উত্তাল সাগরে আমি # [ভূমিকা : ( ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল ' ১৯৯১ ইং স্বরণে ), ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্বরনীয় দিন। স্বরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণীঝড়ের কবলে এদিন বাংলাদেশের জনমানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। এ সময়ের ঘঠনায় আমার থলেতে কিছু স্বরনীয় ঘঠনা জমে আছে.... তা এখন শেয়ার করবো। আশা করা যায় আমার বিবরণে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে।........সে দিন জাহাজে আমার সাথে যারা ছিলো এবং জাহাজের প্রত্যেক্ষদর্শি যারা, তারা সবাই আমাকে ঘটনাটি লিখে রাখার জন্য উৎসাহিত করেছিল (এখানে ঘটনা বলতে মাঝসাগরে নিক্ষেপ করা একজন লোককে উদ্ধার অভিযানের কথা বলা হয়েছে)। বলতে গেলে তাদের উৎসাহেই পরবর্তীতে আমি এই লেখায় হাত দিয়েছিলাম। এই লেখায় সেদিনের ঘূর্ণীঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতির যে বর্ননা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবিকই প্রেকটিক্যাল। ঐতিহাসিকদের জন্য এখানে কিছু উপকরন থাকতেও পারে। ঐ ভয়াল রাতের অন্ধকারে যারা জীবন যুদ্ধে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি .......।]

৬ মে ১৯৯১ ইংরেজী, সোমবার। গভীর বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উত্থাল ঢেউয়ের তরঙ্গ মালা ভেদ করে দানবের মতো ছুটে চলছে একটি জাহাজ। জাহাজের নাম ‘মহেশখালী। গন্তব্য স্থান কুতুবদিয়া।

বিরাট তিন তলা জাহাজে প্রায় দুইশ যাত্রী। জাহাজের ধারণ ক্ষমতা দুই হাজারের উপর হলেও পরিস্থিতির কারণে যাত্রীর সংখ্যা খুবিই কম। নীচ তলার প্রথম শ্রেণীর মহিলা কেবিনের এক পাশে আমাদের ত্রাণসামগ্রীর বস্তা রেখে অন্য পাশে সারিবদ্ধ চেয়ারে আমরা বসেছি। সমুদ্র খুবিই গরম। ঢেউয়ের পর ঢেউ আঘাত হানছে জাহাজের গায়ে। মস্ত বড় জাহাজ ঢেউয়ের আঘাতে হেলে দুলে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। জাহাজ নৈশ কোচের পাখার মত উপর নীচে এবং ডানে বায়ে কাত হয়ে অনেকটা লাঠিমের মত ঘূর্ণন গতিতে এগিয়ে চলছে। আঁকা বাঁকা রাস্তায় চলন্ত ট্রেন যেভাবে যাত্রীদের হয়রানী করে, জাহাজের আরোহীদেরও সেই একই অবস্থা। মনে হচ্ছিলো যেন প্রতি মুহুর্তে ভূমিকম্প হচ্ছে।

মনে পড়ে ঐদিন থেকে ঠিক সাত দিন আগের সোমবারে ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ ইংরেজী । চট্টগ্রাম এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য ছিল দশ নাম্বার বিপদ সংকেত। সে রাত এগারটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে এবং আশ পাশের এলাকায় যে ভয়ংকর ঘূর্ণীঝড় বয়ে গিয়েছিলো তাকে বলা হয়েছিলো ‘ম্যারি এন’।

ঘন্টায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে দানব রুপি ড্রাগনের নি:শ্বাসের মত যে তপ্ত ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস বয়ে গিয়েছিলো তা শত বৎসরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিলো। কবির কল্পনা, সাহিত্যিকের ভাষা, সাংবাদিকের কলম, শিল্পীর তুলি সব বোবা প্রমানিত হয়েছিল ঐ ‘ম্যারি এন’র কাছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি জেলা একে অন্যের অস্থিত্বের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে পড়েছিলো। পরের দিন অর্থাৎ ৩০শে এপ্রিল স্থানীয় পত্রিকা অনুমান করে লিখেছিলো দুই সহস্রাধিক নিহত। কিন্তু পরবর্তীতে এই সংখ্যা দুই থেকে তিন লাখের মাঝামাঝি ছিলো। শুধু কুতুবদিয়া উপজেলায় মোট আশি হাজার লোকের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ নিহত হয় বলে পত্র-পত্রিকায় ধারণা করা হচ্ছিলো।

মহেশখালী, বাঁশখালী, হাতিয়া, কক্সবাজার, আনোয়ারা, পতেঙ্গা, সন্দ্বীপ বোয়ালখালী, ফটিকছড়ি ইত্যাদি এলাকায় পাইকারী হারে মানুষ, জন্তু নিহত হয়েছিলো। এমনকি সাতকানিয়া, পটিয়া, রাউজান ইত্যাদি এলাকায় ক্ষতি হয়নি এরকম প্রতি দশ হাজার ঘরের মধ্যে একটি ঘর খুঁজে পাওয়া রীতিমত মুসিবত ছিল।

ছাব্বিশ বছরে পর  এসে আমি এ দিনকে স্বরণ করছি আর ঐ দিনের সমস্ত নিহতের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। সেদিন দেশের এমন পরিস্থিতিতে নিজের উপর কিছু দায়িত্ব অনুভব করেছিলাম। দু’এক জন বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম দূর্গত এলাকার সাহায্যার্থে এগিয়ে যাবো। যদিও আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। এ উদ্দেশ্যে ঘূর্ণিঝড়ের দু’দিন পর থেকেই আমরা আমাদের এলাকা থেকে ঘরে ঘরে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করেছিলাম। প্রথমে উদ্দেশ্যে ছিলো বাঁশখালী যাবো। অবশ্য অন্যান্য এলাকার মত আমাদের গ্রামেও ক্ষতি হয়নি এরকম একটি বাড়িও পাওয়া যাবে না। আমাদের পুরনো দ্বিতল মাটিয়া ঘরের অনেকগুলো টিন শূন্যে উড়িয়ে নিয়েছিলো ঘূর্ণিঝড়। আশ পাশের সবারই কমবেশী ক্ষতি হয়েছিলো। কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের দরদ, ভালবাসা, সহানুভূতি আর কাকে বলে। যখন বললাম- বাঁশখালীর জন্য সাহায্যে এগিয়ে আসুন তখন পুরুষ মহিলা সবাই সাধ্যমত দুই হাতে সাহায্য করলো। এদিকে আমাদের কাছে খবর পৌছলো, কুতুবদিয়ায় যেমন অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে তেমনি গত ছয় সাত দিনে কোন সাহায্যই ওখানে পৌছেনি।

সেখানে যে কয়জন লোক কোন রকমে বেঁচে আছে তারাও না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। অত:পর আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কুতুবদিয়ায় যাবো স্থির করলাম। কিন্তু বিশাল সমুদ্র পেরিয়ে ঝুকি পুর্ণ এই অভিযানে আমাদের সাথে যাবে কে? বিশেষ করে আবহাওয়া এখনও ঘোলাটে। সমুদ্র খুবিই গরম, প্রতি দিনই থাকছে সতর্কবাণী, নৌ-যোগাযোগ বন্ধ।

শেষ পর্যন্ত অনেককে বলে কয়ে গ্রাম থেকে একজন ও শহর থেকে তিনজন পাওয়া গেলো। আমরা আগে থেকেই চার জন ছিলাম। কিন্তু বাঁশখালীর পরিবর্তে যখন কুতুবদিয়া যাবো মনস্থ করলাম তখন দুই জন সরে পড়েছিলো। ওরা হয়ত ভয় পেয়েছিলো। তবে এই পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়াটা দোষনিয় বলা ঠিক হবে না। তা যাই হোক এক্ষণে আমাদের দলে জাহাজে আমরা মোট ছয় জন। আমি, মোস্তফা কামাল ভাই, সেলিম ভাই, ফেরদৌস ভাই, আরো দুই জনের নাম এখন আমার মনে পড়ছে না। সেখান থেকে একজনের বাড়ী ছিল সম্ভবত লোহাগাড়া থানার পদুয়ায়। জাহাজের হেয়ালী পূর্ণ গতির সাথে তাল মিলাতে না পেরে আমার চার জন সাথী ইতিমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। ওরা সবাই দ্বিতলার ডকের মধ্যে কেউ বমির টেবলেট খেয়ে কেউ লেবুর টুকরা মুখে দিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। জাহাজে স্বাভাবিক হাঁটা যাচ্ছিলো না। লোকেরা হাঁটার সময় মনে হচ্ছিল যেন মাতাল হয়ে চলাফেরা করছে। কিছু না ধরে হাঁটা কষ্টকর ছিলো।

সমুদ্র গরম এবং ঝুকিপূর্ণ বলে মহিলার সংখ্যা তেমন নেই। দুই চার জন যারা ছিলো তারা কেউ এক পাশে চেয়ারে এবং বাকীরা মেঝেতে বসেছে। সমুদ্র পথে এর আগে আমি একবার লঞ্চে ভ্রমণ করেছিলাম। সেবারও আমরা দলে ছিলাম ছয় জন। চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে কুতুবদিয়া, সেখানে একদিন থেকে পরদিন মহেশখালী এবং সর্বশেষ কক্সবাজার। উদ্দেশ্য ছিলো ভ্রমণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো বলে আমি কিছুটা সুস্থ ছিলাম। অন্যদের কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না বলে ওরা প্রথম ধাক্কাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের অবস্থা দেখে আমারও খারাপ লাগছিলো। আমি একটা টেবলেট খেয়ে টেবিলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকলাম।

বেশ কিছুক্ষণ থেকে একজন লোককে জাহাজে গণপিঠুনি দেয়া হচ্ছিলো। লোকটি নাকি কার পকেট মারতে চেয়েছিলো এবং একজন ভদ্র মহিলার কান থেকে স্বর্ণের দুল টানার চেষ্টা করছে। তাই লোকটিকে জাহাজের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে আর পিঠানো হচ্ছে।........

(চলবে)

২য় পর্বের লিংকঃ

http://www.sonelablog.com/উত্তাল-সাগরে-আমি-২য়-পর্ব/

#লেখাটি মোট ৭ পর্বে শেষ হবে।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ