হিমুর হাতে একটি কম্পিউটার

রুমন আশরাফ ১ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ০৮:২১:৫৮অপরাহ্ন রম্য ২২ মন্তব্য

ফুপা তাঁর পিয়নকে দিয়ে আমার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। টেলিগ্রামের ভাষায় চিঠি-Emergency come sharp.  চিঠি হাতে ঝিম মেরে খানিকক্ষণ বসে কাটালাম। ঘটনা কি তা বোঝার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম না। বাদল হয়তো বড় কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। এতটুকু অনুমান করা যায়। সে উদ্ভট কিছু করছে, কেউ তাকে সামলাতে পারছে না। তাকে সামাল দেয়ার জন্য আমার ডাক পরেছে। আমি মন্ত্রতন্ত্র পড়লেই কাজ হবে, কারণ আমি হচ্ছি ওর কাছে ভয়াবহ ক্ষমতাসম্পন্ন এক মহাপুরুষ। আমি যদি বলি, আমি একসাথে আস্ত একটি গরু চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি, বাদল তাই বিশ্বাস করবে।

 

আমি ফুপার বাসার দিকে রওনা হলাম এমন সময়ে, যেন দুপুরে ঠিক খাবারের সময় উপস্থিত হতে পারি। টাকা পয়সা একেবারেই শেষ। দু’মাসের মেস ভাড়া বাকি। হাঁটতে হাঁটতে কেরামতের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। কেরামত আমাকে দেখা মাত্রই বিনয়ের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। এ দোকানদারও আমাকে ক্ষমতাসম্পন্ন এক মহাপুরুষ মনে করে। একদিন তার দোকানে বসে সিগারেট খেয়ে যাবার সময় তাকে বলে গেলাম, ‘আজ বাড়িতে গিয়ে এক খুশির খবর শুনবে’। ব্যস এ কথাতেই কাজ হয়ে গেলো। পরদিন যখন তার দোকানে সিগারেট খেতে যাই সে আমাকে দেখে পা ছুঁয়ে সালাম করার জন্য এগিয়ে এলো। আমি বাধা দিলাম। ‘হিমু ভাই, আপনে যে একজন ক্ষমতাবান মানুষ তা আমি বুইঝা ফালাইছি। কাইলকা বাড়িত গিয়া হুনি আমার ছুট ভাইয়ের একটা চাকরি হইসে। খুশিতে আমি কাইন্দা দিসি। এ ঘটনা আপনে আগেই জানতে পারছিলেন। আপনে হইলেন এই পিরথিবির একজন গুণী মানুষ’। এরপর হতেই সে আমার ভক্তে পরিণত হয়। বেশ কিছুদিন ধরে ওর কাছ থেকেই আমি বাকিতে সিগারেট নিই। হাত খালি, টাকা দিতে পারছিনা। অবশ্য সে আমাকে অনায়াসেই বাকি দিচ্ছে। আমাকে বাকি দিয়ে সে বোধহয় আনন্দ পায়। আজও সিগারেট বাকিতে নিলাম।

 

ফুপা এখন থাকেন ওয়ারীতে। নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাসায় গিয়ে দেখি সবাই খেতে বসেছে। ফুপাও খেতে বসেছেন। তিনি এমনিতেই গম্ভীর ধরণের মানুষ। আজ আরও গম্ভীর লাগছে। আমার আগমন দেখে তিনি মহা বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চিঠি পেয়েই আমি এসেছি, অথচ তিনি কেন বিরক্ত বুঝতে পারছি না।

 

বাদল আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। চিৎকার করে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আসবে, আমি জানতাম’। ফুপু বিরক্ত গলায় বললেন, ‘ভাব দেখে মনে হচ্ছে হিমুকে তুই আগে কখনও দেখিসনি। খেতে বস, খামাখা ভ্যাজর ভ্যাজর করবি না’। ফুপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খেতে এসো, তোমার সাথে পরে কথা বলবো’। আমিও প্লেট নিয়ে খেতে বসলাম।

 

খাওয়া শেষে চলে গেলাম বাদলের রুমে। ঢুকেই দেখলাম বিছানার উপর কম্পিউটারের সকল অংশ খুলে রাখা হয়েছে। ফুপা এবং বাদল কিছুক্ষণ পর রুমে আসলেন। আমি ফুপার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বাদলের সমস্যাটা কি? আমাকে ডেকেছেন, বাদলের জন্যই তো ডেকেছেন। কি করেছে বাদল?’ ফুপা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হারামজাদা পাগল হয়ে গেছে। মাত্র এক বছর আগে এতো টাকা দিয়ে কম্পিউটার কিনলাম আর এখন বলছে কম্পিউটার পুড়িয়ে ফেলবে’। আমি ফুপাকে বললাম, ‘ফুপা আপনি আপনার রুমে যান, রেস্ট নিন, আমি ওর সাথে কথা বলি’। ফুপা বাদলের দিকে কিছুক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, ‘কিরে ব্যাপারটা কি?’ বাদল উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘হিমুদা আমি কম্পিউটার পুড়িয়ে ফেলবো। এটা দেখলেই রাগ লাগে। কঠিন রাগ’।

-‘আমিতো তোর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না, খুলে বল’।

-‘শোন, আমি কয়েকজনকে কম্পিউটার শিখাতাম। যখন ওরা শিখতো তখন আমার সাথে হাসি হাসি মুখে কথা বলতো। কম্পিউটার শেখা শেষ। এখন কথা বলা তো দূরের কথা, দেখলে চিনেও না। কত বড় নিমকহারাম’।

-‘কিন্তু সমস্যাটা কি?’

-‘সমস্যা হল এতো টাকা দিয়ে আমি কম্পিউটার শিখলাম আর এতো যত্ন করে ওদের শেখালাম। এখন আমাকে ওরা ভুলে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কম্পিউটার আমি পুড়িয়ে ফেলবো’।

-‘টাকা পয়সা দিয়েছে?’

-‘না দেয়নি। ওটা দিলেও একটা কথা ছিল। আসলে আমি শুধুমাত্র টাকার জন্য শিখাইনি। ওদের শেখালে আমারও প্র্যাকটিস এই ভেবে শেখানো’।

-‘টাকা চেয়েছিলি?’

-‘চেয়েছিলাম। দেবে দেবে করে আর দেয়নি’।

-‘শোন, এসব কোনও ব্যাপার না। মাঝে মাঝে ফ্রি সার্ভিস দিতে হয়। দেখিস না অনেক স্কুল-কলেজে গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ানো হয়। যারা বিনা বেতনে পড়ে তারা এতে উপকৃত হয়। আর যারা পড়ায় তারা মানুষ হিসেবে যে কত বড় তা কি বুঝতে পারছিস? তুই ওদের ফ্রি কম্পিউটার শিখিয়েছিস, তুই মানুষ হিসেবে অনেক বড়। বুঝতে পেরেছিস?’

-‘পেরেছি’।

-তুই কম্পিউটারটি না পুড়িয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতে পারিস। কম্পিউটার পোড়ালে ধোঁয়ায় পরিবেশ নষ্ট হবে। স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের এটা ভাবা দরকার। চল তাহলে ফেলে দিয়ে আসি’। বাদলের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। মনে হচ্ছে আমার প্রস্তাবে রাজী হয়েছে। বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি করে পাঞ্জাবি পরল বাদল।

 

কম্পিউটারটি নিয়ে আমরা বের হলাম। বাদল মনিটরটি মাথায় নিয়ে হাঁটছে। গলায় মাউস ঝুলানো। আমি সিস্টেম ইউনিটটি কাঁধে নিয়ে হাঁটছি। অন্য হাতে কীবোর্ড। লোকজন কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। দেখতে ভালই লাগছে। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

-‘কিরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?’

-‘নাহ, ভালই লাগছে’। বাদলের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। গান ধরেছে- Someday, someway …

 

দয়াগঞ্জে এসে ফোন-ফ্যাক্সের একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। অনেকদিন হল রুপার কোনও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে না। ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে রুপা ধরল।

-‘হ্যালো’।

-‘কেমন আছ রুপা?’

-‘ভাল। আজ আবার কি মনে করে ফোন করেছো?’

-‘নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের কথা শুনেছ। কিন্তু কম্পিউটার বিসর্জন শুনেছ কখনও?’

-‘কম্পিউটার বিসর্জন আবার কি?’

-‘কম্পিউটার বিসর্জন হল পোস্তগোলা ব্রিজের উপর হতে কম্পিউটার নদীতে ফেলে দেয়া। আর মাত্র আধ ঘণ্টা পরেই এটা হবে। দেখতে চাইলে চলে এসো। অনেক সাংবাদিকও থাকবে এখানে। ছবি তোলা হবে’।

-হিমু, অনেক পাগলামি কথাবার্তা বলেছ আর না। এখন রাখছি’।

খট শব্দ করে ফোন রেখে দিল রুপা। ফোন করার পর মনে হল আমার কাছে কোনও টাকা নেই। ফোন বিল দিতে হবে। বাদলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিলটি দিয়ে দিলাম।

 

ব্রিজের উপর যখন উঠা শুরু করেছি পিছনে তাকিয়ে দেখি একদল টোকাই আমাদের পিছন পিছন আসছে। ব্রিজের ঠিক মাঝখানে এসে কম্পিউটারটি নিচে রেখে আমরা দাঁড়ালাম। টোকাইগুলো এখনও আছে। ব্যাপার কি তা দেখার জন্য আশপাশের লোকজন আসছে আমাদের দিকে। সবার চোখে কৌতূহল। দেখতে দেখতে ছোটখাটো একটি জনসমুদ্রে পরিণত হল জায়গাটি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম সাংবাদিক রবিন ভাইও এদিকে আসছেন। রুপা হয়তো তাঁকে খবর দিয়ে এখানে আনিয়েছে। তিনি আমাকে কোনও প্রশ্ন করলেন না। আর করলেও আমি উত্তর দিতাম না। থাকুক না কিছু রহস্য।

 

আমি নিঃশব্দে সিস্টেম ইউনিটটি ব্রিজের রেলিং এর উপর ধরে রাখলাম। বাদলও মনিটরটি তাই করলো। সাংবাদিক ছবি তুলছে পটাপট। ভালই লাগছে। নিজেকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে মনে হচ্ছে। ব্রিজের নিচে তাকিয়ে দেখলাম আশেপাশে কোনও নৌযান নেই। বাদলের দিকে তাকালাম। নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। আমার দু’হাতে ধরে রাখা বস্তুটি নদীতে ফেলে দিলাম। বাদলও ফেলল তার দু’হাতে ধরে রাখা বস্তুটি। ছপাত ছপাত দুটো শব্দ হল পরপর। পিছনে তাকিয়ে দেখি টোকাইরা করতালি দিচ্ছে। বয়সে ছোটো দু’জন টোকাইকে ডেকে কীবোর্ড-মাউস দিয়ে দিলাম। জিনিসগুলো পেয়ে ওরা দৌড়ে চলে গেল। ধীরেধীরে লোকজনের উপস্থিতি কমতে লাগলো। রবিন ভাই এগিয়ে এলেন। ব্যাপার কি জানতে চাইলেন। রহস্যজনক হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম-ব্যাপারটি বলতে চাইছি না। বাদলও মৌন ভুমিকা পালন করলো। আমি ভাবতে লাগলাম রবিন ভাই পত্রিকার জন্য কি রিপোর্ট তৈরি করবেন। হয়তো কাল পত্রিকায় উঠবে-

 

“নদীতে কম্পিউটার বিসর্জন!!!

......................................................

স্টাফ রিপোর্টারঃ গতকাল বিকেল চারটায় পোস্তগোলা ব্রিজের উপর এক অবাক করা ঘটনা ঘটে যায়। সেখানে প্রায় উন্মাদ দু’জন ব্যক্তি ব্রিজের উপর হতে বুড়িগঙ্গা নদীতে একটি কম্পিউটার ফেলে দেয়। ব্রিজের আশেপাশে থাকা লোকজনের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। কম্পিউটারটি নদীতে ফেলে দেবার পর মাউস আর কীবোর্ড উপস্থিত দু’জন টোকাইদের দিয়ে দেয়া হয়। ঘটনার ব্যাপারে কিছু জানতে চাওয়া হলে তারা কিছু বলেনি, শুধু মুচকি হাসি দিয়েছে”।

 

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি আর বাদল সূর্যাস্ত দেখার জন্য তাকিয়ে আছি পশ্চিমাকাশে। নদীটিকে এমুহূর্তে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। শীতল হাওয়া বইছে। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে তাদের নীড়ে। এমুহূর্তে খুব মনে পরছে বাবাকে। খুব বেশি মনে পরছে।

 

(প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর ‘হিমু’ চরিত্র অনুসরণে লেখা।

সময়-২০০৪ ইং)

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ