরাধের জন্য নিজে ক্ষমা চাইতেন তার ' গোঁসাই...  অবোধন...  দরদী..' র কাছে?  এ কী কেবল মন্ত্র,  নির্ভরতা না আত্মশক্তি?...  জানিনা….

 

 

( ক্রমশ...)

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ