
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। শুধু তাই নয় একেকটি পূজোর জন্য একেক নিয়ম-কানুন, ধরণ , রকম, সাজসজ্জা, নৈবেদ্য। কিন্তু সব পূজোতেই প্রদীপ জ্বালাতে হয়। এই প্রদীপ শুধু মন্দিরেই নয় বা মন্দিরের চারদেয়ালেই সীমাবদ্ধ নয়। গঙ্গাপূজোর সময় নদী তীরে প্রদীপ জ্বালানো হয় তারপর ভাসিয়ে দেয়া হয় আবার দীপাবলীতে ঘরের কোনায় কোনায়, দেয়ালে, সিঁড়িতে, রাস্তা পর্যন্ত প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়। যার যার সাধ্যমতে কখনো মাটির, কখনো পিতলের প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রদীপের সলতে ব্যবহার হয় তুলো বা পাতলা কাপড় দিয়ে। সেখানে তেল বা ঘিয়ের ব্যবহার করা হয় প্রদীপ জ্বালানোর জন্য। প্রদীপ জ্বালানো হিন্দু পুজোর আবশ্যিক ব্যাপার।
দু’হাজার বছর আগে যখন পুরাণ রচিত হল, তখন ঈশ্বর আর নিরাকার রইলেন না, ওই সময় তাঁরা সাকার হয়ে উঠলেন। সেই সময়ের পূজোর সঙ্গে এখনকার পূজোর অনেক মিল পাওয়া যায়। পূজোর অঙ্গ হিসেবে যেমন – স্নানাভিষেক, বস্ত্র, নৈবেদ্য, গন্ধদ্রব্য, ধুপ ও দীপ সহযোগে পূজো শুরু হতো। এই পুজোয় অবশ্য ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য আগুন জ্বালানো হতো না, পূজোর চারপাশ যাতে আলোকিত হয়ে ওঠে, কোথাও কোনও অন্ধকার না থাকে সে জন্য আলো বা দীপ জ্বালানো হতো। এই প্রথায় আগেকার যুগে ভারতে গাছ, পাথর, নদী, পাহাড় এমনকি সাপকেও ঈশ্বররূপে পূজো করা হতো। তখন সন্ধ্যা নামলে লোকজন তাদের ঘরে বাতি জ্বালাতেন যাতে পথচারীরা প্রয়োজন হলে সেই বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারেন। এখনকার দিনেও অনেকে সদর দরজায় আলো জ্বেলে রাখেন, যাতে পথচারীদের কোনো সমস্যা না হয়। ভয়ংকর জীবজন্তু, অশুভ শক্তিকে দূরে রাখার জন্য ও আলো জ্বালানো হতো। মূলতঃ মাটির প্রদীপ জ্বালানোর রীতি থাকলেও, ধনীরা পিতলের প্রদীপ জ্বালাতেন। কেউ তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালাতেন, গোপালকরা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালাতেন। তা ছাড়া পারিবারিক রীতি এবং সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব তো ছিলই।
দীপ বা আলোকের নানান ধরণ হতো। যেমন বাড়ির কর্ত্রী যে দীপ জ্বালাতেন, সেই দীপের আগুন ছিল যজ্ঞের আগুনের থেকে একদম আলাদা। যজ্ঞশালায় ব্রাহ্মণ হোম করার জন্য আগুন জ্বালাতেন। যজ্ঞশালার আগুন ধুনির আগুনের থেকে আবার আলাদা হতো। সন্ন্যাসীরা ধুনি জ্বালাতেন। ধুনী জ্বালাতে ইটের কোনও বেদী তাঁরা ব্যবহার করতেন না , বনের কাঠপাতা দিয়ে আগুন জ্বালানো হতো। যজ্ঞের আগুনে একটা ঘরোয়া ব্যাপার থাকত। হিন্দুরা যখন থেকে যাযাবরদের মতো এদিক সেদিক ঘোরা বন্ধ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস ও চাষবাস করতে শুরু করলো তখন থেকেই তারা তাদের বাড়ির আঙিনায় বাতি দেওয়াও শুরু করলো। উৎসবের সময় নদীতে, ছোট ছোট পুকুরে ছোট নৌকা গড়ে প্রদীপ দিয়ে সাজিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। লণ্ঠন জ্বালিয়ে একটা উঁচু মাচা বা বাঁশের সঙ্গে সেই লণ্ঠনকে বেঁধে দেওয়া হতো। তারপর সেই লণ্ঠনটিকে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। একে বলা হয় কান্দিল বা আকাশদীপ।
সন্ন্যাসীদের ধুনি থেকে যজ্ঞশালার আগুন, সেখান থেকে লক্ষ্মী ঠাকুরের পূজোর জন্য দীপ জ্বালানো- প্রদীপের এ হেন দীর্ঘ যাত্রাপথের হাত ধরে আমাদের সমাজের সংস্কৃতিও অনেক বদলে গেছে। প্রদীপ যে শুধু সংস্কৃতি বদলের সাক্ষ্যপ্রমাণ দিচ্ছে তাই নয়, দীপের বদল জানান দিচ্ছে মানুষ এখন সমৃদ্ধি থেকে প্রাচুর্যের ঘরে এসেছে। প্রত্যেকটা বড় বড় মন্দিরের ছাদে জ্বালানো থাকতো প্রদীপ। এ থেকে বোঝা যেতো হিন্দুদের মন্দির আর প্রাসাদের অবস্থান কোথায়। পুরাণে রয়েছে যে, আগুনের একটা স্তম্ভের মাধ্যমে ভগবান শিব পৃথিবীতে পদার্পন করেছিলেন। এই একই বিশ্বাস থেকে মহারাষ্ট্রে মানুষ একটা খুব উঁচু স্তম্ভে বসিয়ে রাখে একটি প্রদীপকে।
বৈদিক যুগে অবশ্য প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা ছিল না। তখন হোম-যজ্ঞ হত। বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরেও যে সনাতন ধর্ম রয়েছে সেখান থেকে এই প্রথাটি এসেছে বলে মনে করা হয়। বৈদিক হিন্দুত্বের বাইরে যে সনাতন ধর্ম রয়েছে সে সম্বন্ধে যদিও আমাদের জানা নাই। যখন থেকে হিন্দুরা সাকার দেব-দেবীর পূজা শুরু করে তখন থেকেই এই প্রথার শুরু। ভাগবত গীতার নবম অধ্যায়ের ছাব্বিশ নং শ্লোকে ভগবান কৃষ্ণ বলছেন যে শুধু মাত্র একটি ফল, একটি ফুল, গাছের একটি পাতা ও অল্প জল দিয়ে যদি ভক্তরা তাঁকে পূজো করেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। এই শ্লোকটিতে ভগবান কৃষ্ণ কোথাও দীপ জ্বালানোর কথা বলেননি।
সমস্ত হিন্দুদের মধ্যে তা সে বৈদিক হোক বা পৌরাণিক, নিগমীয় হোক বা অগমীয় অথবা শ্ৰৌত বা স্মার্ত-তাঁদের পূজোর ধরন অনেকটাই একই রকম। তাঁরা প্রথমে ঈশ্বরকে আহ্বান করেন, তারপর তাঁকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে ভক্ত সেই প্রসাদ পান। এরপর ভক্ত তাঁর কাছে কোনো বর চান তারপর সবশেষে বিসর্জন। বৈদিক যুগে এ ভাবেই ঈশ্বরের পূজো হতো। তখন অবশ্য প্রদীপের জায়গায় ছিল মাটির হোমকুণ্ড। হোমকুণ্ডে কাঠ জ্বালান হতো। এই যজ্ঞকুণ্ডকে পূজা করা হত ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হতো, সঙ্গে চলতো বৈদিক মন্ত্রপাঠ।
নানা শিল্পকলায় দেখা যায় যে দেব-দেবীদের হাতের তালুতে আগুন জ্বলছে, এবং তাদের চুল থেকে সেই আগুনের জ্যোতি বেরোচ্ছে। তাই আগুনের একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। পুরাণে আগুনকে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যে আগুন সবকিছু কিছু গ্রাস করতে পারে, আবার সেই আগুনের তাপ মনে শান্তি আনে, জ্ঞান প্রদান করে। তাই শ্যামাপূজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো হয়। দেশের কোথাও কোথাও দীপাবলির দিনই নতুন বছর শুরু হয়। দেবদেবীর আহ্বান করার জন্য লোকজন নিজেদের বাড়িতে প্রদীপ জ্বালান। প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবদেবীর মধ্যে প্রথমে ভগবান রামকে ও তারপর সমৃদ্ধির দেবী ভগবান লক্ষ্মীকে আহ্বান করা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে শুধু ঘরের , বাহিরের অন্ধকার নয় মনের অন্ধকার ও দূর হোক সবার এই কামনা রইলো।
এই হলো হিন্দুদের পূজোতে প্রদীপ জ্বালানোর আদ্যপান্ত। আশা করি লেখাটি সবার ভালো লাগবে। ঈশ্বর সবার সহায় হোন।
তথ্য- সংগৃহীত
ছবি-গুগল
২০টি মন্তব্য
রেজওয়ানা কবির
হিন্দুধর্মের প্রদীপ জ্বালানোর ইতিহাস জানলাম। ভালো লাগল, শুভকামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
প্রথম হবার জন্য অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন শুভকামনা অবিরাম
রেহানা বীথি
সুন্দর তথ্য তুলে ধরলেন আপু। অনেককিছু জানলাম আপনার পোস্টের মাধ্যমে। ভালো থাকুন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো। আপনি ও ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
ফয়জুল মহী
সাধারণত হরে কৃষ্ণ হরে রাম হলো মন্ত্র কিন্ত মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে রামের পর দেবী লক্ষ্মীকে স্বরণ করে । জানা ছিলো না।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা রইলো
ছাইরাছ হেলাল
অনেক কিছু জানলাম, যা কিছুই জানা ছিল না।
আগাম শুভেচ্ছা পূজোর।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অফুরন্ত ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনাকেও অগ্রীম পূজোর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। ভালো থাকবেন নিরাপদে থাকবেন
ত্রিস্তান
আলো কেবল বাহিরে নয়, দেবদেবীগন আলো ভেতরে ধারণ করতেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
সুপায়ন বড়ুয়া
সুন্দর একটি বিষয়বস্তু নিয়ে লিখলেন।
জেনে ভাল লাগলো।
অন্ধকার দুর করে আলোর উপস্থিতি চীরন্তন।
তেমনি মনের কালিমা দুর করে।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনার মন্তব্য সবসময় অনুপ্রেরণার উৎস। অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ দাদা পাশে থাকার জন্য। অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
তৌহিদ
এই তথ্য জানতামই না। আপনার ভিন্নধর্মী এই লেখায় নিজের জ্ঞান কিছুটা সমৃদ্ধ হলো। অনেক ধন্যবাদ আপু।
শুভকামনা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
ব্লগ সঞ্চালক
প্রিয় ব্লগার আপনার এই লেখাটি এই সাইটের পোষ্টের হবহু কপি করা। কপি পোষ্ট আমাদের ব্লগের নীতি মালায় নিষিদ্ধ আছে।
তাই পোষ্টটি মুছে দেয়া হলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ। আমি লেখাটি সম্পাদনা করে দিয়েছি। দুঃখিত আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য।
আরজু মুক্তা
অনেক কিছু জানলাম।
আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা
সুপর্ণা ফাল্গুনী
🙂🙂😍😍 ধন্যবাদ ধন্যবাদ ধন্যবাদ আপু। আলোয় আলোয় আলোকিত হোক এই ধরণী। আপনার জন্য একরাশ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
সুরাইয়া পারভীন
অনেক অজানা জানা হলো আপনার পোস্টের মাধ্যমে। সুন্দর পোস্টের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দিদিভাই
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন সবসময়
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা নিরন্তর। শুভ সকাল