১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই লেখায় রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটি এ বিষয়গুলি সামনে চলে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির এ দলগুলি তৎকালীন সময়ে থেকে অদ্যবধি নামে-বেনামে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে মেনে নেয়নি নিতে পারেনি। যে কারণেই ১৯৭১ সালের মহান বিজয়ের পরেও তারা আমাদের আড়ালে-আবডালে পিছন থেকে আঘাত হানছে বারবার। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষ এই শক্তি দেশ স্বাধীন হবার পরবর্তীকালীন সময়েও আমাদেরই ছত্রছায়ায় কেউ কেউ পালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছে। কেউ নামধাম পরিচয় গোপন রেখে ভিন্ন নাম এবং পরিচয়ে এদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে মিশে গিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাদেরকে কেউ আবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভূক্ত করতে সক্ষমও হয়েছে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দেশের পরমপ্রিয় মুক্তিযোদ্ধা এবং ঘৃণিত রাজাকারদের সঠিক তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয় যা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু এই তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে যে ম্যাসাকার অবস্থা তৈরি হয়েছে তার দায়ভার আসলে কাদের উপরে বর্তায় সেটাই এখন প্রশ্ন?

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই প্রকৃয়ায় একদিকে যেমন অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট, সনদপত্র থাকার পরেও বাদ পড়ছেন তেমনি অনেকেই একই নামে বিভিন্ন তালিকা থেকে বিভিন্ন সুবিধাদি ভোগ করছেন যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু জায়গায় শুধুমাত্র ব্যক্তিগত রেষারেষি থেকেই এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং হচ্ছে যা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের কাজে অনেকটাই স্থবিরতা চলে এসেছে।

অন্যদিকে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় চরম লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করেছে। গত ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রথম ধাপে রাজাকারসহ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ১৯৭১ সালে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং পাকিস্তান সরকারের নিয়োগের পুরনো নথিতে এরা তালিকাভুক্ত ছিল। এদের মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ এবং লুন্ঠনের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে অনেকের নাম আছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হওয়া না হওয়া নিয়ে এই তালিকার কোন সম্পর্ক নেই। তবে রাজাকার প্রকাশিত এই তালিকাটিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে বলেই এত সমালোচনার সম্মুখীন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে এই তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের দিয়েছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে তাদের কাছ থেকে যে নথি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়েছে তা রাজাকারদের নয়। বরং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দালাল বলে চিহ্নিত করে বিভিন্ন মামলায় যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেই তালিকাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করা হয়েছে। এই তালিকায় অনেকেরই নাম পরবর্তীতে মামলা থেকে খারিজ করা হয় বলে সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তাদের নামের পাশে সংক্ষিপ্ত নোট দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সেগুলো যাচাই-বাছাই না করেই প্রকাশ করেছে।

রাজাকারদের প্রকাশিত এই তালিকায় নাম এসেছে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যদের এবং মুক্তিযুদ্ধের অনেক সংগঠকদের। যার ফলে তালিকাটি প্রকাশিত হবার পরপরই বিতর্কিত হয়ে পড়ে। তালিকা প্রকাশের পর গোটা দেশে তীব্র নিন্দা জানিয়ে অনেকেই নিজের মতামত দিচ্ছেন। অবাক করার মতো বিষয়, রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম কি করে অন্তর্ভুক্ত হয়! এটা ভেবেই সবাই আশ্চর্যান্বিত। গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের অনেক জেলায় বিভিন্ন ব্যক্তি,সংগঠন থেকে শুরু করে সকলেই এই বিতর্কিত তালিকার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন প্রতিবাদ জানান। এই লেজেগোবরে অবস্থার জন্য এখন দুই মন্ত্রণালয়ই অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় একে অন্যকে দোষ চাপাচ্ছেন। যার ফলে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ছেন দ্বিধান্বিত।

রাজাকারদের প্রকাশিত তালিকাটি নাকি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তৈরিকৃত। তাহলে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের নাম কি করে অন্তর্ভুক্ত হলো? সরকার বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে বিতর্কিত এই তালিকাটি যাচাই-বাছাই না করে এতো তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করার পেছনে অন্য কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এটা কি নিজেদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য নাকি অন্য কোন কারণে? যদি প্রকাশ করাই হলো তাহলে যাচাই বাছাই করা হলো না কেন? রাজাকারদের তালিকায় কারা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করলো তাদের উদ্দেশ্য কি এই বিষয়টি এখন সবার মনে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে? তবে যারা বিতর্কিত করতে চেয়েছে তাদের উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও যে সফল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

রাজাকারদের তালিকা নিয়ে এই যে লেজেগোবরে অবস্থা এর পেছনে একটি কারন হচ্ছে, সেই স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি যারা সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করে অত্যন্ত সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের নাম রাজাকারদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিয়েছে। অনেককেই রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধীদের ফাঁসির রায় কার্যকরে যারা আঘাত পেয়েছে তারাই এই ঘৃণ্যতম কর্মটি করে নিজেদের কিছুটা হলেও সফল করেছে।

এর অন্যতম আর একটি কারণ হচ্ছে, যারা এই তালিকা তৈরি কাজটি করছেন তারা কতখানি আন্তরিকতা নিয়ে কাজটি করছেন সেটি। তারা কি আসলে জানেন এর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কি এবং কিসের জন্য করছেন? কখনো কখনো লোকরঞ্জনের রাজনীতি অর্থাৎ একটি সময় সরকার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ও ব্যক্তি মনে করেন যে এই ধরনের কাজ করে হয়তো কিছু মানুষের মনোরঞ্জন করা যেতে পারে, দলীয় সমর্থন আদায় করাও সম্ভব। আর এই মনোভাবের কারণেই তারা এমনভাবে কাজগুলি করেন যেখানে দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা অবশ্য উচিত। কিন্তু অতি স্পর্শকাতর এমন একটি বিষয়কে প্রকাশ করতে হলে অত্যন্ত বিচক্ষণতা, দায়িত্ববোধ, সুচিন্তিত মতাদর্শ নিজেদের মধ্যে ধারণ করে তবেই এ কাজে হাত দেয়া উচিত বলে মনে করি। রাজাকারদের তালিকা তৈরিতে যারা এই কাজের সাথে যুক্ত সেখানে নিশ্চয়ই একটি কমিটি আছে। কমিটির সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধ এবং এর ভাবগাম্ভীর্যতা সম্পর্কে কতটুকু অজ্ঞ এবং এটি যে একটি গবেষণা লব্ধ বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা ও কৌশলগত দক্ষতা আছে কিনা এ বিষয়গুলি নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে এবং এসব কিছুকে পূর্ণতা দিয়ে তবেই রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজে হাত দেয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ এখানে বস্তুনিষ্ঠতা এবং তথ্যনির্ভরতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যাবেনা আর তা উচিতও নয়।

আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে আসলে জবাবদিহিতার কোন বালাই নেই। কোন কাজে কথায় কোনো জবাবদিহিতা কাউকে করতে হয় না বলেই গা ছাড়া মনোভাব নিয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা, রাজাকার এমন স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে অপরিপক্বভাবে নাড়াচাড়া করে বিতর্কিত করে ফেলছেন। যার ফলাফল আমরা দেখছি রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তাড়াহুড়া করে প্রকাশ করতে গিয়ে যেমন বিতর্কিত অবস্থা তৈরি হয়েছে তেমনি লোকদেখানো উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়া করে রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে একেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হচ্ছে।

দেশের স্পর্শকাতর এমন বিষয়গুলিকে সময়োচিত ও যুগোপযোগী কর্মদক্ষতা ও মননশীল মেধা দিয়ে সম্পন্ন করা অবশ্য উচিত। পুরো বাংলাদেশের অনেক রাজাকার, দেশবিরোধীরা নিজেদের ভোল পাল্টিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে অমুক্তিযোদ্ধাদের সেই তালিকায় প্রবেশ করিয়ে এ কাজটিকে যারা বিতর্কিত করছে তারাই রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের কাজটিকেও বিতর্কিত করছে বলে মনে করি। তাই তাদের তালিকাও প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি।

রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ অবশ্যই একটি মহতী উদ্যোগ। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যেমন সবার জানতে হবে তেমনি প্রকৃত রাজাকারদের নাম প্রকাশ করা অবশ্য কর্তব্য। রাজাকারদের বিতর্কিত তালিকা প্রকাশ নিয়ে সরকার যে আলোচনা এবং সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজাকারদের তালিকা যাচাই বাছাই করে প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইট থেকে রাজাকারদের প্রকাশিত তালিকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং আগামী ২৬শে মার্চ ২০২০ সালে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন- রাজাকারদের তালিকা বিতর্কিত হবার দায়-দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই নিচ্ছেন এবং তিনি আন্তরিকভাবে সবার কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু রাজাকারদের তালিকা তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করতে গিয়ে যে বিতর্কগুলি সামনে এসেছে সেগুলোর কোনো সদুত্তর তিনি সাংবাদিক এবং দেশবাসীকে দিতে পারেননি।

আমাদের কাছে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যেমন আছে তেমনই আমাদের একটি সবুজ মানচিত্রও আছে; আছে লাল সবুজের পতাকা। সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে স্বাধীনতা আছে, পৃথিবীর কোন মানুষের কাছেই রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এমন স্বাধীনতা নেই। যেখানে স্বাধীনতা শব্দটি আছে সেখানে ঘৃণার অক্ষরে লেখা আছে রাজাকার নামক শব্দটি। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অপশক্তি রাজাকারদের তালিকা প্রকাশে নিশ্চিতভাবেই দায়িত্বশীল হতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজাকারদের সঠিক তালিকা প্রকাশিত হোক কোন রকম বিতর্ক ছাড়াই সে অপেক্ষায় রয়েছে এখন পুরো জাতি।

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ