বঙ্গবন্ধুকে শেষ দেখা

কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি

ইতিহাসের সেই ভয়াল কালরাত    ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। রাত ১২টা ৩০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে সবাই বেরিয়ে এলাম। তখনো বুঝতে পারিনি এটাই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের জীবনের শেষ দেখা। কত কথা বলার ছিল, কত কথা শোনার ছিল, কিন্তু কিছুই বলা হলো না, কিছুই শোনা হলো না। যদি জানতাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না, এটাই শেষ দেখা। তাহলে ওভাবে তাড়াহুড়া করে চলে আসতাম না। অনেকক্ষণ বঙ্গবন্ধুকে দেখতাম— অনেক কথা শুনতাম।

কীভাবে কী হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো জীবনের সব কিছু এক মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

সেদিন ছিল ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। বাকশালের আদলে যুবলীগ কমিটি নতুনভাবে গঠন করতে সারাদিন মণি ভাই ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। আমরাও মণি ভাইয়ের সঙ্গে ‘বাংলার বাণী’ অফিসে সারাদিন কাটিয়েছি। সঙ্গে ছিল বন্ধু এস এ রেজা, অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দিন আহমেদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, আওরঙ্গ, ফজলে এলাহী, অ্যাডভোকেট মেজবাউদ্দিন, ফকির আবদুর রাজ্জাক, শফিকুল আজিজ মুকুল, মনিরুল হক চৌধুরী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমদ, অ্যাডভোকেট রেজাউর রহমান, ইঞ্জি. হান্নান, সুলতান শরীফ (বর্তমান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি) আরও অনেকে।

বিকালে অল্প সময়ের জন্য বাসায় এসে আবার সন্ধ্যায় পুরানা পল্টন যুবলীগ অফিসে হাজির হলাম। ইতিমধ্যে ঢাকা শহর যুবলীগের নেতারা এসে অফিসে ভিড় করেছে। টানটান উত্তেজনা। কারণ এ দিন দুপুরের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন স্থানে তিনটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। যুবলীগ কর্মীদের ধারণা এটা ‘জাসদ’ করেছে। কারণ পরের দিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধু যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে না যান সেজন্য জাসদ বোমাবাজি করেছে। তাই যুবলীগ নেতা-কর্মীরা ছিল খুবই উত্তেজিত। মীরপুরের সাবেক এমপি খালেক সাহেব তখন ঢাকা শহর যুবলীগের সহসভাপতি এবং মীরপুরের হারুন মোল্লা তখন মীরপুর থানা যুবলীগের সভাপতি। দুজনকে তাদের কর্মী বাহিনী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসার জন্য বলা হলো। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে বিরাট শো-ডাউন দেওয়ার জন্য মণি ভাই আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই আমরাও ঢাকা মহানগর যুবলীগ সর্বশক্তি দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

 

যুবলীগ অফিসে তখন মন্টুভাই, আমি, এম এ রেজা, সাইফুদ্দিন, রেজা শাহজাহান, ফজলে এলাহী কোতোয়ালি থানার- পনির, আজমল, আহসান উল্লাহ মনি, সুবির কুশারী, সূত্রাপুরের- কেয়ামুদ্দিন কেমু, মন্টু, বাদল, আখতার, ধানমন্ডির- টয়, অ্যাডভোকেট সাইদুর (মরহুম) জয়নাল, মিলন তেজগাঁওর- হুদা, মিলন, পলাশ মতিন মোহাম্মদপুরের লুত্ফর, চঞ্চল, ফারুক, বুলবুল আরও অসংখ্য নেতারা ছিলেন।

রাত ৯টার দিকে শেখ মণি মতিঝিল ‘বাংলার বাণী’ অফিস থেকে যুবলীগ অফিসে আসলেন। বললেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের ডেকেছেন। রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় আমাদের যেতে হবে। তখনো আমরা কেউ রাতের খাবার খাইনি। আমরা যার যার গাড়ি নিয়ে মণি ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম। সম্ভবত যতদূর মনে পড়ে মণি ভাইয়ের সঙ্গে খাবার টেবিলে তখন উপস্থিত ছিলাম- আমি, সাইফুদ্দিন, সৈদয় আহমদ, শফিকুল আজিজ মুকুল, ফকির রাজ্জাক, ইঞ্জিনিয়ার হান্নান, মনিরুল হক চৌধুরী, সুলতান শরীফ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। আমরা সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খেলাম। তখনো জানতাম না মণি ভাইয়ের সঙ্গে এটাই আমাদের শেষ খাবার। আরজু ভাবী আর কোনোদিন আমাদের খাবার পরিবেশন করবেন না।

খাবার পর মণি ভাইর বাসায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলাম। তখন রাত ১১টা ৩০ মিনিট। আবদুর রাজ্জাক ভাই ও আদমজির মান্নান ভাই আমাদের সঙ্গে যোগ হলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক ব্যাপারে মণিভাই খোলামেলা আলোচনা করলেন।

একপর্যায় বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘ফিরোজ- তোকে ঢাকা সিটি যুবলীগের সেক্রেটারি জেনারেল করেছি।’ আগামীকাল গেজেটে যাবে। এখন থেকে নিয়মিত অফিস করতে হবে। বাকশাল এটা নতুন কনসেপ্ট। সব যুব শক্তিকে একত্রিত করে দেশের কাজে লাগাতে হবে। বঙ্গবন্ধু মণি ভাইকে নির্দেশ দিলেন- যুবলীগের কর্মীরা যেন শান্ত থাকে। রাত তখন ১২টা ৩০ মিনিট ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৫ আগস্ট রাত যত গভীর হচ্ছিল সবার অজান্তে সেই ভয়ঙ্কর কালো ছায়া ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছিল।

আমরা একে একে বিদায় নিলাম। শেষ বিদায়ের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। বঙ্গবন্ধু আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন ‘তোকে অনেক বড় দায়িত্ব দিয়েছে- মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করবি। তুই পারবি।’ আমি শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নীরব সম্মতি জানালাম।

ওখান থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে মণি ভাইর বাসা পর্যন্ত এলাম। মণি ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার গাড়িতে বাসায় রওনা দিলাম। আমি খুব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। সঙ্গে অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দিন, ফকির রাজ্জাক, মুকুল ভাই ছিল। আমি তখন সদরঘাট কোতোয়ালি থানা সংলগ্ন ১ নম্বর সিম্পসন রোডে থাকি। পথে নবাব পুর ওদের নামিয়ে বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি।

খুব ভোরে ফোন বেজে উঠল। ফোন ধরতেই সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি প্রথম শুনলাম- বরিশালের বন্ধু লতিফুর রহমান মন্টুর কাছ থেকে। কিছুক্ষণের জন্য সব চিন্তা হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। খবর শুনে চারদিক থেকে যুবলীগ নেতা-কর্মীরা এসে জগন্নাথ কলেজে সমবেত হতে লাগল। আমিও সব প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। জগন্নাথ কলেজে গিয়ে দেখি প্রায় দুই-তিনশ যুবলীগ কর্মীরা কলেজে অবস্থান করছে। সবাই বলছে কিছু একটা করতে হবে। জীবন দিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিব।

শুনলাম মন্টুভাই মণি ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ ঢাকা মেডিকেলে রেখে কেরানীগঞ্জ গিয়ে থানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দিন, রেজা সাজাহান, এলাহী, পনির, আজমল, মোহন, সুবির, কেমু, মন্টু, বাদলসহ আমি কোতোয়ালি থানায় গিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিলাম। সব পুলিশ আমাদের পক্ষে। ডিএসপি লোদি আমাদের সহযোগিতা করলেন। বললেন খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। তোমরা ধৈর্য ধর। আমরা তখনো উপরের একটি নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু কে আমাদের নির্দেশ দিবে? ইতিমধ্যে তিন বাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর নেতৃত্বে মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রদান করেছে। আমরা রক্ষী বাহিনীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম- ভেবে ছিলাম রক্ষী বাহিনী বিদ্রোহ করলে আমরাও যোগ দিব। কিন্তু কিছুই হলো না। জেনারেল শফিউল্লাহ খুনি মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশ্বাস ঘাতকতা করলেন। সন্ধ্যায় মোশতাকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা হলো। অনেক আওয়ামী লীগ নেতা যোগদান করলেন। এর পরের ইতিহাস আর লিখতে চাই না। তিন বছর পর যখন নিজ বাড়িতে ফিরে আসলাম- দেখলাম সব কিছু বদলে গেছে। আমিও বদলে গেছি।

অবশেষে বুঝলাম ক্ষমতার বলয়ে সৃষ্টি হওয়া চাটুকার, বন্দনাকারী ও সুবিধাভোগীরা কখনো দুর্দিনে কাজে আসে না।

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ