জীবিকার তাগিদে শুরু করেছি নতুন এক যুদ্ধ! জানি না কতোটুকু সফল হবো! শুধু এইটুকু জানি, এই যুদ্ধ আমার একার লড়াই করে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ তিনটি প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক লড়াকু মানুষ আমি, প্রতিনিয়ত লড়াই করেই বেঁচে আছি! এতেই আনন্দ ছিল এতোদিন, এখন ক্লান্ত লাগে, লড়াই তবুও চলছে।
হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় এরকম কোনকিছুর মধ্যে কোনদিন বড় হইনি। তাই জানি না তার আনন্দ কতোখানি। শুধু জানি তার দ্বিগুণ আনন্দ লুকিয়ে থাকে কষ্টার্জিত ছোট ছোট জিনিসগুলোর মধ্যে। সহজলভ্য যা কিছু তা সহজেই বিলীন হয়ে যায়। তাই সহজলভ্য এসব পাওয়া থেকে শুরু করে 'সহজলভ্য মানুষগুলো' থেকেও নিরাপদ দূরত্বে রাখি নিজেকে।
আমার অনেক কাছের মানুষেরা প্রায়শই আমাকে বলে, আমি কাজ করে খাওয়া মানুষ সেকারণে আমি যেন সবার সাথে একটু নমনীয় হয়ে চলি! আমি জানি তারা আমাকে বন্ধু ভেবে আপন মনে করেই কথাগুলো বলে। একটা প্রবাদবাক্য খুব প্রচলিত, বরিশালের মানুষদের নাকি ঘারের একটা রগ ত্যাড়া, কখনো কখনো নিজেকে দেখে কথাটার সত্যতা খুঁজে পাই।
স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে পারলে জীবনে হয়তো অনেকদূর যেতে পারতাম। স্রোতের বিপরীতে চলা একরোখা গোঁয়ার গোবিন্দ মানুষ বলেই দিনরাত গাধার খাটুনি খেটে, গোল আলুর ঝোল দিয়ে, দুটো মোটা চালের ভাত খেয়েই তৃপ্তিদায়ক ঘুম দিতে পারি। দিনশেষে কাউকে কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এর চেয়ে বড় প্রশান্তি আর কী হতে পারে!
অনেকের কাছেই হয়তো মনে হতে পারে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় আমি বোধহয় একটু বাড়িয়েই বলছি, মনে হতেই পারে! কিছু মানুষ আছে যারা সহজ জিনিসটাকে বাঁকা করে দেখে, কেউ বা বাঁকাটাকে সহজ! ফেইসবুকে দেখে একজন মানুষের জীবন সম্পর্কে কতোখানিই বা বোঝা যায়!
সুন্দর একটা শাড়ি, শ্যাম্পু করা চুল, কাজল টানা চোখ দেখে এটা ভাবার অবকাশ নেই। এই আমি, যে কিনা দুই মেয়ের উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার আশায় দোকান থেকে ঘুম কিনে খেয়ে ঘুমাই। না ঘুমালে সকালে উঠে কাজ না করতে পারার অপরাধের শাস্তি হিসেবে বরণ করে নিতে হবে চূলা জ্বালাতে না পারার নির্মম কশাঘাত!
আবার কেউ কেউ এও বলতে পারেন, এই কথাগুলো এখানে লিখে আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি! সত্যিই তো, কী বোঝাতে চাইছি?
কিছু একটা যে বোঝাতে চাচ্ছি সেই কঠিন সত্যিটাকে এড়িয়ে যাওয়ার নির্বুদ্ধিতা দেখাতে চাই না বলেই নিজের ভাষায় সরল স্বীকারোক্তি। প্লিজ, আমার গল্পটা একটু শুনুন।
বড় মেয়ে, যাকে পেটে না ধরেও মা-বাবা দুজনার ভূমিকাই পালন করছি আমি। ওর মা বেঁচে থেকেও আজ সে মা হারা! মাত্র দেড় বছর বয়সে ১৯৯৮ সালের ২৩ জানুয়ারি আমার ভাইটি পাড়ি জমিয়ে ছিলো না ফেরার দেশে, সেদিন থেকে আমি ওর মা, আমিই ওর বাবা! সেদিনের সেই নিষ্পাপ চাহনি উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখানোর দুঃসাহস আমার ছিলো না। আর সে কারণেই ওর কোমল হাত দুখানি ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
আর নিজের পেটের যে মেয়েটি, সে নিতান্তই ছোট এখনও, শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার অপরাধে তার বাবা বেঁচে থেকেও মেয়ের দায়িত্বভার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে মেয়ে এই পৃথিবীর আলো দেখার আগেই! আজ সে বাপ-দাদার আদর থেকে বঞ্চিত।
দুই মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘ পথ আমি পাড়ি দিয়েছি কখনও খেয়ে, কখনও না খেয়ে। কিন্তু কখনও কারও মুখাপেক্ষি আমি হইনি। যেটুকু শিক্ষা, সংস্কৃতি আমার আছে, তাতেই আমাকে বিবেকবন্দী করে দিয়েছে। বড় মেয়েটি এবার এইএসসি দেবে, চোখে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন, নিজে টিউশনি করে হাত খরচ চালায়। না খেয়ে থাকলেও মুখ ফুটে বলে না। তবে ছোটটি বলে। এবার ক্লাস সিক্সে। সরল-চপল কিশোরী সে।
ঘরে আরও একজন আছেন। আমার বৃদ্ধা মা। মাকেও আমার সাথেই রেখেছি, আমার মাও এখন আমার কাছে আরেকটা সন্তানের মতোই। জিম এবং পারলার চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে এটাকেই আঁকড়ে ধরেছিলাম জীবন চালানোর পাথেয় হিসেবে। অন্য চাকরি করা হয়নি আমার তিন-তিনটি মানুষকে ঘরে ফেলে রেখে। বাইরে গিয়ে কাজ করলে এই তিনজনের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত এই সমাজে।
নিন্দা করার মানুষ বহুত পাওয়া যায়। কিন্তু পরিশ্রম করে উপার্জন করে খাওয়া সৎ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা খুব কম। এই সংখ্যা দিন দিন আরও কমছে। কোনদিন ভাবিনি এই কথাগুলো এইভাবে জনসম্মুখে বলতে হবে। অনেক কষ্ট হচ্ছে, অনেক ক্ষোভ জমেছে মনে, তাই বলছি।
হার না মানা একজন পরিশ্রমী মানুষ আমি। পরিশ্রম করে বেঁচে থাকাটাই যার প্রধান কাজ, কিন্তু সেই আমিই আজ সময়ের বিবর্তনের শিকার। আমরা গুণীদের কদর করতে জানি না। রংচঙ আর চাকচিক্যময় আলোর দিকেই ধেয়ে যাই! অন্তত অনলাইন জগতে তো তাদেরই জয়জয়কার। সেখানে আমার মতো নিতান্ত একজনের স্থান কই?
============================================================
টু ডিফাইন এ ব্যাড গার্ল, এই প্রামাণ্য চিত্রটি দেখার অনুরোধ রইল।
১২টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আমি কি লিখবো বুঝতে পারছিনা, তাই আবার পড়বো, আপনার প্রামাণ্য চিত্রটি আবার দেখে কমেন্ট করবো।
এরি মাঝে আপনাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও স্বাগতম জানাচ্ছি সোনেলায় লেখার জন্য।
আপনার ভিডিওটি আমাকে খুব টানছে, নামাজ পড়ে এসে আবার দেখবো।
ভালো থাকবেন।
এঞ্জেল সাঁকো
ধন্যবাদ আপনাকে!
সময় করে আমার লেখাটা পড়ার জন্য 🙂
দোয়া করবেন।
ইঞ্জা
অবশ্যই দোয়া থাকবে আপু, আপনার ভিডিও দেখেছি আমি।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার লেখা পড়লাম, বুঝলাম, অনুভুতি গ্রহন করলাম, লোক চক্ষুর কথা শুনলাম।
আপনি সংসার না করেও করছেন। আপনিও সংগ্রামী সংরাম করুন। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে সামনের পথ এগিয়ে যান। আর আমরা পুরুষরা দেখার জাত, কুকথা বলার জাত, সমাজি মোড়লরা মানুষের ভিতর দেখেনা, বাজ্যিক দেখে পুরুষতান্ত্রিক কর্তা হয়ে শাসন করে, চোখ রাঙ্গায়, আর পৃথিবী জন্মায় এই ধারা শুরু আমার যতটুকু মনে হয়।
বিশেষ কিছু বলার। আপনি সুস্থ থাকুন ।
শুন্য শুন্যালয়
স্বাগতম আপনাকে সাঁকো আপু।
মেয়েদের থামিয়ে দেয়াতেই পুরুষ বা সমাজের জয়। আর মেয়েদের শত্রু মেয়েরাই তাতো আছেই। যদিও মেয়েদের বড় করা হয়েছেই এই মেন্টালিটি দিয়ে। সবার কথা শুনে থেমে গেলেই আর সম্ভব হতোনা একজন সাঁকো যোদ্ধার। আপনাকে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই আপু। শ্রদ্ধা জানবেন।
পুরো ডকুমেন্টারিটা কোথায় পাবো? লিঙ্ক থাকলে কাইন্ডলি দেবেন একটু।
এঞ্জেল সাঁকো
আমি খুবই দুঃখিত আপনার কমেন্টরর উত্তর দিতে দেরি করার জন্য। ডকুমেন্টারি ইউ টিউবে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন।
টু ডিফাইন এ ব্যাড গার্ল।
এঞ্জেল সাঁকো
https://www.facebook.com/100001396271444/posts/1874424382614086/
মুভির লিংক।
নিতাই বাবু
ক্লান্ত হবেন না দিদি, প্লিজ! আপনাকে এই জীবন চলার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে । আপনার দেখাদেখি আরও দশজন নারীও হতে পারে আপনার মতো একজন যোদ্ধা । আপনার জন্য রইল শুভকামনা, যুদ্ধে জয়ী হবেন আশা করি ।
এঞ্জেল সাঁকো
দোয়া করবেন। দুঃখিত এতোদিন পরে কমেন্টরর উত্তর দেয়ার জন্য।
নীরা সাদীয়া
একজন নারীকে সমাজ দূর্বল ভাবে, নিন্দে করে, কটাক্ষ করে আরো কত কী! কিন্তু নারী যে শক্তির অপর নাম তা আপনার মত সৎ,মেধাবী, পরিশ্রমী নারীরাই প্রমাণ করে দেয়। সালাম ও শুভকামনা জানাই আপনাকে।
এঞ্জেল সাঁকো
আপনাদের মুল্যবান মন্তব্যর উত্তর দিতে দেরি করার জন্য সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সবাই দোয়া করবেন আমি যেন দুই মেয়েকে ওদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষে নিয়ে যেতে পারি, কোন অপশক্তিই আমাদের চলার পথের গতিরোধ করতে না পারে।
এঞ্জেল সাঁকো
https://www.facebook.com/100001396271444/posts/1874424382614086/
মুভির লিংকটা এখানে দিয়ে দিলাম। সময় করে দেখার অনুরোধ থাকলো।