
আজ খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো। সাধারণত এতো ভোরে ঘুম ভাঙ্গেনা। এক জোড়া কবুতর তাল মিলিয়ে ডাকছে খাটের তলে বসে। ঘরের পিছন দিক থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে কানে। মূলত এদের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। মাথার উপর টিনের চাল। চাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। হালকা শীত শীত লাগছে। এমন ভোরে আমার খুব ইচ্ছে হলো ধান ক্ষেতের আইল ধরে কিছুক্ষণ হাঁটতে। পুরানো স্মৃতি কুড়াতে। কত শত স্মৃতি রয়েছে ধান ক্ষেতের আইলে। খুব ভোরে বাড়ির সব ছেলেমেয়ে দলবেঁধে মক্তবে রওনা হতাম। আবার ছুটি শেষে দলবেঁধে ফিরে আসতাম। এই যাওয়া-আসার মাঝে কত হাসি-তামশা, গল্প-গুজব করতাম! সব এখন স্মৃতি।
আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকে একটি সরু রাস্তা আছে। এই রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলেই বিস্তৃর্ণ ধান ক্ষেতের দেখা মিলে। আমি গায়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে রওনা হলাম সরু রাস্তা ধরে। রাতের কুয়াশায় মাটি কিছুটা নরম হয়ে গেছে। তাই নরম মাটি ও খড়কুটা স্যান্ডেলের তলায় লেগে যাচ্ছে। বারবার স্যান্ডেলের তলা পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এটা খুব বিরক্তিকর। কিন্তু, এমন বিরক্তিকর মুহূর্তে অপরূপ একটি দৃশ্য আমাকে থামিয়ে দিয়েছে। একটা শিউলি গাছের তলায় থোকা থোকা ফুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার মাঝে পাঁচ-ছয় বছরের একটা মেয়ে বসে আছে। বসে বসে সে কিছু ফুল ডান হাত দিয়ে নিয়ে বাম হাতের তালুতে রাখছে। কি দারুণ দৃশ্য!
আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার নজর কেড়ে নিলো একদল কিশোর। তারা সারি বেঁধে ক্ষেতের আইল দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছে। সবার এক হাতে জায়নামাজ, অন্য হাতে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এসব দেখে বুঝায় যাচ্ছে তাদের গন্তব্য। তাড়াছা এই দৃশ্যটা আমার খুব পরিচিত। ছোটবেলায় আমিও যে এই পথ ধরে হেটেছি। সেই একই ঋতু। একই ক্ষেত। এই সময় ক্ষেতে ধান থাকেনা। থাকে কাটা ধানের নাড়া। বিকালে এই নাড়া গুলো তুলে এক জায়গায় একত্রিত করে আগুন লাগিয়ে দিতাম। আবার অনেক সময় ক্রিকেট খেলার জন্য দুই চার বাড়ির সব ছেলে মিলে একসাথে কয়েকটা জমির নাড়া তুলে ফেলতাম। অবশ্য এসবের জন্য বকাও শুনতে হয়েছে অনেক।
আমি যখন স্মৃতি হাতড়াতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই পিছন থেকে ছোট ভাইয়ের ডাক ভেসে আসলো কানে। আম্মা দ্রুত যেতে বলেছে। না হয় নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে। অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছি। তাই চারদিক থেকে সবাই খুব যত্ন করছে। আম্মা তো একেক বেলায় একেক রকমের খাবার রান্না করছে। গতরাতে আব্বা হাট থেকে আইড় মাছ নিয়ে আসছে । আজ নাকি আনবে চিতল মাছ। ছোট ভাই বলে,“এসব হেমন্তের মাছ, আমি বইতে পড়েছি। তাছাড়া এসব না খেলে একসময় ভুলে যাবা ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’ ।”
পুকুর ঘাটে এসে দেখছি, এখানে আড্ডার আসর বসেছে। গ্রামের বাড়িতে এমন হয়, সকালে ও সন্ধ্যায় বাড়ির ছেলে মেয়েরা হাত মুখ ধুতে এসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। আজকের আড্ডার বৃত্তটা আমাকে কেন্দ্র করে। সবাই আমার শহুরে জীবনের গল্প শুনতে চাচ্ছে। আমিও তাদের সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। পড়ালেখার কথা বলছি। মাঝেমধ্যে হতাশার গল্পও শোনাচ্ছি। আমার শহরে শিউলি ফুল নেই। ধান ক্ষেত নেই। কৃষক নেই। আছে শুধু কৃষকলীগ ।
ঐদিকে ঘর থেকে এবার আম্মার ডাক শুনা যাচ্ছে। তাই ঘাটে বেশিক্ষণ থাকা গেলো না। রওনা হলাম ঘরের দিকে। ঘরে এসে দেখি আম্মা পায়েশ ও কয়েক রকমের পিঠা প্লেটে সাজিয়ে রেখেছে। আমি অবাক হয়ে আম্মাকে জিঙ্গেস করলাম, এতো রকমের পিঠা কেন? এতো পিঠা কে খাবে! আমার কথা শুনে ছোট ভাই বলতে শুরু করলো, “এসব হেমন্তের পিঠা, আমি বইতে পড়েছি। তাছাড়া এসব না খেলে একসময় ভুলে যাবা ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’ ।” ছোট ভাইয়ের কথা শুনে আম্মা-আব্বা আমি সবাই একসাথে হেসে উঠলাম। আমাদের হাসতে দেখে ছোট ভাইও হাসতে শুরু করলো। আমাদের পরিবারের সবাই এক সাথে হাসছে। আহ্ কি আনন্দের মুহূর্ত! এসময় কবিদের মতো আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করছে, হে ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখো, বাঁচিয়ে রেখো কবুতরের মায়াময় ডাকা শোনার জন্য। বাঁচিয়ে রেখো মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙ্গার জন্য। বাঁচিয়ে রেখো শিউলি তলায় ফুল দেখার জন্য। বাঁচিয়ে রেখো পরিবারের সবার সাথে একত্রে হাসার জন্য।
হাত ঘড়িতে তখন সকাল নয়টা বেজে পনের মিনিট। এসময় আমাদের ঘরে এসে হাজির হলো আমাদের বাড়ির তৌকি ভাই ও পাশের বাড়ির মামুন ভাই। তৌকি ভাই ও মামুন ভাইয়ের মধ্যে গলায় গলায় ভাব। দুজনে খুব ভালো বন্ধু। হাটে, ঘাটে মাঠে, চায়ের দোকানে, যেখানেই থাকুক না কেন, সবসময় দুইজনকে একসাথে দেখা যায়। তারা দুইজনে মিলে হঠাৎ পরিকল্পনা করলো দুই বাড়ির মানুষদের নিয়ে একটা পিকনিকের আয়োজন করবে। দুইবাড়ির মানুষদের মধ্যে নাকি দিনদিন যোগাযোগ, ভাতৃত্ববোধ কমে যাচ্ছে। তাই এই দুইবাড়ির মানুষদের একত্রিত করাই তাদের মুল লক্ষ্য।
পিকনিকের স্থান নির্ধারণ করা হলো বাড়ির পিছনের গোলায়। গোলা আমাদের সন্দ্বীপের আঞ্চলিক শব্দ। আসলে বাড়ির পিছনের বিস্তীর্ণ পতিত জমিকে আমাদের এখানে গোলা বলা হয়। তো তাদের পরিকল্পনার কথা দুই বাড়ির সবাইকে জানানো হলো। সেই ধারাবাহিকতায় তারা আমাদের ঘরেও আসলো। আমাদের পরিবারের সবাই এতে খুব আনন্দের সাথে হ্যাবোধক সম্মতি জানিয়েছে। আমাদের পরিবারের মতো দুইবাড়ির সব পরিবারই এতে অংশগ্রহণ করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। দুইবাড়ির ছোট বড় সবার মাঝে একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হলো। দুইবাড়ির প্রত্যেক ঘর থেকে চাঁদা তোলা হলো। সবাই সাধ্যমত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি দিয়ে অংশগ্রহণ করছে। এইদিকে একটু জামেলা পোহাতে হয়েছে। কোন পরিবার থেকে পেল আমন ধানের চাউল। আবার কোন পরিবার থেকে পেল আউশ ধানের চাউল। দুই রকমের চাউল আসায় একটু সমস্যা হলেও পরে অবশ্য সিদ্ধান্ত হলো, এই চাউল গুলো দোকানে বিক্রি করে সব একই রকমের চাউল কিনা হবে।
বাড়ির কেউ কেউ একটা সম্পূর্ণ উপাদানের খরচ বহন করতে রাজি হলো। কয়েকজন এগিয়ে এলো রান্নার কাজে সাহায্য করতে। এইভাবে সবার সহযোগীতায় খাওয়া দাওয়ার প্রস্তুতি শেষ হলো।
কিন্তু, পিকনিক মানে তো শুধু খাওয়া দাওয়া নয়, তাতে বিনোদনও থাকা চাই । তারা দুইজনে সেই ব্যবস্থাও করেছে। গোলায় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় প্যান্ডেলিং করা হয়েছে। বিনোদনের জন্য গান বাজনার আয়োজন করা হয়েছে। আর এসব শুরু হয়েছিল পরদিন সকাল থেকে। দুপুরের দিকে আস্তে আস্তে দুই বাড়ির সবাই গোলায় আসতে শুরু করলো। তারপর সবাই মিলে একসাথে খাওয়া, গল্প, গান, আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ হেমন্তের বিকেলের গোল রাঙা সূর্যটা চুপে চুপে ডুবে গেল। শুধু রেখে গেল হেমন্তপ্রেমী জীবনানন্দ দাশের কবিতা।
ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত
Thumbnails managed by ThumbPress
২০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
হেমন্ত বন্দনা ভালো হয়েছে ভাই।
লেখা জমা দেয়ার একেবারে শেষ দিনে লেখা জমা দিলেন ☺
শুভ কাম।
আকবর হোসেন রবিন
কি লিখব, কিভাবে লিখব ভাবতে ভাবতে আজ এটা লিখলাম।
ধন্যবাদ ভাই।
সুরাইয়া পারভিন
চমৎকার লিখেছেন হেমন্ত বন্দনা
আমাদের পরিবারের সবাই এক সাথে হাসছে। আহ্ কি আনন্দের মুহূর্ত! এসময় কবিদের মতো আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করছে, হে ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখো, বাঁচিয়ে রেখো কবুতরের মায়াময় ডাকা শোনার জন্য। বাঁচিয়ে রেখো মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙ্গার জন্য। বাঁচিয়ে রেখো শিউলি তলায় ফুল দেখার জন্য। বাঁচিয়ে রেখো পরিবারের সবার সাথে একত্রে হাসার জন্য,,,,আমরা আবার একসাথে হাসতে চাই।এক সাথে বাঁচতে চাই।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ আপু।
তৌহিদ
একে বারে শেষদিনে লেখা দিলেন দেখে অবাকই হলাম। ভালোলাগলো ভাই। শুভকামনা।
আকবর হোসেন রবিন
সবার হেমন্ত বন্দনা পড়ার পর, আমি লেখার মতো নতুন কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মাথায় এই গল্পটা আসলো। তাই লিখে দিয়ে দিলাম।
তৌহিদ
ভালো করেছেন ভাই।
কামাল উদ্দিন
গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর এমন খাটি গাঁয়ের মথা শুনলে ছুটে যেতে ইচ্ছে এখনি…….খুবই চমৎকার লিখেছেন ভাই, শুভ কামনা সব সময়।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ কামাল উদ্দিন ভাই।
সঞ্জয় মালাকার
দাদা চমৎকার লেখা পড়ে চলে গেলাম নিজ গ্রামে , গ্রামের মানুষ সব সময় এমনি হয় ।
আমি যখন স্মৃতি হাতড়াতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই পিছন থেকে ছোট ভাইয়ের ডাক ভেসে আসলো কানে। আম্মা দ্রুত যেতে বলেছে। না হয় নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে। অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছি। তাই চারদিক থেকে সবাই খুব যত্ন করছে। আম্মা তো একেক বেলায় একেক রকমের খাবার রান্না করছে। গতরাতে আব্বা হাট থেকে আইড় মাছ নিয়ে আসছে । আজ নাকি আনবে চিতল মাছ। ছোট ভাই বলে,“এসব হেমন্তের মাছ, আমি বইতে পড়েছি। তাছাড়া এসব না খেলে একসময় ভুলে যাবা ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’ ।”
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ। বেশিভাগই কোমল মনের মানুষ।
মোঃ মজিবর রহমান
গ্রামেই একমাত্র হেমন্ত উতসব বা হেমন্ত দৃশ্বাবালি দেখা র সৌভাগ্য হই।
গ্রামই সেরা প্ররক্রিতি দর্শন মাঠঘাট বন জংগলেই মিশে আছে।
সুন্দর লেগেক্সহে ভাই
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ মো: মজিবর রহমান ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
হেমন্ত বন্দনার শেষ লেখাটি আপনি দিয়েছেন রবিন! এই জন্যে শুভেচ্ছা।
চড়ুইভাতির বর্ননার আগে-পরে যেসব বর্ননা দিলেন তা খুবই মনোমুগ্ধকর। চোখের সামনে দেখতে পেলাম সেই ফুল হাতে বসে থাকা মেয়েটিকে, পথে চলতে থাকা মক্তবে যাওয়া কিশোরদের,কাটা ফসলের মাঠ গুলো। কিছু মাছ আছে যেগুলো হেমন্ত আর শীতেই পাওয়া যায়। সেই কথা লিখতেও ভুলেননি 🙂
সব মিলিয়ে খুব সুন্দর একটি হেমন্ত লেখা পেলাম আপনার কাছ থেকে।
শুভ কামনা 🌹🌹
আকবর হোসেন রবিন
আপনার মন্তব্যগুলো সবসময় সুন্দর। ধন্যবাদ আপু।
এস.জেড বাবু
ভুলেই যাচ্ছি –
কতকিছু মনে করিয়ে দিলেন। আমি নিজেও শহরকেন্দ্রীক মানুষ হয়েছি। দাদা বাড়ি যেতাম পাঁচ/সাত দিনের জন্য- সেখানকার সে বয়সের চড়ুইভাতি মিস করছি।
চমৎকার বন্দনা হেমন্তের।
শুভেচ্ছা
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ, এস. জেড বাবু ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
লেখায় একদম সঠিক হেমন্ত কে তুলে এনেছেন,
যে হেমন্তকে আমরা ভুলেই যাচ্ছি/গেছি।
পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ হেলাল ভাই।
আরজু মুক্তা
আপনার সাথে, হেমন্তকে দেখে এলাম আর একবার। ভালো লাগলো