শহরে বন্দী জীবনে বসবাস করা ছোট শিশু,ছেলে, মেয়েদের এক রকম অভ্যাসেই পরিণত হয়। নিয়মের বেড়াজাল নিজেরাই প্রচলন করে থাকে,যার যেমন সুযোগ সে তেমন করেই জীবন যাপন করে থাকে। স্কুল,বাসা, টিচারের বাসা বা কোচিং সেন্টার,ছোট বারান্দা, মোবাইল বা কম্পিউটার। এই গন্ডির মধ্যেই তাদের পথচলা। সাপ্তাহিক ছুটিতে হয়তো আত্মীয় স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়া। এধরণের বাচ্চারা যখন প্রকৃতির খুব কাছে যায়, তখন তাদের আনন্দের সীমা থাকেনা।
সামিয়া গাছে উঠেছে।এত সহজে গাছে ওঠা সম্ভব সে ভাবতে পারিনি। আজ সে প্রথম আবিষ্কার করেছে গাছে ওঠা মোটেও কঠিন কাজ নয়। খুশিতে সামিয়ার মুখ ঝলমল করছে। সে মাটি থেকে আট দশ ফুট উঁচুতে জামরুল গাছের একটি নিরীহ ডালে বসে আপনমনে পা দোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটিতে সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। রাতুল দূরে দাড়িয়ে সব কান্ড কারখানা দেখছে। রাতুলের কাছে সামিয়ার গাছে ওঠাটা সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। দু’ চার দিনের জন্য গ্রামে বেড়াতে এসে সে যে এত সব কান্ড করবে রাতুল তা ভাবতেই পারেনি।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার সামিয়া জুতা পায়ে দিয়ে গাছে ঊঠেছে। সামিয়ার পা দোলানোর সাথে সাথে জুতার ফিতা গুলোও এপাশ – ওপাশ দুলছে। সামিয়ার গাছে ওঠাটা প্রথমে রাতুলের কাছে সারপ্রাইজ টাইপ দৃশ্য হলেও এখন মনে হচ্ছে,জিন্স পরে পায়ে জুতো দিয়ে গাছের ডালে বসে এভাবে পা দোলানোর পুরো ব্যাপারটিতে এক ধরনের চমৎকার কৌতুক লুকিয়ে আছে। রাতুল এসব কান্ড দেখে নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো।
সামিয়া রাতুল কে দেখতে পেল।তাকে দেখেই মুখে চড়া হাসি ফুটে উঠল। সে হাতছানি দিয়ে রাতুল কে কাছে ডাকল। রাতুল জামরুল গাছের নীচে এসে দাড়ালো । সামিয়া টগবগ করে ফুটতে ফুটতে বলল,দেখেছো? আমি কত সুন্দর গাছে চড়েছি? ভাবতে পেরেছিলে তুমি? বলো?
রাতুল স্মিত হেসে ” হুম ” ভাবতে পারিনি। বিরাট কাজ করেছো তুমি।
সামিয়া ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাতুলের দিকে কৃত্রিম কটাক্ষ হেসে তাকাল। তারপর চোখ সরু করে বলল ‘ তুমি একটা হিংসুক’। গতকাল তোমার কাছে গাছে চড়া শিখতে চেয়েছিলাম,তুমি শেখাওনি। আজ যখন দেখলে আমি নিজেই চড়তে শিখে গেছি,অমনি জেলাস হয়েছো তুমি। তুমি খারাপ৷ সামিয়া কপট ঢঙে মুখ ফিরিয়ে নিল।
রাতুল ওর কৃত্রিম রাগ আর কথা বলার ভংগি দেখে হেসে ফেললো । অবাক ছটফটে আর দুষ্টু এই মেয়েটি। রাতুল হাত বাড়িয়ে বললো এখন নেমে এসো,প্রায় দুপুর হতে চললো । বলি নাওয়া,খাওয়া বলে কিছু নেই নাকি?
গ্রামের এই সাদাসিধে চিরায়ত পরিবেশে সামিয়ার মত তেরো– চৌদ্দ বছর বয়সী একটি ছটফটে,জুতো,জিন্স আর সাদা ফুল তোলা সিল্কের টপ পরা মেয়েকে বেমানান দেখালেও, এখানে আসার পর থেকে প্রতিটি গ্রাম্য কাজের সাথে সে প্রানপণ নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।যেমন,আজ সকালে নারকেল,মুড়ি,গ্লাসভর্তি খাঁটি দুধ আর আখের গুড় দিয়ে নাশতা করতে গিয়ে তার উৎসাহের কমতি ছিলনা। বেলা এগারোটার দিকে রাতুলের চাচাতো ভাইবোন দের সাথে বাড়ির সামনে ক্ষেত থেকে সে হই হই করে সব্জি তুলেছে। সবজি তুলতে গিয়ে বেগুনের কাঁটার খোঁচা খেয়েও টু– শব্দটি করেনি। রাতুল খেয়াল করছে খানিক্ষন তার আহত আংগুল মুখে পুরে রেখে আবার কিছু বেগুন গাছ থেকে ছিড়েছে। আর কিছুক্ষণ আগে তো গাছে চড়ে বসেছিল। আবার এখন বায়না পুকুরে সাঁতার কাটা শিখবে।
সামিয়া রাতুলের ঢাকার বাসার পাশের ফ্লাটে থাকা প্রতিবেশীর এক মাত্র মেয়ে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শুনা করে। তার বাবা মা দুই সপ্তাহ আগে শারীরিক চেক আপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়েছেন। কাজের মেয়ের ত্তত্বাবধানে থেকে থেকে এই কয়েকদিনে সামিয়া খুব বোর ফিল করছিল।
রাতুল গ্রামে যাওয়ার প্রস্তাব দিতেই সে সাথে সাথে করে রাজি হয়ে গিয়েছিল।
মাত্র দুই বছর ধরে সামিয়া আর রাতুলদের পরিবার পাশা পাশি বসবাস করছে। রাতুলের গল্পবলার প্রতিভা, আর সামিয়ার প্রান– চাঞ্চল্যে ভরা সংগ– প্রিয় আচরণ এবং গল্প শোনার গাঢ তৃষ্ণা ওদের দুজনের ভেতরে দারুন এক সেতুবন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। আজকাল ওরা দুজন বন্ধু ভাবতে মোটেই দ্বিধা করেনা।
রাতুল সামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। কি স্নিগ্ধ, কি শান্ত- সুবোধ,কি স্নেহ ঢালা এক চিলতে মুখ।অথচ কি দুষ্টু,কি ছটফটে, আর অবাধ্য। হঠাৎ করে রাতুল এই মায়া মাখা ও দুষ্টু মেয়ের মুখেরদিকে তাকিয়ে এক রকম মমতা অনুভব করলো।
সামিয়া ভেবেছিল রাতুল তাকে সাঁতার শিখাতে বোধ হয় রাজি হবেনা।কাজেই বিনা আপত্তিতে রাতুল সামিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল,সে বিকট চিৎকার দিয়ে রাতুল কে জড়িয়ে ধরলো । পাহাড়ি জলপ্রপাতের মত সামিয়ার উচ্ছ্বাস । সাঁতার শিখানোর প্রস্তাব দেয়াতে সামিয়ার কিছুটা শংকা কাজ করছিল। কিন্তু রাতুল প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় মুহূর্তে গাছে চ ড়ে বসে থাকার সময় যেমন তার
মুখ ঝলমল করেছিল,আবার সেই চমৎকার হাসিটা ফিরে এসেছে।
রাতুল সামিয়াকে এক ঘন্টা ধরে সাঁতার শিখালো। সাতার শেখার বেশ কিছু গ্রাম্য আয়োজন তাকে বাকরুদ্ধ করে দিল। বড়সড় এক টি কলাগাছ কেটে পুকুরে ভাসিয়ে দিতেই সে সেটা ধরে বেশ কিছুক্ষণ পানিতে গড়াগড়ি খেল। এক জোড়া ঝুনো নারিকেল শক্ত করে বেঁধে তার পেটের তলায় কায়দা করে আটকে দিতেই সে মাছের মত সাঁতার কাটতে শুরু করে দিল। সামিয়ার এত উচ্ছ্বাস দেখে রাতুলের চাচাতো ভাই বোনেরা সবাই পানিতে নেমে এসেছে। তাদের সরব কোলাহল দেখে মনে হচ্ছে পুকুরে যেন বৈশাবী( বৈশাখী) মেলা বসেছে। সামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রাতুলের মনে হলো এত আনন্দময় সময় সে আর জীবনে কখনও পায়নি।
মুশকিল হলো দুপুরে খেতে বসে, সামিয়ার মুখ হা হয়ে গেল। বিশাল কাতলা মাছের পেটি দেখে তার মুখের কথা বন্ধই হয়ে গেল। মাছের এতবড় পিছ আগে কখনোই পাতে তুলে খায়নি। রাতুলের চাচী দারুন রান্না করেন। মাঝে মাঝে শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া এটাও একটা রাতুল দের বড় কারণ । আজ তিনি বিশাল কাতলা মাছের ঝোল রান্না করেছেন সাথে দেশী মুরগীর মাংস,বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, আর ছোলার পাতলা ডাল। সব কিছুই অমৃতের মত লাগছে। কিন্তু সামিয়া কিছুই খেতে পারছেনা খাওয়া শুরু করতেই তার উৎসাহ ভাটা পড়ে গেল। সে যা ই মুখে দেয়,তাতেই ঝাল লাগে। শুরুতে তার যে উচ্ছ্বাস ছিল, অল্পক্ষণেই তা স্তিমিত হয়ে গেল। রাতুল আড়চোখে খেয়াল করলো, তার মুখের হাসি সরে গিয়ে সেখানে এক অসহায় ভংগি এসে ভর করেছে।
রাতুল মুরগির আস্ত সরু পা চিবোতে – চিবোতে বললো আমার কাছে কিন্তু বেশী ঝাল লাগছে না। তোমার কাছে কি খুব বেশী ঝাল লাগছে সামিয়া?
সামিয়া মুখ নীচু করে মাথা নাড়ল। রাতুল দেখলো তার বেনী করা চুলের সাথে এমন অসহায় মুখ ভংগি চাচীর ও কষ্ট হচ্ছে। চাচী ছাড়াও চাচাতো ভাই বোন গুলোও মন খারাপ করছে। করুন মুখে সবাই সামিয়াকে দেখছে। চাচী কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন তুমি কি কিছুই খেতে পারছো না সামিয়া? সোনা মা আমার, অনেক বেশী ঝাল হয়ে গেছে? হায় হায় এ আমি কি করেছি।।
রাতুল বললো, চাচী ভাববেন না, দেখি কি করা যায়।
মাদুর পেতে বারান্দায় সবাই খেতে বসেছিল। রাতুল আর সামিয়া পাশাপাশি, চাচাতো ভাই বোন, টুসী,মৌ জীতু সবাই গোল করে বসেছে। টুসী চাচীর বড় মেয়ে এবার ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দিবে।মৌ আর জীতু ক্লাশ এইট আর ফাইভে স্কুলে পড়ে।
জীতু বললো সামিয়া আপু তুমি শুধু পাতলা ডাল মেখে খাও।
টুসী জীতুর কথা শুনে কটমট করে ভাইয়ের দিকে তাকালো । তারপর বললো শুধু ডাল দিয়ে খাবে কি করে? গাধা একটা। তারপর সামিয়ার দিকে তাকিয়ে তুমি কি দুধ ভাত খাবে? দেখবে ঝাল একদম কমে যাবে।
সামিয়া মাথা নেড়ে ” না” বললো। মিনমিনে গলায় বললো সকালে একবার দুধ খেয়েছি। এখন আর খাবনা। তাছাড়া দুধ অতটা পছন্দ করিনা। সে মুখ নীচু করে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে লাগল।
রাতুল বললো ঝাল কম হলে খেতে অসুবিধে নেই তো? সামিয়া চুপ করে থেকে ঠোঁট কামড়ে রাতুলের দিকে তাকালো ।
রাতুল পাতলা ডালে কাতলা মাছের একটি পেটি উল্টে পাল্টে কিছুক্ষণ চুবিয়ে সামিয়ার প্লেটে তুলে দিয়ে বললো এখন খাও দেখো তো ঝাল কমেছে কিনা।
সামিয়া অবাক হয়ে রাতুলের দিকে তাকায়। মাছের টুকরা থেকে কাঁটা চামচে গেঁথে রাতুল সামিয়ার মুখে তুলে দিল। আস্তে আস্তে খেতে খেতে সামিয়ার মুখেভ হাসি ফুটে উঠল। তার মুখ দেখে মনে হলো চুড়ান্ত একটি মেঘলা দিনের মধ্যহ্নে হঠাৎ করেই আকাশে রোদ উঠেছে। রাতুলের চাচী হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,তাহলে একটু মাংস ডালে চুবিয়ে দেই সামিয়া সোনা? তুমি তো মাংস খাওনি।
সামিয়া মাথা কাত করে সায় দিল। কিছুক্ষনের মধেয় চাচাতো ভাই বোনেরা দেখল,যে মেয়েটি ঝালের জন্য কিছুই খেতে পারছিল না, এখন দিব্যি সব খাচ্ছে।
সামিয়ার খাওয়ার সমস্যার জন্যই ওদের খাওয়ায় আজ কিছুটা ভাটা পড়েছে।সামিয়া আবার সহজ, নরমাল হওয়াতে সবার মনে খুশি লাগছে।
দুপুরের খাওয়ার পরেই সবাই বেড়াতে বের হলো। চাচী রাতুল কে ডেকে বললেন সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার আগেই চলে এসো। সন্ধ্যায় ভাপা পিঠা বানাবো চুলার পাশে বসে সবাই মিলে গরম গরম পিঠা খাবে।
অগ্রহায়ণের এখন মাঝামাঝি। গ্রামে একটু একটু করে শীত পড়ে যাচ্ছে।দুপুরে কড়া রোদ উঠলেও তাতে আহামরি তেজ নেই। রাতুলরা বাড়ি থেকে দল বেঁধে বের হলো। সবুজ মাঠ ভরা খেসারি মটর মশুর,তিসি,তিল আর পতিত জমির লম্বা ঘাসের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মাঝখানের আল ধরে দীর্ঘ পায়ে হাঁটা -পথ পড়েছে।
সামিয়াকে রাতুলের ভাই বোনেরা মহা উৎসাহে আঙুল উঁচিয়ে সব ফসলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। জীতু, টুসী,মৌ সবাই কলকল করে কথা বলছে।
আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জীতু বললো রাতুল ভাইয়া তুমি কিন্তু এবারে কয়েকদিন থাকবে আমাদের বাড়িতে। আমরা নতুন ধানের চাল দিয়ে বাড়ির উঠোনে পিকনিক করবো৷ তুমি তো কবুতরের মাংস খেতে চেয়েছিলে তাইনা? বাবাকে বলবো হাট থেকে দুই জোড়া কবুতর নিয়ে আসতে।
মৌ পিছন থেকে বলে উঠলো আমিও খাব কবুতরের মাংস। তারপরে মৌ একটু জোড়ে হেঁটে গিয়ে আর একটু এগিয়ে এসে সামিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তার দিকে তাকিয়ে বললো, সামিয়া আপু তুমি কি কবুতরের মাংস পছন্দ করো?
সামিয়া কতগুলো মটরের ফুল ছিড়ে হাতে নিয়ে গন্ধ নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো আমি অতটা পছন্দ করিনা মৌ। অত সুন্দর একটি পাখিকে খেয়ে ফেলতে যেন কেমন লাগে।
মৌ হাসিমুখে বললো তা ঠিক। কবুতর দেখতে সুন্দর। কিন্তু তুমি যদি কবুতর না খাও, তাহলে তো তুমি কবুতরের মত আকাশে উড়তে পারবেনা।
মৌয়ের কথায় সবাই এক্সাথে হেসে উঠলো ।
ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যে জীতু,টুসী, মৌ সামিয়াকে, মাঠে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা, এক ধরনের বুনো ঘাস, শান্ত ফসল আর আকাশে উড়তে থাকা পাখিদের সাথে আগা গোড়া পরিচয় করিয়ে দিল।কিছুক্ষণ পরে রাতুল খেয়াল করলো সামিয়ার পরীক্ষা নিচ্ছে তারা। টুসী একটি মটরের ডগা ছিড়ে হাতে নিয়ে কল কল করে বলিছে,বলতো আপু এটা কি গাছ? রাতুল অবাক হয়ে দেখলো,সামিয়ে প্রথমে একটু ভুল করলেও কিছুক্ষণ পরে স ঠিক ঠিক জবাব দিচ্ছে। আর তাই দেখা চাচাতো ভাই বোনেরা খুশিতে আত্মহারা হচ্ছে। সন্ধ্যা অব্দি সবাও মাঠে- ঘাটে, পথে- প্রান্তরে, ক্ষেতের আল ধরে সবুজ ফসলের উপরে ছাই রঙের আকাশ কে ক্রমশ বেগুনী থেকে কালো হতে লাগলো। এমন খোলা প্রান্তরে সন্ধ্যা নামার সমস্ত আয়োজন চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখে সামিয়া হতবাক হয়ে গেল৷ সে ফিস ফিস করে বললো ইশ! কি সুন্দর! কি সুন্দর।
সন্ধ্যায় বাইরে চুলার পাশে সবাই গোল হয়ে বসে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা খাওয়া হলো। টুসী সামিয়াকে পিঠা ভেঙে নারিকেল গুড়ে ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে দিচ্ছিল। তাই দেখে মৌ জোড়ে বলে উঠলো আমায় জুড়িয়ে দিতে হবে, দিতে হবে বলেই রাতুলের কাধে লুটোপুটি খাচ্ছিল।
রাতে আকাশে বিশাল চাঁদ উঠলো। এমন শীত- শীত কোমল হাওয়ায় কারোর ই পড়াশুনায় মন নেই। সামিয়াকে নিয়ে বেড়াতে আসার পর থেকে সবার পড়াশুনা শিকেয় তুলেছে। সবাই খোলা বারান্দায় মাদুরের উপরে দুটো পাতলা কম্বল বিছিয়ে গোল হয়ে বসলো। জীতু গুটিসুটি হয়ে আরাম করে বসে নরম গলায় বললো, রাতুল ভাইয়া, একটা গল্প বলো৷ মৌ রাতুলের গা ঘেঁষে এসে বললো গল্প বলো। তারপর হঠাৎ মুখ শক্ত করে বললো,তবে ভূতের গল্প বলবেনা। ভূতের গল্পে আমার ভয় লাগে। টুসী বারান্দার দেড় ফুট উঁচু টিনের বেড়ায় হেলান দিয়ে হাতের তালুতে থুতনির ভর চাপিয়ে চুপচাপ আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতুল বলে উঠলো,কিরে! টুসী তুই কিছু বলছিস না যে? কলেজ পাশ করে যাচ্ছিস বলে বিরাট কেউকেটা মনে করছিস নাকি নিজেকে?
টুসী মুখ বাঁকিয়ে বললো,তুমি যদি তাই ভাব তাহলে তাই৷
রাতুল টুসীর চুলের বেনী ধরে টান মেরে বললো,খুব ভাব নিতে শিখে গেছিস তাইনা? অনেক বড় হয়ে গেছিস?
টুসী চাঁদের আলোয় মুখ নীচু কর হাসলো। তারপরে বললো,তুমি সবাইকে ফাঁকি দিতে পারবে, আমাকে নয়।
রাতুল অবাক হবার ভান করে বললো, এখানে ফাঁকি- জুঁকির কোথাউ পেলি?
টুসী মুখ ভেংচে বললো, গতবার এসেও তুমি পুরো গল্পের শেষ করে যাওনি। হঠাৎ – -হঠাৎ আসো আর একেক টা গল্পের আধা আধি বলে চলে যাও। ভাল্লাগে না আমার।
রাতুল হো- হো- হো করে হেসে উঠলো।
সামিয়া তার পায়ের কাছে থাকা পাতলা চাদরটি হাঁটু অব্দি টেনে দিয়ে টুসীর দিকে তাকিয়ে বললো জানো আপু, আসার সময় ট্রেনে আমাকে একটা গল্প বলেছিল, সেটাও পুরো শেষ করেনি। তারপর রাতুলের দিকে বললোতুমি খারাপ।
রাতুল আবারও হো হো হো করে হাসলো।
সামিয়ে কপট ভংগি করে বললো তুমি একদম হাসবেনা।আমার খুব রাগ লাগে।
রাতুল দুইহাত তুলে ক্ষমার ভংগি করে বলে ওকে। অনেক হয়েছে। এখন সবাই চুপ করো৷ আমি গল্প শোনাচ্ছি৷ আজ রাতে পুরো গল্পই শুনাবো। সবাই খুশি?
জীতু আর মৌ চিৎকার করে ইঠলো।
রাতুল গোপাল ভাঁড় থেকে শুরু করে৷ মোল্লা নাসির উদ্দিন হোজ্জার গল্প,শার্লক হোমস এর রহলস্য গল্প,,বিভিন্ন উপন্যাসের গল্প একে একে সব বলে যেতে লাগলো৷ একটা গল্প শেষ না হতেই আর একটি শুরু হয়। থেমে গেলেই সবাই হই হই করে ওঠে।
রাত ক্রমশ বাড়ছে। শেষ রাতের দিকে কুয়াশা জমাট বাঁধার সাথে সাথে চাঁদ ও কেমন ঘোলাটে হয়ে এসেছে। টুসী লম্বা লম্বা হাই তুলছে। জীতু আর মৌ বারান্দার টিনের বেড়ার সাথে হেলান দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সামিয়া রাতুলের গায়ের সাথে ঠেস দিয়ে একটু পর পির আড়মোড়া ভাঙছে। গল্প বলতে বলতে রাতুল ও এক সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
হঠাৎ দেখছে সামিয়া ফুল তোলা একটি জামা পরে রাতুলের দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে রাতুল কোথায় যাও সামিয়া?
সামিয়া মুখে রহস্যময় ভংগিতে বললো সেটা তোমায় বলা যাবেনা।
কিছুক্ষণ পরে বাড়ির ভেতরে চিৎকার শুনে এগিয়ে গেল রাতুল, বেশ কিছু অচেনা মানুষ পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে চিৎকার করছে। আর পুকুরে ভাসমান কি যেন দেখাচ্ছে। রাতুল চমকে উঠলো। আর একটু এগিয়ে এসে পুকুরের মাঝখানে তাকিয়ে দম বন্ধ হওয়ার মত। সামিয়া মাঝ পুকুরে ভাসছে। রাতুলের সব কিছু এলোমেলো লাগে। কোনো রকম সোজা হয়ে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অমনি রাতুলের ঘুম ভেঙে গেল। গল্প বলতে বলতে রাতুল ও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা জানেনা বুকের ভেতর কেমন যেন লাগছে রাতুলের। ঝট করে সামিয়ার দিকে তাকালো রাতুল। সে শান্ত ভংগিতে বারান্দার টিনের বেড়ায় হেলান দিয়ে রাতুলের বাম বাহুর উপর কিছুটা শরীরের ভর চাপিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। রাতুল দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। বেশ শীত পড়েছে। পাতলা চাদরটি সামিয়ার গায়ে টেনে দিল রাতুল৷ চাঁদের আলোয় দেখলো ঘুমের ভেতরেও তার মুখ খানি বেশ হাসি মাখা, সুবীধ,অথচ দুষ্টু। তাকে নিয়ে ভয়ংকর একটি দুঃস্বপ্ন দেখে রাতুলের দিম বন্ধ করার উপক্রম। ঘুম ভেঙেযাবার পর তার শান্ত, সুন্দর নরম চাঁদের মত মুখ খানা দেখে হঠাৎ আনন্দে বুকটা ভরে উঠলো রাতুলের।
টুসী,জীতু,মৌ একেক জন একেক দিকে হেলান দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সামিয়াও তাই তবে রাতুলের কাছেই।
হেমন্তের এই হিম– হিম রাত কেমন যেন সব অলৌকিক হয়ে উঠেছে, আকাশের ঘোলাটে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রাতুল দীর্ঘ শ্বাস ফেললো৷
রাতুল সামিয়াকে বলেনি,তার বাবা – মা গত পরশুদিন দেশে ফেরার সময় এক আকস্মিক প্লেন ক্রাশে মৃত্যুবরন করেছেন।দেশে ডেডবডি এসে পৌঁছাবার আগেই রাতুল সামিয়াকে গ্রামে নিয়ে আসে। রাতুল কাউকেই ঘটনা জানাই নি। তার বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন শূন্য শূন্য অনুভূত হতে থাকে।
পৃথিবীর এই সবুজ বলয়ে সময়ের স্রোতে হেঁটে চলা অসংখ্য মানুষের ভীড়ে কেউ কেউ হয়তো এমন সুন্দর হেমন্তের রাত আর কোনো দিন দেখবেনা৷ কিন্তু আজকের এই সুন্দর অগ্রহায়ণের রাতে রাতুলের পাশে চাঁদের আলোয় সামিয়াকে শান্তভাবে ঘুমাতে দেখে কেবল মনে হলো রাতুলেরএই নিষ্পাপ কিশোরী মেয়েটি যেন এমন সুন্দর রাতের মতই তার সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে৷
২০টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
অনন্য লেখনশৈলী আপনার। মুগ্ধতা অন্তহীন।
উর্বশী
ফয়জুল মহী,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
মহী লেখায় কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে এলাম। প্রতিটি লেখার পিছনে আমার মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে, তোমাদের সবার মন্তব্যের মাঝে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করি। মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অফুরান শুভ কামনা। ভাল ও সুস্থ সব সময়।
ছাইরাছ হেলাল
সুন্দর উপস্থাপন, গল্পের শেষের জন্য একদম তৈরি ছিলাম না।
সে হিসাবে সার্থক এ গল্প বলা।
উর্বশী
ছাইরাছ হেলাল ভাইয়া,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
লেখায় কিছুটা ভিন্নতা আনার চেষ্টা, ভাল হতে পারে ভিন্নতার জন্য। আর সোনেলা তো আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। এখানে আপনাদের মত গুনীজনের সান্নিধ্য আমার লেখার অনেকটা এগিয়ে নেয়ার পাথেয় হিসাবে কাজ করে। প্রতিটি লেখার পিছনে মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে , আর আপনাদের মত গুনীজনের মন্তব্য বা মতামত থেকে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছে যাই। এবং পরের কাজগুলো করতে সফল হই অন্তত লেখার ক্ষেত্রে। আই লাভ সোনেলা। আমার এই লেখায়ও বলতে পারি সফল, কারণ আমার যা উদ্দেশ্য ছিল সেটা এখন চোখ বন্ধ করে এগিয়ে নিতে পারবো।সবাই দীর্ঘ জীবি হন। এভাবেই যেন সব সময় সহযোগিতা করে যাবেন আশা করি। ভাল থাকুন,সুস্থ থাকুন,অফুরান শুভ কামনা সব সময়।
আরজু মুক্তা
ট্রাজেডি। প্রস্তুত ছিলাম না।
কিন্তু জানেন সামিয়ার সাথে আমার অনেক মিল।
ভালো থাকবেন
উর্বশী
আরজু মুক্তা আপু,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
আমাদের চারিপাশের, নিজেদের নিয়মতান্ত্রিক কিছু প্রচলন এসব কিছু থেকেই কিশোর– কিশোর, শিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। তার ই ভাবনা থেকে লেখা। তাহলে এই সামিয়ার তরুণী, যুবতী সম্পর্কে আমায় জানতে হবে।নতুন কিছু উপস্থাপন করা যাবে হয়তো।শুভ খবর ই বলবো।
অনেক ভাল থাকুন শুভ কামনা অবিরাম ।
সুপায়ন বড়ুয়া
এত সুন্দর গল্প পড়তে পড়তে
বিয়োগান্তক ঘটনাটা মনটাই খারাপ হলো।
উচ্ছল কিশোরীর গ্রামীন চপলতা ভালই লাগছিল।
শুভ কামনা।
উর্বশী
সুপায়ন বড়ুয়া দাদা ,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।
মন খারাপ হওয়ার মতই তো ঘটনাটি ই তো ঘটেছিল। কিশোরীর উচ্ছ্বাস, গ্রামীন দৃশ্য এবং সময় সব কিছু মিলে একটি দারুন ভাল লাগা তৈরি করেছে।ভাল থাকুন,সুস্থ থাকুন শুভ কামনা সব সময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গল্পটি মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম কিন্তু শেষটার জন্য মনটা ভরে উঠলো ব্যথায়। চমৎকার বর্ণনা প্রতিটি ঘটনার। স্বপ্ন টা ও সত্যি মনে হয়েছিল। অসাধারণ লেগেছে গল্প। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
উর্বশী
সুপর্না ফাল্গুনী আপু,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
এত গুনীজনের মাঝে আমার বড় সুযোগ তাই কাজে লাগালাম।লেখায় ভিন্নতা নিয়ে এলাম। যাক আমি আমার লক্ষে পৌঁছে গেলাম। সবার মন্তব্য বা মতামত অতি জরুরী মনে করছি। আপনি তো সব সময় ই থাকেন,এটা আমার দারুন ভাল লাগার অংশ। ভাল থাকুন,শুভ কামনা সব সময়।
সুরাইয়া পারভীন
আহারে! পড়তে পড়তে শেষের দিকে এসে বিষন্ন বিষাদে ভরে গেলো মন। সার্থক ট্র্যাজেডি গল্প
পাঠে অনেক মুগ্ধতা রইলো
উর্বশী
সুরাইয়া পারভীন আপু,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
লেখায় একটু ভিন্নতা খুঁজি সব সময়। ভাবলাম এত গুনীজনের মাঝে উপস্থাপন করবো, মন্তব্য বা মতামত থেকে আমি আমার লক্ষে পৌঁছাতে পারবো বলে বিশ্বাস।
এজন্য আপনাদের সবার মন্তব্য অতি জরুরী মনে করি।
অনেক ভাল থাকুন,শুভ কামনা সব সময়।
রেহানা বীথি
গ্রামের মায়া মায়া ভাব, সরল জীবন, আন্তরিকতা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তবে বিয়োগাত্মক শেষটায় মন খারাপ হল খুব। এমন অসময়ে যেন কোনও সন্তানের ওপর থেকে মা-বাবার ছায়া সরে না যায়।
উর্বশী
রেহানা বীথি আপু,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।
আপনার সাথে একমত পোষণ করছি । লেখায় কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে এলাম। অনেক ভাল থাকুন, শুভ কামনা রইলো।
শামীম চৌধুরী
খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্পটা লিখেছেন। মুগ্ধ হলাম।
উর্বশী
শামীম ভাইয়া,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
সময় করে পড়েছেন,মুগ্ধ হয়েছেন,এটি দারুন ভাল লাগা।
আগামীতেও এরকম সহযোগিতা পাব আশা করি। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, শুভ কামনা সব সময়।
ইসিয়াক
চমৎকার লেখা। পুরো লেখাটা একটানে পড়ে ফেললাম। ভালো লাগলো। শুভকামনা।
উর্বশী
ইসিয়াক ভাই,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।
যে কোনো লেখা এক টানে পড়ে ফেলা, সেটা অন্য রকম ভাল লাগা তৈরি হয়। আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগলো। অনেক ভাল থাকুন,শুভ কামনা সব সময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আবার পড়তে এসে দেখি মন্তব্যের ঘর ফাঁকা। অনেক ভালো লেগেছে আপু। তবে শেষটুকু সত্যিই কষ্টকর। জীবন যেমন চাই তেমন হয়না কেন?
ভালো একজন বন্ধু আছে তার জীবনে এটাই স্বান্তনা।
শুভ কামনা। শুভ সকাল।
উর্বশী
রোকসানা খন্দকার রুকু আপু,
একদম সঠিক,জীবন যেমন চাই, তেমন হয়না। আর একজন ভাল বন্ধু থাকাও খুব জরুরী। কিন্তু স্বছতার বেড়াজাল খুঁজে পাওয়ায় মুশকিল।
আন্তরিক ভালোবাসা সহ শুভ কামনা সব সময় ।