হারিয়ে যাচ্ছে যে সব প্রাচীন ঐতিহ্য

জি.মাওলা ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩, সোমবার, ০২:১৭:৪১অপরাহ্ন বিবিধ ১১ মন্তব্য

হারিয়ে যাচ্ছে যে সব প্রাচীন ঐতিহ্য

হাজার বছরের চলে আসা বাঙ্গালিদের কিছু ঐতিহ্যবাহী জিনিস যা আমরা সেই প্রাচীন কাল হতে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছি। এই ঐতিহ্যবাহী জিনিস গুলি হাজার বছরের বাংলার সংস্কৃতির এক একটি উপাদান। আজ এই আধুনিক যুগে আধুনিক পণ্যের কাছে , আধুনিক কলা কৌশলের নিকট মার খেয়ে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে। আসুন দেখি কে কতটির সঙ্গে পরিচিত। বা কে কোনটি ব্যবহার করেছেন কোন সময় কোন কাজে।
১। পালকের কলম: পাখির পালককে প্রাচীন কাল হতে কলম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পাখির পালককে অফিস আদালতে ও সমাজের অভিজাত ব্যক্তি গন কর্তৃক কিছুটা শৌখিনতার প্রতীক হিসেবে কলম হিসেবে ব্যবহার করা হত। এটি আর দেখা যায় না।
২। বন গাছের কলম: বন এক প্রকার গাছ, অনেকটা বাঁশের কঞ্চির মত। এক সময় এই বন গাছের দ্বারা তৈরি কলম ব্যবহার করা হত। বনের কলম কে কালীর দোয়াতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলে এটি কালি শোষণ করে নিত। এটির কাণ্ড ফাঁপা (অনেকটা এখন কার বিভিন্ন রং এর খাতায় দাগ টানার জন্য যে কলম আমরা ব্যবহার করি তার ভিতরের স্পঞ্জের শিষের মত) বলে সহজে কালি শুষে নিত। এর পর চলত তা দিয়ে লিখা। কালি শেষ হলে আবার চুবিয়ে নিতে হত।

৩। বাঁশের কঞ্চির কলম: খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। আমাদের অনেক বাপ দাদারা ( ৪০-৫০ বছর আগে) বাঁশের তৈরি কলম দিয়ে প্রথম লিখা শিখার হাতে খড়ি নিয়েছে। বাঁশের কঞ্চিকে ৪-৫ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে নিয়ে তার এক প্রান্ত চোখা করে তাতে কালি ভরে কলম হিসেবে ব্যবহার করা হত।

@@ এই কলম গুলি আধুনিক কালি কলম ও বল পয়েন্ট কলমের নিকট মার খেয়ে আজ বিলুপ্ত।

৪। কলা ও তাল পাতায় লিখা: কাগজের প্রচলন থাকলেও , কলার ও তাল পাতাকে কাগজের বিকল্প হিসেবে লেখার কাজে ব্যবহার করা হত। বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা লিখা সুন্দর করতে ও লিখা শিখতে কলা ও তাল পাতা ব্যবহার করত।

@@ কাগজের প্রাপ্যতা ও মূল্য এটি ব্যবহারের একটি কারণ। আমি শুনেছি আমার বড় ভাই তাল পাতায় লিখেছে।

৫।পালের নৌকা: পালের নৌকা বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম একটি উপাদান। ছোট বড় সবধরনের নৌকাতেই পাল ব্যবহার করা হত। মূলত মাঝিরা যখন দাড় টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে যেত বা বাতাস অনুকূল থাকলে পাল তুলে খুব তাড়াতাড়ি এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় যাওয়া আসা করা হতো।
@@ তবে বর্তমানে প্রত্যেক নৌকায় পালের যায়গা দখল করেছে মেশিন।
৬। খড়ম: খড়ম এক প্রকার জুতা বিশেষ। গ্রাম বাংলায় অনেকে আগে আধুনিক স্যান্ডেলের বা জুতার বিকল্প হিসেবে পায়ে ব্যবহারের বস্তু। কাঠ দ্বারা তৈরি করা হত । খড়ম ২ প্রকার দেখা যায়। যথা:
ক) বয়েল খড়ম
খ) দলযুক্ত খড়ম
বর্তমানে খড়ম ব্যবহার করা যেন রূপ কথার মত শোনায়।
@@ বর্তমানে তৈরি স্যান্ডেল এর কাছে খড়ম মার খেয়ে গেছে।
৭। পালকী: পালকি আগে অভিজাত শ্রেণীর চলাচলের জন্য (বিশেষ করে মেয়েদের) ব্যবহার করা হত। তবে বর-কনের পরিবহণ করতে এই বিশেষ যানটির ব্যবহার উল্লেখ যোগ্য। বাঁশ, কাঠ, টিন ও লোহার শিক দ্বারা তৈরি পালকি খুব দৃষ্টিনন্দন ও শিল্প সমৃদ্ধ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চারজন বেহারা পালকি বহন করত। সেকালে পালকি ছাড়া বিয়ের সুন্দর আয়োজনটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
@@ আজ যান্ত্রিক সভ্যতায় যন্ত্রের পরিবহণ ব্যবস্থার নিকট টিকতে না পেরে হারিয়ে গেছে পালকি।
৮। গরুর গাড়ি: আমার গরুর গাড়িতে
বউ সেজে..............................।
ওকি গাড়োয়াল ভাই......................................................।
এরকম জনপ্রিয় গানের কথায় গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ আছে। গরুর গাড়ি বাঁশ ও কাঠ দ্বারা তৈরি করা হয়। সাধারণত পল্লী অঞ্চলে গ্রামের মহিলারা নায়েরে গেলে একমাত্র বাহন এই গরুর গাড়ি। গাড়িতে টপর বা নৌকার ছই আর মত ছাওনি দিয়ে একে সাজানো হত।এছাড়া গ্রামের যে কোন পণ্য পরিবহণে ব্যবহার হত গরুর গাড়ি।
@@ আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনো কিছু কিছু এলাকায় টিকে আছে গরুর গাড়ি।

৯। শিকা: শিকা গ্রাম বাংলায় গ্রামীণ বধূদের নিপুণ হস্তশিল্পের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। শিকার ছিল বহুমুখী ব্যবহার। পল্লী বধূরা শিকায় ঝুলিয়ে রাখতো সংসারের বিভিন্ন জিনিস। মাঝে মাঝে রঙিন শিকেয় ঘরের মাঝে নতুন হাঁড়িপাতিল ও অন্যান্য জিনিস সারি সারি ভাবে ঝুলিয়ে রাখতো। আজ সে শিকা সত্যিই শিকাই উঠে গেছে।
@@ সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বাড়ি ঘর ও জিনিস পত্র রাখার বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার হবার ফলে শিকা সত্যিই শিকাই উঠে গেছে।

১০। হুক্কাঃ হুক্কা ছিল গ্রাম বাংলার অতি প্রাচীন একটি ঐতিহ্য। এটি গ্রামীণ কৃষক থেকে শুরু করে অবস্থা বান সকলের কাছে অতি পরিচিত ও অবসর কাটানোর মাধ্যম। কাজের ফাঁকে বা গল্প গুজবের মাঝে বা অবসরে ধূমপান করার বিশেষ একটি মাধ্যম। হুক্কা ২ ধরনের দেখা যেত। প্রথম টা পিতলের বা রুপার তৈরি, দ্বিতীয়টা নারিকেলের মালার মালার( শক্ত খোল) আর সঙ্গে কাঠের দণ্ডের হুক্কা। বিত্তবান ও অভিজাত শ্রেণীরা ব্যবহার করতেন পিতল বা রুপার তৈরি হুক্কা আর নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা ধূমপায়ীরা ব্যবহার করতেন নারিকেলের হুক্কা। আমি খুব ছোট থাকতে আমাদের গ্রামে এক বুড়ির( দাদী, তিনি অনেক আগে মারা গেছেন) কাছে দেখতাম এই হুক্কা। তিনি তা নিয়মিত খেতেন।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক হুক্কা কৃষকের ঘর থেকে ছেড়ে আজ স্থান নিয়েছে জাদুঘরে।
@@ আজ মেশিনে তৈরি বিড়ি ও সিগারেট এর কাছে হুক্কা পারেনি টিকতে।

১১। ঢেঁকি: গ্রাম বাংলার আর একটি প্রাচীন ঐতিহ্য হল ঢেঁকি। সেই প্রাচীন কাল হতে চাউল করতে, আটা করতে এবং বিভিন্ন মসলা গুঁড়া করতে ব্যবহার করা হত ঢেঁকি।
ঢেঁকি চাটা চাল..................।।
ঢেঁকি চাটা চালের ভাত কত দিন যে খাই নি আর শেষ কবে খেয়েছি মনে নেই।
@@ বর্তমানে ইঞ্জিন চালিত মেশিন ঢেঁকির স্থান দখল করে নিয়েছে।
১২।আলতা বড়ি: আলতা বড়ি মেয়েদের একপ্রকার প্রসাধনী। এর সাহায্যে মেয়েরা তাদের হাত, ঠোঁট, গাল ও পা লালা রঙ্গে রাঙ্গাতে। বিয়ের বাজারে লালা এই আলতা বড়ির নাম থকতো সবার উপরে।
@@ বর্তমান যুগে কৃত্রিম আলতা ও বিভিন্ন লিপিষ্টিক নেল পালিশ এই নিকটে মার খেয়ে একেবারে বিলুপ্ত এই আলতা বড়ি।
১৩। পিড়ি: বাড়ির মেহমান এলে বা বাড়ির বিভিন্ন কাজে বা কোথাও বসতে যে জিনিসটি এখনো গ্রামের মহিলারা ব্যবহার করে তা হল এই পিড়ি। এটি আগে তৈরি করা হত দুই ভাবে। ক) মাটি দিয়ে ও খ) কাঠ দিয়ে
তবে এখনো কাঠের পিড়ি ব্যবহার করা গরমে। আর এক প্রকার ব্যবহার হয় বর্তমানে রুটি বলতে।
@@ এখনো টিকে আছে এটি। তবে কম।
১৪। মাথাল বা মাথলঃ মাথাল গ্রামীণ কৃষকদের বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির হাত হতে বাঁচতে মাথায় দিয়ে বের হবার একটি বিশেষ ছাতা। বাঁশ ও শাল পাতার সাহায্যে এটি প্রস্তুত করা হয়। রোদ ও বৃষ্টি হতে রক্ষা পেতে গ্রামীণ কৃষকদের নিকট এটি স্মরণীয়। অনেকে এটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো।
@@ আধুনিক কালে এখনো এটি ব্যবহার হয়। যদিও ছাতা ও রেইন কোট এর নিকট হয়েছে এর হার।
১৫। নকশীকাঁথা: নকশীকাঁথা বাংলার ঐতিহ্য। পাখি, ফুল। লতা পাতা ও বিভিন্ন চিত্র একে মেয়েরা এককালে এক প্রকার আকর্ষণীয় কাঁথা তৈরি করতো। এই বিশেষ কাঁথাকে বলা হয় নকশী কাঁথা। নকশীকাঁথা সেলাই করা একদিকে যেমন মেয়েদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করত, তেমনি অবসর কাটানোর একটি মাধ্যম এই নকশীকাঁথা। সে সময় এটি ছিল শীত নিবারণে গরীবদের অনন্য বন্ধু। আজ নকশীকাঁথা ধনীদের বিলাস পণ্যে পরিণত হয়েছে। যদিও এটি পাওয়া খুব কঠিন।
@@ আধুনিক পোশাক , কাপড়ের ও কম্বলের জন্য ও সময়ের অভাবে গ্রামের মহিলারা আর এটি সেলাই করেন না। এক একটি নকশীকাঁথা সেলাই করতে ৬ মাস হতে ১ বছর লাগে।
১৬। ডুলি: বাঁশ ও পাটের দড়ি দিয়ে নির্মিত এক প্রকার ঝুলন্ত আরামদায়ক পরিবহণ। ডুলি দু জন বেহারা কাঁধে করে বহন করত। গ্রামের নববধূরা বাবার বাড়ি নায়ের করতে যেতে বা বাবার বাড়ি হতে স্বামীয়ে বাড়ি যেত ডুলিতে চড়ে। বিয়ের দিন কনের সহযাত্রী বা আচল-দি হয়ে কনের নানী বা দাদী ডুলিতে চড়ে বরের বাড়ি আসতো।
@@ আজ আর নেই সেই বেহারা আর ডুলি। সব কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
১৭। কলুর ঘানি: কলুর বলদ বাগধারার অর্থ কি সকলেই জানেন। আর এই কলুর ঘানি হতেই কলুর বলদ কথাটির উদ্ভব। কলুর ঘানি বলতে তৈলবীজ( সরিষা, তিল, তিসি........................... নারিকেল) হতে তেল উৎপাদন করার একটা সরল যন্ত্র। ৭-১০ ফুট লম্বা বাঁশ দিয়ে ও কাঠের গুড়ির সহযোগে ঘানি তৈরি করা হতো। এবং একটি গরু বা বলদ বা গাধা বা ঘোড়া দিয়ে একে টানানো হতো। একপ্রকার পেশাজীবী ঘান ভাঙ্গিয়ে তেল উৎপন্ন করে গ্রামে গ্রামে ফেরি করতো। আর এদের বলা হত কলু।
আমার মনে আছে অনেক ছোটতে আমাদের এলাকার এক গ্রামে বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে এই কলুর ঘানি দেখেছিলাম।
১৯। পাতি কুপ ও ইঁদারাঃ গ্রামের মানুষের সুপেয় বা খাবার পানির সবচেয়ে ভাল মাধ্যম ছিল এখনো কিছু কিছু গ্রামে দেখা যায় কুপ বা ইন্দ্রা বা ইঁদারা ও পাতকুয়া। ১০-১৫ ফুট গোল গর্ত করে প্রায় ৫০-৬০ ফুট নিচ পর্যন্ত ( বরেন্দ্র অঞ্চলের হিসাব) মাটি খুড়ে কুপ বা ইন্দ্রা বা ও পাতকুয়া তৈরি করা হত। মাটির নিচের ঝর্না ছিল এই কুপের পানির প্রধান উৎস। পাতি কুপ ও ইঁদারার মধ্যে পার্থক্য হল , ইঁদারার নিচ থেকে উপর পর্যন্ত ইট বা রিং( সিমেন্ট বালি দিয়ে তৈরি গোল কাঠামো) দিয়ে বাঁধায় করা হত আর পাতি কুপ বাঁধায় করা হত না।
@@ এই তো নলকূপ আসার আগে আমাদের যাদের গ্রামে বাড়ি তারা প্রত্যেকে কুপ বা ইন্দ্রা বা ইঁদারা ও পাতকুয়ার পানি খেয়েছি। তবে এখন অনেক কমে গেছে এটি।
২০। পাতার বিড়ি: শাল পাতা ও আলাপাত বা তামাক পাতা সহযোগে এক ধরনের বিড়ি আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। এই বিড়ি ছিল দামে সস্তা ও সহজে বানিয়ে ধূমপান করা যেত। আমি নিজেও দু এক টান মেরেছি। তবে কাশি হলে শুধু শাল পাতার বিড়ি ধুয়া খুব উপকারী( সত্যি মিথ্যা জানিনা গ্রামে শুনেছি, এবং দু একবার টান ও মেরেছি)।
@@ আজ মেশিনে তৈরি বিড়ি ও সিগারেট এর কাছে পাতার বিড়ি টিকতে পারেনি। তবে আমাদের নওগাঁ এলাকায় সাঁওতালরা কেও কেও এই বিড়ি খায়।

আরও এমন অনেক জিনিস আছে যা আজ বিলুপ্ত প্রায়। আমার মনে এবং দেখা ও পড়ার মধ্যে এই কয়টায় আমি জানি । আপনারা জানলে লিখে জানালে বাধিত থাকব। (বেশ কয়েক মাস ধরে লিখে আজ শেষ হল। )
https://www.facebook.com/golammaula.akas/posts/567071860027410

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ