আমি বাংলার গান গাই…

রিফাত নওরিন ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ০৬:০৭:৫৩পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২ মন্তব্য

দীর্ঘ চার বছর মেক্সিকো দেশটিতে ভিন্ন ভাষা এবং ভিন্ন সংস্কৃতিতে জীবন-যাপন করে চার বছর পূর্বে
আমরা আমরা আমেরিকায় আসি স্কিল ক্যাটাগরিতে আমার স্বামীর পাওয়া কর্মসূত্রে ।
বড়ছেলে ততোদিনে স্প্যানিশে কথা বলা শিখে ফেলেছিলো।

নতুন আমেরিকায় এলাম, তখন কানসাসে থাকতাম আমরা,
তাই অনেক বাঙালি পরিবারের সাথে দাওয়াত-যোগাযোগ বেড়েই চললো।
সেখানে দেখতাম জন্মসূত্রে আমেরিকান হওয়ায় বাচ্চাগুলো আর বাংলায় কথা বলতে পারতোনা,
এমনকি তাদের খাবার তালিকাও ভর্তি থাকতো পিজ্জা-বার্গারে।
এইদিকে আমার বাচ্চা তো অন্য দেশ থেকে আসায় তাদের সাথে বাংলায় কথাবলার চেষ্টা করতো।
বাচ্চাগুলো ভীষণ হাসাহাসি করতো তার বাংলায় কথা বলা নিয়ে, সে খুব বিব্রত বোধ করতো এতে।
এরপর আমার ছেলে স্কুলে যাওয়া শুরু করলো,
তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষায় কথা শুরু করতে লেগেছিলো মাত্র তিনমাস।
আলহামদুলিল্লাহ তিনমাসেই সে শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলো।

এইদিকে স্কুলে পড়াশুনায় যখন সে ব্যাস্ত হয়ে ওঠে
তাকে অতিকষ্টে শিখানো বাংলা বর্ণমালা ভুলে যেতে শুরু
করে ।
কিন্তু বাসায় তবুও আমার চেষ্টা থাকতো কথোপকথন যেনো বাংলায় বলে আমার বাচ্চারা।
মোটমুটি এইভাবেই চলছিল আমাদের জীবনযাপন।
বাংলা কার্টুন, বাংলা ছড়াগান এই সবের অভ্যাস করাচ্ছিলাম আমি আস্তে আস্তে, যাতে নিজের ভাষাটার চর্চা থাকে ।
এরমধ্যে দেশে গেলাম গত বছর, সবাই শুধু আমার বাচ্চাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিভাবে তারা বাংলা বোঝে, কিভাবে কথাবলে সবাই মুগ্ধ ।
হ্যাঁ তারা খুব শুদ্ধ করে বলতে না পারলেও বলতে তো পারতো, আমার বাচ্চাদের তাদের কাজিনদের সাথে মিশে যেতে দুটো দিনও লাগেনি।

যখন দেখলাম দেশে অনেকটা দিন থাকতে হবে
আমিও তখন ভাবলাম এই সুযোগটা কাজে লাগাই।
নিজের বাবার বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি সব যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, শ্বশুরবাড়িতে বাচ্চাদের জন্য আরবি পড়ানোর হুজুর রাখলাম, আর নিজে বর্ণমালা থেকে আবার বাংলা পড়ানো শুরু
করলাম ।
ইংরেজী পুরোপুরি বাদ দিয়েছিলাম তাদের জন্য,
বাতিঘর থেকে অনেক অনেক বই কিনেছি বাংলা বর্ণমালার বই, ছোট গল্প পড়ার বই আরও বহুকিছু।
শুধু ভাবতাম যেভাবেই হোক একটু যেনো বাংলা পড়া শিখতে পারে।
যারা দেশের বাইরে থাকে না তারা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেনা বাচ্চাদের নিজের ভাষা বুঝতে
পারা আর পড়তে পারা কতোটা কষ্টের ।

আমার বড় ছেলে যেদিন বাংলায় আমাকে
ছোটগল্প পড়ে শোনালো আমি কিযে খুশি হয়েছিলাম যেটা প্রথম সে যখন ইংরেজীতে অথবা স্প্যানিশে কথা বললেও লাগেনি।
আমাকে দেশে যখন সবাই বলতো কেনো এতো জোর দিচ্ছি বাংলায়, সে তো আর এইদেশে থাকবেনা।
আমি তাদেরকে একটা উত্তরই দিতাম-
বাচ্চারা বাংলা ভাষায় সাহিত্য উপন্যাস লিখবে এই টুকু না হলেও যেনো ভাষার চর্চাটা তাদের থাকে,
আমাদের ভাষার যে গৌরবজনক ইতিহাস তা যেনো আমার বাচ্চারা জানে সেই চেষ্টাটুকু করে যাবো আজীবন ।

তাই বলবো, দেশে থেকেও যেসব মায়েরা বাচ্চাদের ইংরেজী বলা, ইংরেজী পড়া নিয়ে গর্ববোধ করেন
তারা যেনো বাংলা পড়ানোর চর্চাটাও রাখেন।
প্রবাসী মায়েদেরকেও বলবো নিয়ম করে প্রতিদিন না হোক সপ্তাহে দুটো দিন যেনো বাংলা পড়ানো হোক।

বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ
পরবাসী হয়েও যেনো, এই দ্বীপ-শিখাটি সন্তানদের মাঝে জ্বালিয়ে যেতে পারি এই প্রার্থনাই করি আমি এখন।

~ রিফাত নওরিন
আটলান্টা( যুক্তরাষ্ট্র )

0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ