তীর্থর জন্য ওর অপু মেশোর ছড়া্‌...
তীর্থর জন্য ওর অপু মেশোর ছড়া্‌…

সময় একটি বিরাট প্রশ্ন এবং সময়ই তার উত্তর। এইতো সেদিন ২০০২ সালের ১৫ মার্চ তারিখে সন্ধ্যা ৬ঃ৪০ মিনিটে আমারই নতূন এক রূপের জন্ম হয়েছিলো। নারী রূপের অনন্যতম পরিচয় “মা”, এই পরিচয়ে পরিচিত হয়েছিলাম। দেখতে দেখতে চৌদ্দটি বছর পার হয়ে গেলো। আজ বলবো ও কাকে কাকে বেশী জ্বালিয়েছে।

তীর্থর জন্ম মৌলভীবাজার শহরে লেইক ভিউ হাসপাতালে। আর সে-ই প্রথম বেবি। নার্সিং হোমটা প্রয়াত বড়ো দাদা ডাঃ অভিজিৎ রায়ের ছিলো। আমার বড়ো বৌদি প্রথমে কোলে নেয়, তারপর সকলে। প্রথম জ্বালিয়েছে নার্স নমিতাকে। এমনও হয়েছে ডিউটি না থাকলেও এসে তীর্থর কান্না থামাতো। একমাত্র সে-ই পারতো ওকে শান্ত করতে। আমার বড়ো মামী যাকে তীর্থ বড়ো বৌদি বলে ডাকে, তারপর ছোট মাসী শিখা(তীর্থর ছোটদিদি)কে কম জ্বালায়নি। অনেক ভোরে উঠে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে কতো রকমের যে রেওয়াজ করতো। আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়তো। ওসব শব্দ শুনে আমার ছোট মাসী এসে ইশারা করতো চুপ থাকতে। সাথে সাথে ওটাও আঙুল ঠোঁটে নিয়ে “সসসসসসস” মানে চুপ থাকার ওই ভঙ্গী নকল করতো। আর বড়ো মামীর কোলে উঠে স্নান করা, ফটিক ভাইয়ার(আমার বড়ো মামা তীর্থকে ডাকতো এই ফটকা। এমনই হলো মামার নাম হয়ে গেলো ফটিক)বাইসাইকেলে ওঠার জন্যে তারস্বরে রাগসঙ্গীত গাওয়া। ভালো করেই জানতো তীর্থর দিদিমনি(আমার মামনি) কখন স্কুলে যাবে, ঠিক সেই সময় কোলে ওঠার বায়না। যে ছেলেকে কোলে নিতে চাইলেও কারো কোলেই চড়তে চাইতো না, তার রাজনৈতিক বুদ্ধি তখনই সে প্রয়োগ করতো। এই ছেলের জন্মের পর মামনির চাকরী জীবনে যে কতোদিন স্কুলে যেতে দেরী হয়েছে। তারপর থেকে লুকিয়ে যেতে হতো। সময়জ্ঞান বেশ ভালো ছিলো। কখন ওর দিদিমনি আসবে, সেই সময় ওকে বারান্দায় নিয়ে যেতেই হতো। আর অবাক ব্যাপার হলো ঘুমে থাকলেও উঠে পড়তো। ওর হুকুমের আরেক দাস হলো আমার বাপি, ওর ভাইয়া। তীর্থ যে দুজনের বকা সবচেয়ে খেয়েছে, একজন হলাম আমি, আরেকজন ওর ভাইয়া। বাপি কিসে কিসে খেপে যায়, সে ভালো করেই জানতো। সেই তখন থেকেই শিখে গিয়েছিলো কাকে কি দিয়ে রাগানো কিংবা ভ্যাঙচি কাটা যায়। তীর্থ রাতের বেলা জ্বালাতো খুব, আমায় ঘুমাতে দিতো না। সেই সময় বাপি-ই ছুটে আসতো।এমনও হয়েছে সারারাত ও ওর ভাইয়ার কোলে, আর বাপিও না ঘুমিয়েই সকালে অফিস গিয়েছে। আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তীর্থর মৌমাছি(আমার ছোট বোন মৌ, তীর্থ মজা করে ডাকে মৌমাছি), ওর কান্না নিতে পারতোনা।আমার উপর খুব রাগ “তোমার চাকরী আগে নাকি তীর্থ?” কারণ তীর্থর খাওয়া-স্নান-ঘুম পাড়ানো অনেক কিছুই মৌ করতো।

এই দুষ্টু-পাজি ছেলেটাকে কোলে নেয়ার জন্যে বেশ লাইন ছিলো। বিশেষ করে আদরের বোন রূপা। পাশের বাসার সিকদার আঙ্কেলের মেয়ে। ঘুম থেকে উঠেই আমাদের বাসায় দৌঁড়। এই পিচ্চিটাও এখন কত্তো বড়ো হয়ে গেছে!লাউয়ের উপর কদু বলতো মৌ, যখন রূপা কোলে নিতো তীর্থকে। আরোও ছিলো আমার মামাতো ভাই প্রিতম-প্রিয়ম।শমশেরনগর চা’ বাগান মাঠের অনেকেই ওকে কোলে নিতে চাইতো। কাজল(আমায় দিদি ডাকতো,আজ ও পৃথিবীতে নেই)নামের একটা ছেলে ছিলো,তীর্থকে খুব কোলে নিতে চাইতো। কেন যে যেতেই চাইতো না। আরোও ছিলো মানিক(সিকদার আঙ্কেলের ছেলে)-সুমন(কুমকুম আপার ভাই)। ছুটে আসতো ভাগ্নেকে কোলে নেয়ার জন্যে।সবাইকেই ভালো জ্বালিয়েছে। আর সবচেয়ে বেশী যাকে জ্বালিয়েছে, সে হলাম আমি। তবে বর্তমানে যাকে সবথেকে জ্বালায় সে হলো ওর বাবা। জীবনের বেশীরভাগ সময় ওর বাবাকে খুব কম পেয়েছে। আর তাই কিনা জানিনা,জ্বালানোর মাত্রাও খুব বেশী। বাসায় কাজ করতো সাধু বুড়া, ভারতী, ক্ষিরোদ, ডালা কি জ্বালানোই না জ্বালিয়েছে। আরোও অনেকের কথা বলা হয়নি, বলতে গেলে বিশাল বড়ো হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে সেই মানুষগুলোর কথা এখনও আছে।

ছোটদিদির কোলে জন্মের পর পর...
ছোটদিদির কোলে জন্মের পর পর…
প্রথম দিন ওর বড়ো বৌদির কোলে...
প্রথম দিন ওর বড়ো বৌদির কোলে…
ওর বড়ো মামীর সাথে...জন্মের পর প্রথম পাওয়া কোল...
ওর বড়ো মামীর সাথে…জন্মের পর প্রথম পাওয়া কোল…
তীর্থ ওর অপু মেশো-রানা মামার সাথে
তীর্থ ওর অপু মেশো-রানা মামার সাথে
তীর্থর মৌমাছি(মৌ মাসী)...
তীর্থর মৌমাছি(মৌ মাসী)…
বোন রাইয়ের সাথে...
বোন রাইয়ের সাথে…
তীর্থর সাথে ওর অর্ঘ্য দাদা, ছোট ভাই আগ্নিক, বোন রাই...
তীর্থর সাথে ওর অর্ঘ্য দাদা, ছোট ভাই আগ্নিক, বোন রাই…

এই গুলটুটা আমার গান না শোনালে চোখের পাতা বন্ধ করতো না।আর যেই-সেই গান না।“চন্দ্র যে তুই, মোর সূর্য যে তুই” উফ কতোবার যে আমার এই ভাঙা গলায় রিওয়াইন্ড করেছি। এখন সে নিজেই গান করে, আর তা-ও বিরক্তিকর র‍্যাপগান  যে কিনা একসময় আমার বুড়োর গান গাইতো, সে করে র‍্যাপ। মাথা গরম হয়ে যায় আমার। তাও ভাবি ওর বয়সে আমারও অনেক কিছু পছন্দে সায় দিতো মামনি-বাপি, তাদের অপছন্দ সত্ত্বেও। তাই কিছু বলিনা। মাঝে-মধ্যে কি-বোর্ড বাজায়। প্রচন্ড রকম আবেগ ওর বাস্কেটবলের প্রতি। জীবনের লক্ষ্য সে একদিন ম্যাঙ্গা আর্টিস্ট হবে।এই ছেলে আজকাল একটু পর পর আসে ওর হেয়ার স্টাইল বদলে। “মাম এই স্টাইল পছন্দ হয়?” জিজ্ঞাসা করি গার্লফ্রেন্ড হলো? কিন্তু ওর ক্লাশের কাউকে নাকি পছন্দ হয়না। যার সাথে ওর সব কথা শেয়ার করে, ওর বোন কাঁকন দিদিভাই আর ভাই আকাশ দাদামনিকে। যার কথা জিজ্ঞাসা করে প্রায়ই, সে হলো ওর বোন রাই, তীর্থর রানা মামার মেয়ে। দিদিমনির সাথে বেশ গল্প হয়,আর তখন হাসিটুকু বেশ চরমেই থাকে। মায়ের হাসি এবং কথা বলা পায়নি, হিসেব করে হাসি এবং কথা খরচ করে। পছন্দের তালিকায় আছে ওর রানা মামা আর অপু মেশো(ছোটবেলায় ডাকতো অপুকাপু, মৌমাছির বর)। অপু প্রতিবছর তীর্থকে নিয়ে ছড়া লিখবেই। তীর্থর জন্মদিনের এক যুগ বয়স পূর্তিতে অপুর লেখা ছড়াটা দিলাম।

তীর্থ ১২তে……দেবব্রত রায়

তীর্থসোনার আজকে দিনে
বয়েস হলো বারো
এখন সে যে অনেক বড়ো
ধার ধারে না কারো!
যত্ন নিজের যেটুক লাগে
নিজেই নিতে পারে
লক্ষ্মী ছেলে এই কারণেই
সবাই বলে তারে।
খেলার সময় খেলতে যাবে,
পড়ার সময় পড়ে –
এমন ছেলে হয় যেন আজ
সবার ঘরে ঘরে! (১৬.০৩.১৪ ইং)

বন্ধুরা সবাই আমার ছেলেকে আশীর্বাদ করুন, যেনো ও বড়ো মনের মানুষ হয়। সুশিক্ষিতর সার্টিফিকেটের পাশাপাশি স্বশিক্ষিতও যেনো হয়। আজ পনেরোই মার্চ, নভোনীলের চৌদ্দতম জন্মদিনে সবার কাছে এমনই কামনা। ওর জন্মের প্রথম দিনের ছবি থেকে বর্তমানের ছবি দিয়ে একটি ভিডিও তৈরী করেছি। আশা করি সবার ভালো লাগবে। সেলফোন দিয়ে এডিট করা দ্বিতীয় ভিডিও আমার এটি।

অনেক অনেক আদর সোনা। বড়ো মনের মানুষ হ। শুভ জন্মদিন তীর্থ।

তীর্থর অপু মেশোর পক্ষ থেকে...
তীর্থর অপু মেশোর পক্ষ থেকে…
ভাইয়া-দিদিমনির সাথে...
ভাইয়া-দিদিমনির সাথে…
তীর্থর মামনি(আমার বন্ধু ঊর্মীর) সাথে...
তীর্থর মামনি(আমার বন্ধু ঊর্মীর) সাথে...
দিদিভাই-দাদামনির সাথে...
দিদিভাই-দাদামনির সাথে…

 

বাবার সাথে...
বাবার সাথে…

 


হ্যামিল্টন, কানাডা
১৫ মার্চ, ২০১৬ ইং।

**লেখাটি লিখেছি ওর একেবারে শৈশব, শমশেরনগর চা’ বাগান বাসের সময়ের উপর ভিত্তি করে। সেই ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাগানে ওর দিদিমনি-ভাইয়ার কাছে থাকার সময়টুকুই তুলে এনেছি এই লেখাতে।

২৪২২জন ২৪০৯জন
0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ