পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। এর আয়তন প্রায় ২৫০০বর্গ কিলোমিটার। ১৯৪৭সালে দেশভাগের সময় এ আয়তনের দুই তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশের ভু-খণ্ডে আর এক অংশের মালিক ভারত। ১৯৪৭সালে বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাবার সময় বৃটিশ পার্লামেন্টের অধীনে ” সিরিল র্যাডক্লিফ ” নামের এই কর্মচারী মাত্র পাঁচ সপ্তাহের এক নোটিশে গোটা ভারত বর্ষকে কেটে দু ভাগ করে দেয়। কয়েকটি রেখায় টানে কেটে টুকরো করা হয়, সাধারণ মানুষের ভাগ্য ।
একটি রেখায় চাষি,ও সাধারণ মানুষকে তাদের বসত ভিটা চাষ জমি ফেলে পথে বেরিয়ে পড়ে নতুন আবাসের লক্ষে। কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষ তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে । নদী পথে ও স্থলপথে তারা সম্বলহীন অবস্থায় সুন্দরবন উপকূলে আগে থেকে বাস করা মানুষের সাথে এসে বাস করতে শুরু করে। দেশ ভাগের পরে পাকিস্তান সরকার এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে কোনো রকম সাহায্য সহযোগীতা করেনি । সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা তৎকালীন নেতা যোগেন মল্লিক দেশভাগের সময় ভারতের সাথে যেতে অপারগতা জানায় । তিনি আশা করেছিলেন পাকিস্তান সরকার তাকে সরকার পরিচালনার কাজে ক্ষমতা দেবে । কিন্তু ধর্মীয় বৈষম্য ও নিম্ন অঞ্চলের মানুষ বলে, পাকিস্তান সরকার তাকে কোনো রকম ক্ষমতা তো দূরের কথা সাহায্য সহযোগিতাই করেনি।
দেশ ভাগ হওয়াতে ভারত সরকার হতে পাওয়া রেশনের চাল আসাও বন্ধ হয়ে যায় । তাই সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের দুঃখ দুর্দশা চরমে পৌছায় । তাই তারা জীবনের তাগিদে সুন্দর বনের এই দ্বীপের ভিতরে এসে সুন্দর বনের বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর সাথে লড়াই করে জঙ্গল সাফ করে গোল পাতার ছাউনি দিয়ে ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করে। এই বন সংলগ্ন মানষের জীবন নানা বৈচিত্র্যময় । বন তাদের আগলে রেখেছে গভীর মমতায় , নানান সময়ে ঘূণিঝড় জলোচ্ছাস থেকে রক্ষা করেছে এই বন । সুন্দরবন ও সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের জীবন প্রণালী অন্য সব জনপদ থেকে আলাদা । আর এই ভিন্নতার কারণ হল তাদের জীবিকা । জলে কুমির চারদিকে নোনা জল ডাঙ্গায় বাঘ ও পরিবারের চরম দারিদ্র্যতা নিয়ে জীবন কাটে সুন্দরবন অঞ্চলের এক শ্রেণীর মানুষের । তারা জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ছোট ছোট খাল, গাছ,পাল, জীব জন্তুর, সাথে মিলে মিশে আছে । এদের সাথে গড়ে উঠেছে তাদের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক । কখনো অনিশ্চিত আতঙ্কে নিম্ন ও অতি নিম্ন বিত্তের একদল মানুষ জীবিকার সন্ধানে বাঁচার তাগিদে অলৌকিক শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করেছে । এ নিয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন উপকূলে অনেক লোক সংস্কৃতি। যেমন : বনবিবির পুঁথি,গাজি কালুর গীত ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য ।
বিচিত্র এই সুন্দরবনের বিচিত্র এই মানুষগুলি হাজার বিপদের মাঝে নোনাজল ও নোনা পলি মাটিতে হাবু ডুবু খেয়ে হিংস্র বন্য জীব ও সরীসৃপের সাথে জীবন মৃত্য লড়াই করে । প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা ও দৈত্য সম ঘূণিঝড়ের দাপটে সামান্য গোলপাতার ছাউনি ঘরে বুক চিতিয়ে এরা বেঁচে আছে । শুধু বেঁচে থাকা নয় তাগড়া চেহারা ও বলিষ্ঠ মন নিয়ে দিব্যি নিজের খাদ্য উপকরণ আহরণ করে নিচ্ছে এই বন থেকে এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে পৌছে দিচ্ছে । জঙ্গল কেটে আবাদি জমিতে পরিনত করেছে সমাজের এসব নিম্ন শ্রেণীর শক্ত পেশীর মানুষ গুলো কিন্তু তাদের নামে এসব ভূ-সম্পত্তি ছিলো না । সুন্দরবনের অথনৈতিক কাঠামোটি মুলত জীব বৈচিত্রর উপর নির্ভরশীল । এর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ গুলো এই অঞ্চলকে দিনে দিনে শিল্প সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছে ।
প্রথমতো তারা জীবন জীবিকার জন্য নিজস্ব পেশার কারনেই অল্প সংখ্যক মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বসবাস করা শুরু করে । সুন্দর বনের জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করে তারা বেছে নেয় তাদের পেশা। তাদের মৌয়াল কেউ বাওয়ালা কেউ, জেলে কেউবা চুনুরী। বর্তমানে সুন্দরবনে উপকূলে বাওয়াল মৌয়াল ও জেলেরা থাকলেও কালের বিবর্তনে এই জৈব উপায়ে তৈরী করা চুন প্রস্তুত কারী চুন শিল্পের এই চুনুরিরা আজ নেই। আমরা সুন্দরবনের সংলগ্ন অনেক মানুষ জানিই না, যে এক সময় সুন্দরবন এলাকায় চুন প্রস্তুতকারী চুনুরি জাতি বাস করত।
চলবে।।।।।।
২১টি মন্তব্য
মিষ্টি জিন
দক্ষিনান্চলের মেয়ে আমি। চুন যে ঝিনুক দিয়ে বানায় জানতাম। ছোট বেলায় দেখেছি আমাদের পাশের গ্রামেই চুন বানাতো একদল শ্রমিক। বিভিন্ন পুকুর থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে তারা চুন বানাতো।
পারফেক্ট ব্লগারদের মত লিখেছো আপু।
তোমার লেখায় মাটির গন্ধ আছে।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, মিষ্টি আপু। -{@ (3
আবু খায়ের আনিছ
দেশ ভাগের সময় শুধু দেশ ভাগ হয়নি, হয়েছে অনেক মানুষের স্বপ্ন ভাগ। যাক সে কথা বলে এখন আর লাভ নেই।
যেমনঃ বনবিবির পুঁথিপালা, গাজীকালুর গীত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ” এই লাইনটাতে যদি এগুলো নিয়ে লেখা আপনার পূর্ববতী লেখার লিংক দিয়ে দিতেন তাহলে মনে আরো ভালো হত, যারা সেগুলো সম্পর্কে জানেনা তারা জেনে যেত।
লিখতে থাকুন, জানার অনেক কিছুই বাকী আছে। সুন্দরবন দেখি নাই এখনো।
মৌনতা রিতু
এই লিংকই তো আমি দিতে পারি না।
কবে যে শুভ ব্লগিং শাখব ! ^:^
ধন্যবাদ ভাইটু।
আবু খায়ের আনিছ
বুঝতে পারলাম, জিসান ভাইকে বললে উনি দেখিয়ে দিতে পারবেন, বা অন্য কেউ যারা লিংক যোগ করে। আমিও পারতাম না তবে এখন পারি।
মৌনতা রিতু
জিসান ভাইয়া অসুস্থ। বলতেই তাই অস্বস্তি লাগে। দেখি শিখতে হবে। ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
দেশ ভাগটা সরাসরি জালিয়াতি আর কিছুই নই, বৃটিসদের মতবাদ ছিলো আমরা যাচ্ছি যখন তোরা মারামারি করে মর।
সুন্দরবন নিয়ে লেখাটা বেশ হয়েছে।
আপু কিছু কিছু বানান হয়ত অজান্তে ভুল হয়েছে, একটু দেখবেন, যদিও আমারও বেশ ভুল হয়। :p
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, ভাইজু। খেয়াল রাখব। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
ঝিনুক দিয়ে চুণ বানানো হয় এটা আমি জেনেছিলাম মামনির থেকে। মামনি বরিশালের মেয়ে।
লিখে চলো শান্ত-সুন্দরী। ইতিহাসকে এতো সহজ করে তুলে ধরছো বলেই পড়ছি। ইতিহাস আমার কাছে ভয়ঙ্কর লাগতো।
আমার মামনিও কিন্তু ইতিহাসের ছাত্রী। 😀
মৌনতা রিতু
তাইলে তো খালাম্মা আমকর প্রতিবেশী। মোংলার বাগেরহাটের আমি।
এই পর্বতে তোমাকে শিখাব কেমন করে চুন বানাতে হয়। 🙂
গুরুকে শিখাবে শিষ্য :D) :D)
নীলাঞ্জনা নীলা
এই আমি মংলা, বাগেরহাট গিয়েছি। এমনকি সুন্দরবনেও। 😀
গুরু খুশী হয়, যখন শিষ্য গুরুকে শেখায়। :p 😀
ব্লগার সজীব
সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল মানুষদের পেশা সম্পর্কে আপনার লেখার প্রথম অংশ পড়লাম আপু। আপনি যে প্রচুর পড়াশুনা করেন, এই লেখা তার প্রমান। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
কেমন আছেন আপু?
মৌনতা রিতু
আমি ভাল নেই। রেগে আছি :@। একটা খবর নেয় না , এই ছোট ছোট ভাইগুলো। মরলাম না বেঁচে আছি , দেখেই না। কেন ভাই ? কি অপরাধ করছি কও তো দেহি ? কেন এই মুখ ফেরানো ?
ব্লগার সজীব
আপু খুব মিস করি সবাইকে। রুটি রুজির পিছনে ছুটছি, তাই কিছুটা অনিয়মিত। নিয়মিত হচ্ছি। দোয়া করবেন প্রিয় আপু।
ছাইরাছ হেলাল
অনেক পড়েছেন বলেই আমরাও বেশ অনেক কিছুই জানতে পারছি,
তবে শামুক পোড়ান দুর্গন্ধ কিন্তু মারাত্মক!
মৌনতা রিতু
হুম তাতো সামান্য একটু গন্ধ থাকবেই। তবে অনেকে যারা শামুকের ভিতরের শ্বষমূলটা বের করতে পারে না, তখনই গন্ধটা হয়। তবে ঝিনুকে গন্ধ হয় না। আমি কিন্তু নানির সাথে ছোটবেলায় পোড়াইছি। স্পষ্ট মনে আছে। গন্ধ কিন্তু তেমন পাইনি।
পড়াই নেশা, ভাই , পান খাইনা, সিগারেট খাইনা, পার্লারে গিয়ে পার্লারের পিন্ডি চটকাইনা, একটু এই বই এরই নেশা। গতপরশু কিছু বই গিফট পেয়েছি \|/ উনি ঢাকা থেকে এনে দিলেন। 🙂
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আপনার প্রতিটি লেখাতেই দেশপ্রেমের এক আবেগী ছন্দ দেখতে পাই।এই লেখাটাও সেই ক্ষোভ থেকেই মনে হচ্ছে।আমাদের এখানে চুনের কারখানা আছে যেখানে প্রতিনিয় গ্যাস ব্যাবহার করে পাথরগুলোকে গলিয়ে চুন তৈরী করছেন।তবে এ চুন খাওয়া যায় না বিল্ডিংয়ে রংয়ের কাজে ব্যাবহার হয়।সম্ভবত ঝিনুক বা শামুখ হতে বিশেষ পদ্ধতিতে খাবারের চুন তৈরী হয়।সুন্দর পোষ্ট -{@
মৌনতা রিতু
বর্তমানে মানুষ ঐ পাথুরে চুনই খাচ্ছে।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। পরের পর্ব পড়ুন। অনেক মূল্যবান তথ্য পাবেন আশা করি।
অনিকেত নন্দিনী
মানুষ সাধারণত আগে পোস্ট পড়ে, পরে মন্তব্যে যায়। আমি আগে মন্তব্য পড়লাম, পরে পোস্ট পড়লাম। 😀
ছোটবেলায় দেখতাম নানু পান খাওয়ার জন্য পাথুরে চুন কিনিয়ে আনাতেন। ছোট্ট একদলা জমাট সিমেন্টের মত বস্তু বড় একটা পাত্রে পানি ভরে চুবিয়ে রাখতেন। কয়েক ঘন্টা পর দেখতাম ঐ একটুখানি বস্তু ফুলেফেঁপে পাত্রের সবটুকু জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখন সবখানেই ঝিনুক চুনের ছড়াছড়ি, পাথুরে চুন চোখে পড়েনা।
কিছু লেখা লিখতে গেলে প্রচুর পড়তে হয়। এই লেখাটি লিখতে গিয়েও বেশ পড়াশুনো করতে হয়েছে তা বুঝতে পারছি। 🙂
মৌনতা রিতু
না, আপু, ঝিনুকের চুনই কমে গেছে। আমি এক দাদার কথাতেই এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে, এর উপড় পড়ার পাশাপাশি ঐসব যায়গাতে যেতেও হয়েছে। তাদের বক্তব্যও রেকর্ড করতে হয়েছে। আসলে এটা একটা বিদেশী পত্রিকার জন্য লেখা হইছিল। যাইহোক আপু, পাথুরে চুনই এখন বেশী। কারন পাথুরে চুনই সহজলভ্য ও দাম কম। ঝিনুকের তৈরি চুন স্বাদ একটু মিষ্টি মিষ্টি কিন্তু দামও বেশী। কারন এর প্রস্তুত প্রনালীতেই খরচ বেশী। পরের পর্বে দেখতে পাবে।
সব পর্ব পড়বা কিন্তু। :p নাইলে কাট্টিস।
অনিকেত নন্দিনী
পরের পর্ব পইড়া মন্তব্য দেয়াও সারা। লেট্টুস, অহনো মন্তব্য পড়ে নাই। :p