আমি রাজধানী ছেড়েছি অনেক বছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছিলাম একটা ভালো চাকরি করবো এই আশায়। যৎসামান্য হলেও আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে সাহায্য করতে পারবো, পরিবারের জন্য দেশের মানুষের জন্য আব্বার কাছ থেকে নেয়া কিছু আদর্শ ধারণ করে নিজের জীবন সৎভাবে পরিচালনা করবো সে আশার দিন কাটিয়েছি দীর্ঘদিন।

ছাত্রাবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদের মুখে পুরো জীবনটাই ধ্বংস হয়েছে আমার। বিএনপি জামাত জোট সরকারের সময় জামাত-শিবিরের ছত্রছায়ায় থাকা তাদের কিছু ক্যাডারদের দেয়া নিয়মকানুন এবং তাদের নিয়মিত সভায় উপস্থিত হবার হকুম না মানায় এক রাত্রিতে সদলবলে আমার উপর হামলা চালায় তারা। তাদের গোপন কুঠুরিতে ডেকে নিয়ে সারারাত আমার উপর অত্যাচার চালিয়েছে। আমার পায়ের নখ তুলে ফেলেছিলো কারন সে পা দিয়ে তৎক্ষণাৎ আমি একজনকে লাথি মেরেছিলাম। আমাকে চেয়ারে হাত পা বেঁধে রেখে চোখের সামনে রাম দা শান দিতে দেখেছি আমার হাত পা বিচ্ছিন্ন করে দেবে বলে।

অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালীন অবস্থায়ও আমাকের দেয়া অকালকুষ্মাণ্ডদের জীবননাশের হুমকীর মুখে আমার জীবন যখন বিপন্ন তখন আব্বা গোপনে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পরেই আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যান। পড়াশুনা শেষ করার জন্য আমি আর ঢাকায় ফিরে যেতে পারিনি। আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। এরপরে আমার পরিবার এবং মা'র অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমি আবারো জীবনের জটিল অংকগুলোর জট খুলতে থাকি। অন্যপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে পড়াশুনা শেষ করি।

নতুন উদ্যমে শুরু করি চাকরি খোঁজা। যেহেতু ঢাকায় যেতে পারছিনা তাই নিজের জেলা শহরেই চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আমার নাকাল অবস্থা হয়েছে। এসবই অবশ্য বিবাহিত জীবনের আগের কথা। জীবনে চাওয়া ছিলো আমার যেন এমন কোন চাকরি না হয় যেখানে ঘুষ দিতে হবে, অনিচ্ছায় হলেও রোষানলে পড়ে আমাকেও ঘুষ খেতে হবে এবং তাই হয়েছে। একবারই সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি এবং সেটাতেই সফল হয়েছি। আমি যেদিন চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছিলাম সেদিনই আমার সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমাও শেষ হয়ে গিয়েছিল।

২০১৩ সালে রাজাকারের ফাঁসির দাবি নিয়ে শাহাবাগে সবার সাথে আমিও একাত্মতা ঘোষণা করতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। নিজের হাতে আলবদরদের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। সে এক অনন্য অসাধারণ অনুভূতি। এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে নিজের আদর্শিক দ্বন্দের ফলে মাঝেমধ্যেই স্পর্শকাতর হয়ে যাই আমি। তখন পাশে থেকে আমার হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলার উৎসাহ দেন আমার সহধর্মিণী। আমাকে শান্ত করে। তা না হলে সে কবেই যে কি সর্বনাশ হয়ে যেতো আমার কে জানে!

অন্ধকার সেই রাতের নির্মম অত্যাচারে ভয় আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। শুধুমাত্র মুজিব আদর্শের রাজনীতি করার জন্য আব্বাকে চারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। আমারও খুব ইচ্ছে হয় আপনাদের মত আমিও ফেসবুকে চিৎকার করে অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো। চোর বাটপার লুটেরাদের গলা টিপে ধরবো। কিন্তু শুধুমাত্র এদেশের এক অন্ধগলির মরা ঘুপচিতে বাস করি বলে ইচ্ছে থাকা সত্বেও প্রতিবাদ করতে পারিনা কারন আমার হাত-পা অদৃশ্য এক শেকলে বাধা। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার দিকটিও মাথায় রাখতে হয়।

আমার সহজাত আদর্শিক বিবেক প্রায় প্রতিদিনই একবার করে আমাকে নাড়া দিয়ে যায়। এদেশের স্বাধীনতাকে যারা স্বীকার করেনা, মুক্তিযুদ্ধ যাদের কাছে শুধুমাত্র গণ্ডগোল, মৌলবাদী আদর্শে যারা এখনো বিশ্বাস করে পাকিস্তানই তাদের দেশ এসব শুনলে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনা। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে যখন কেউ নিষেধ করে রাগে শরীর কাঁপতে থাকে আমার। প্রিয়জনের মুখগুলি মনে ভেসে ওঠে, আমি আর কিছুই করতে পারিনা।

অনেক বছর আগে আমার সাথে ঘটে যাওয়া বদ্ধ ঘরের সেসব অত্যাচারের কথাগুলো হুট করে মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণকারী আপনারা সকলেই আমার প্রিয়জন। আপনার সবার সাথে নিজেকে এককাতারে দেখতে সত্যিই ভালোলাগে আমার। সবাই ভালো থাকুন। ব্লগের সকল সদস্য মিলেমিশে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাই চলুন। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনা নিপাত যাক। আমিও পাশে আছি।

ভালোবাসি বাংলাদেশ।

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

  • সুপর্ণা ফাল্গুনী

    ভাইয়া সমস্ত লেখাটা পড়ে শিহরিত হলাম । কি মানসিক যণ্ত্রণার মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতে হয়। স্বাধীনভাবে কোথাও যেতে পারেন না। গৃহবন্দীর মতো অবস্থা। এইসব কুলাঙ্গার এর বংশ বিস্তার কবে যে শেষ হবে? সাবধানে থাকবেন, মাথা গরম করা যাবেনা। শুভ কামনা রইলো

  • প্রদীপ চক্রবর্তী

    লেখাটা পড়েই আবেগাপ্লুত হলাম দাদা ।
    সত্যিকারের মুজিব আদর্শ বুকে ধারণ করেছেন বলে অন্যায়কে প্রশয় দিতে চান নি।
    তারমধ্য আপনার বাবা একজন সমরের যোদ্ধা।
    যাঁরা দিনভর না খেয়ে না ঘুমিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশটাকে স্বাধীন করেছেন।
    সাম্প্রদায়িক শক্তি একে একে রুখে দাঁড়াতে চায়।
    কিন্তু তার কোমর ভেঙ্গে দিতে গিয়ে নানা নির্যাতন ও ভয়ংকর পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছে।
    .
    মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালনকরা সোনেলার সকলেই আমার প্রিয়জন। আপনার সবার সাথে নিজেকে এককাতারে দেখতে সত্যিই ভালোলাগে আমার। সবাই ভালো থাকুন। ব্লগের সকল সদস্য মিলেমিশে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলুন। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনা নিপাত যাক। আমিও পাশে আছি।

    ভালোবাসি বাংলাদেশ।
    হ্যাঁ এটাই আমাদের শপথ হোক।
    আমরা কালোহাত রুখে দিতে প্রস্তুত হই।
    .
    শুভকামনা দাদা।
    ভালো থাকুন অনেক…..

  • ইঞ্জা

    প্রথমে শিউরে উঠলাম, পরবর্তীতে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা মনে পড়ায় নিজেকে সংযত করে নিয়েছি, বুর্জোয়া দালালরা এখনো তাদের নখদন্ত বের করে রেখেছে, মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সরকার থাকার পরও জারজরা এখনো খামছে ধরে আছে আমাদের প্রিয় পতাকা, আমি আশা করবো এই সরকার এদেরকে সমূলে উৎপাটন করবে, একদিন এই দেশ জারজ মুক্ত নিশ্চয় হবে ভাই।
    স্যালুট আপনাকে।

  • ছাইরাছ হেলাল

    আমাদের এগিয়ে যাওয়ার এগিয়ে থাকার পথচলা কী এক অদৃশ্য কারণে বারে বারে হোচট খাচ্ছে ।
    স্বাধীনতার এত বছর পর যে শিখরে পৌঁছানোর কথা ছিলো সেখানে পৌঁছুতে পারিনি বলেই কেন যেন মনে হয়।
    তবুও আশা রাখি আমরা সমৃদ্ধির পথেই থাকবো।
    আপনার ব্যক্তিগত দিক টি জেনে দুঃখিত হচ্ছি। কত কিছুই না আমাদের জীবনে পার হয়ে আসতে হয়েছে।
    ভাল থাকবেন।

  • নিতাই বাবু

    ২০০১সালে যখন বাংলার বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তখন আমি এলাকায় থাকা একটা টেক্সটাইল মিলে চাকরি করি। পাশাপাশি নিজের গড়া একটা সমিতি পরিচালনা করি। সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায়ই হাজারখানেক। প্রতি শুক্রবার ছিল সঞ্চয় ও ঋণ আদায়ের দিন। প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে রাত ১০/১১টা অবধি সমিতির অফিসেই আমাকে থাকতে হতো। অনেক টাকার লেনদেনের সমিতি হওয়ায় সেসময় এলাকার কিছু বিএনপির ছেলে পেলে আমার পেছনে লেগে যায়। উদ্দেশ্য মোটা অংকের টাকা দিতে হবে, নাহয় এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। আমি তা দিতে নারাজ। বিনিময়ে পেলাম হুমকিধামকি লাথিগুতা আর ভয়ভীতি। তারপরও মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তাঁদের কিছুই দিতে হয়নি। বরং ধারদেনা করে সমিতির সকল সদস্যদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে হয়েছে। সুন্দর সমিতিটা একমাসের মধ্যে জলাঞ্জলি দিয়ে মনের দুঃখে চাকরি ছড়ে অন্যত্র চলে যাই, স্বইচ্ছায়। সেই দিনগুলো এখন আর নেই ঠিক, কিন্তু যাঁরা আমাকে সেসময় হুমকিধামকি দিয়েছিল; তাঁরাই হয়েছে লাপাত্তা। তাই এখন আমি ওঁদের দেখলে মনে মনে ভাবি, আমি তোঁদের কাছে হেরে যাইনি। তোঁরাই আমার কাছে হেরে গছিয়েছিস।
    আপনিও হারবেন না দাদা। ওইসব কুলাঙ্গারেরাই একদিন আপনার কাছে পরাজয় বরণ করবে। আর আমাদের সংগ্রাম চলবেই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনার বিরুদ্ধে।

  • সুপায়ন বড়ুয়া

    কি বলব আমাদের মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের অহংকার তৌহিদ ভাই আপনার বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনার প্রতি সহানুভুতি জানানোর ভাষা আমার জানা নাই।
    লাখ লাখ টগবগে তরুণের জীবন বিপন্ন হয়েছে জামাত বিনপি শিবিরের রোষানলে পরে। কতজন জন পঙ্গু ও শাহদাত বরন করেছে তা হিসেব নাই যেখানে আমাদের নেতৃর জীবন বিপন্ন পদে পদে।
    শিবিরের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়েছি ছাত্রজীবনে। তাদের অত্যাচারের আমরা জলন্ত সাক্ষী।
    কি সৌভাগ্য আমার শিবিরের ক্যাম্পাস বিতারিত সেক্রেটারিকে পরীক্ষায় আমার লেখা দেখিয়ে পাশ করার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। যে কিনা আমাকে টিচারের সামনে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিল।
    তবু ও শুনতে হয় এই বাংলায় ডান্ডির পোলা তোদের জায়গা নেই এই বাংলায় সর্বত্র।
    ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।

  • মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী

    আপনার লেখাটা মনকে ব্যথিত করেছে। আপনার সুরে বলি — “আজ ১৭ বছর আগে আমার সাথে ঘটে যাওয়া বদ্ধ ঘরের সেসব অত্যাচার কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালনকরা সোনেলার সকলেই আমার প্রিয়জন। আপনার সবার সাথে নিজেকে এককাতারে দেখতে সত্যিই ভালোলাগে আমার। সবাই ভালো থাকুন। ব্লগের সকল সদস্য মিলেমিশে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলুন। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী চেতনা নিপাত যাক। আমিও পাশে আছি”।
    ভালো থাকবেন ভাই। শুভ কামনা রইলো ।

    ভালোবাসি বাংলাদেশ।

  • জিসান শা ইকরাম

    আপনার উপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অমানুষিক নির্যাতনের কথা জেনে আৎকে উঠলাম ভাই। মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান হওয়ায় আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি দেখে গর্ব হচ্ছে আপনাকে নিয়ে।

    সমস্ত সরকারী চাকুরী গুলোতে আপনার মত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান নিয়োগ পেলে দেশ পালটে যেত।

    মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত শক্ত ভাবেই নিতে হবে। তারা যেন আর মাথা তুলে দাড়াতে না পারে এজন্য আমাদের সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে।

    এমন পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
    শুভ কামনা।

    • তৌহিদ

      এসব ঘটনা মনকে অস্থির করে তোলে আমাকে। এই অপশক্তি স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই বিরোধিতা করে আসছে। আমার জীবনের এসব কথা কখনো লিখতে চাইনি ভাই। কিন্তু আজ হঠাতই বেদনাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা রাজনীতি করার জন্য ভয়ানক সব বিপদ অনেকবারই নেমে এসেছে আমাদের পরিবারে। এসব বলে নিজেকে কিছুটা হালকা লাগছে ভাই।

      আমার চাকরিজীবনকে সজ্ঞানে আমি কলুষমুক্ত রেখেছি। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে সবসময়ই আমাকে একটা তাড়না দেয়।

      এদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলেরই সচেতন হতে হবে। অসুস্থতা নিয়েও এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।

      শুভকামনা জানবেন।

  • সাবিনা ইয়াসমিন

    প্রতিবাদ আর আদর্শ যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে, তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেন না। একজন মানুষের সবচেয়ে দূর্বলতা তার পরিবার-প্রিয়জন। কিন্তু যখনই কোনো অন্যায় আর অপশক্তির দেখা মেলে, তখন আদর্শের জয় হয়। নির্ভীক ব্যক্তিরা পরিবারের খাতিরে সাময়িক স্থির থাকলেও চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারে না। নিজেকে প্রকাশ করেছেন বলেই আপনার লেখায় আজ অজানা এক তৌহিদ ভাইকে জানতে পেলাম।
    আপনার মতাদর্শের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।
    ভালো থাকুন,
    শুভ কামনা 🌹🌹

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ