শুভ জন্মদিন তীর্থ

নীলাঞ্জনা নীলা ১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১০:৪৯:২৬পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৪৮ মন্তব্য

আমার আত্মা তুই...
আমার আত্মা তুই...

শুধু আমার গুলটু,

আমি জানি তুই বাংলা পড়তে পারিস না, তা-ও তোকে চিঠি লিখতে বসেছি। আজ যে তোর পনেরোতম জন্মদিন। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিন তুই এলি! জানিস যেদিন তোর অস্তিত্ব টের পেলাম নিজের ভেতর, সেদিন ছিলো ২০০১ সালের ৬ জুন তারিখ। থরথর করে কাঁপছিলাম তখন। চোখে আমার এতো জল লুকিয়ে আছে, সেদিনই টের পেলাম। তুই এসে গেছিস তার মানে আমাকে আস্তে চলাফেরা করতে হবে। সাবধানে রাখতে হবে নিজেকে। অথচ নিজের ব্যাপারে কখনোই এতো যত্নশীল ছিলাম না আমি। রিক্সায় উঠে সবসময় বলতাম ভাই জোরে চালান। জীবনে ওই প্রথম বললাম ভাই খুব আস্তে চালান। জানিস পেটে হাত দিয়ে রাখতাম যেনো তোর একটুকুও ব্যথা না হয়। হঠাৎ একদিন লাফ দিয়ে উঠলি, সে যে কি আনন্দ! তোর দিদিমনি-ভাইয়া খুশীতে কি যে করবে! এরপরে যখন-তখন তুই নেচে ওঠা শুরু করলি। বিশেষ করে আমার ঘুম তোর কিছুতেই সহ্য হতোনা। আর তোর সাথে কতো কতো যে কথা বলতাম! তোর নৃত্যের মাত্রা বেশ বেড়েই চলছিলো। কলেজে ক্লাশ নিচ্ছি, লাফাচ্ছিস, টিচারস মিটিং চলছে তুই কত্থক নেচেই চলছিস। কি যে অবস্থা! আর কি যে ক্ষুধা লাগতো! উফ!! ‘খাই খাই’ রোগ হয়ে গিয়েছিলো। তোর দিদিমনিকে বললাম মামনি গরম গরম রসগোল্লা খেতে ইচ্ছে করছে তোমার হাতে। তোর দিদিমনি বিশাল সাইজের রসগোল্লা বানালো। মনে আছে আমি পাঁচটা খেলাম। অথচ রসগোল্লা অতোটা প্রিয় না আমার। তোর দিদিমনি বললো, “আর খাসনা রে। আমার ভয় করে তোর এতো খাওয়া দেখে।” সেই সপ্তাহেই ধরা পড়লো আমার ডায়াবেটিকস। ডাক্তার বললেন এটা থাকবেনা, সেরে যাবে। শুধু এখন আর নরমাল ডেলিভারির রিস্ক নেয়া যাবেনা। বুঝলাম অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতেই হবে। আর তোর ভাইয়া আর দিদিমনির রোজ যেনো একটা ডিউটি সকালে এসেই খবর নেয়া আমাদের দুজনের মানে তোর আর আমার।

পুরো দশটি মাসের স্মৃতি সব কি আর লেখা যায়রে সোনা? প্রতি মাসে আলট্রাসনো করতে যেতাম মৌলভীবাজার। কে করতো জানিস আলট্রাসনো? তোর বড়ো মামা ডঃ অভিজিৎ রায়, অর্ঘ্য দাদার বাবা। আর গাইনি ডাক্তার উনি সম্ভাব্য তারিখ দিলেন মার্চ ১৭। দিন এগিয়ে আসছিলো, ওদিকে তুই তো নিশ্চিন্ত মনে নেচেই চলছিস। ১৩ তারিখ ঘুম থেকে উঠলাম সকালে, সেদিন তোর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সময় পার হচ্ছে কিন্তু তোর ঘুম ভাঙ্গছে না। তোর ভাইয়া সেদিন বাসায় এলো সকাল এগারোটায়। আমার মুখটা দেখেই জিজ্ঞাসা করলো, “কিতা হইছে তোর? সব ঠিকনি?” বললাম বাপি ও তো নড়ছে না। আটঘন্টা হয়ে গেলো। বাপি বললো তখনই ফোন দিতে দাদাকে। ফোন দিলাম তোর বড়ো মামাকে, বললাম দাদা ও তো নড়ছে না। দাদা ডাক্তার হলে কি হবে অনেক নার্ভাস হয়ে গিয়ে বেশ উচ্চৈঃস্বরে বললো, “তুই ফোনে বলছিস এ কথা? গাড়ী নিয়ে এখুনি চলে আয়। একটা মুহূর্ত দেরী করিস না।” তারপর তোর বড়ো মামার নার্সিং হোমে গেলাম। চেক করার পর দাদা বললো সার্জারী লাগবে। কিন্তু ডাক্তার তো ঢাকায়। উনাকে খবর দেয়া হলো, পরদিন আসবেন। ১৫ তারিখ হবে সার্জারী। সেদিন তোর বড়ো মামার বাসায় গিয়ে থাকলাম। তোর বড়ো মামী কি যে যত্ন করলো। তীর্থ তোর বড়ো মামী, তোর বড়ো বৌদি, তোর ছোটদিদির(শিখা) কাছে আমি ঋণী। অনেক কষ্ট করেছিলো তখন। তারপর পরেরদিন ভর্তি হলাম, এক একটা মুহূর্ত কি অপেক্ষা। তোকে কখন দেখবো? পরেরদিন যখন আমাকে ওটিতে নেয়া হলো। বাইরে সবাই অপেক্ষায়। তুই এলি তখন ছিলো সন্ধ্যা। ওইটুকুনি একটা গালটু-গুলটু শরীর, কিন্তু কি যে তোর সেই গলার স্বর! তারস্বরে চিৎকার। জানান দিলি, 'এলাম, এবার তুমি বুঝবে, মা হবার আনন্দ কতোটুকু আর কতোটা জ্বালা!' আমি এদিক-ওদিক চাইছি, দাদাও ছিলো ওটিতে। বললো এভাবে মাথা না নাড়াতে। অবশেষে তোকে ঘুম ঘুম চোখে দেখলাম, এই আমার সন্তান? আমার রক্ত? কে একজন জানি বললো, ছেলে হয়েছে। ছেলে নাকি মেয়ে আমি কিচ্ছু জানতে চাইনা, শুধু জানি তুই আমার সন্তান, আমার রক্ত, আমার আত্মজ। গুলটু আরোও অনেকদিন বাঁচতে চাই শুধু তোর জন্যে।

তোর মাম

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৫ মার্চ, ২০১৭ ইং।

শুভ জন্মদিন আমার গুলটু...
শুভ জন্মদিন আমার গুলটু...

0 Shares

৪৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ